ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কারণে আবাসস্থলসহ জমি হারানো ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে ১ হাজার ৩৪৪টি ফ্ল্যাট। ‘সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে’ নামের আলাদা একটি প্রকল্পের মাধ্যমে এসব ফ্ল্যাট তৈরি হয়েছে। নির্মিত ফ্ল্যাট সরকারি কর্মকর্তাদের বরাদ্দ দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে। এজন্য নীতিমালা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দেশের বিশিষ্ট নাগরিকেরা বলছেন, আমলারা তাদের নিজেদের স্বার্থে এমন উদ্যোগ নিয়েছেন। এটা বড় ধরনের অনিয়ম ও অপরাধ এবং দুর্নীতিও বটে। তবে জুলাই মাস জুড়ে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও পরবর্তীতে শেখ হাসিনার সরকারের পদত্যাগের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে প্রক্রিয়াটি শেষ পর্যায়ে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। যানজট নিরসনে রাজধানী ঢাকার সড়কের ওপর চাপ কমাতে এবং দ্রুত যানবাহন চলাচলের স্বার্থে বিমানবন্দর-মগবাজার-যাত্রাবাড়ীর মধ্যে নির্মাণ করা হচ্ছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। এটিই রাজধানী ঢাকার প্রথম দ্রুতগতির উড়ালসড়ক এবং প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা হচ্ছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য মতে, প্রায় ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ উড়ালসড়ক নির্মাণের জন্য সব মিলিয়ে ২০৫ দশমিক ৮৬ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি জমি ১৭৬ দশমিক ৮৪ একর। আর ব্যক্তি মালিকানাধীন জমির পরিমাণ মাত্র ২৯ দশমিক শূন্য ২ একর। আবার সরকারি জমির সিংহভাগের মালিক বাংলাদেশ রেলওয়ে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, এ প্রকল্পে যেসব ব্যক্তি জমি হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের পুনর্বাসনের জন্য সেতু কর্তৃপক্ষ ঢাকার উত্তরা আবাসিক এলাকায় ১ হাজার ৩৪৪টি ফ্ল্যাট নির্মাণ করেছে। প্রকল্পের ফ্ল্যাট বরাদ্দ নীতিমালা অনুযায়ী, কেবল ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরাই ফ্ল্যাট বরাদ্দের জন্য আবেদন করতে পারবেন। তবে ফ্ল্যাটগুলো নির্মাণের পর নীতিমালা সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সংস্থাটি। সংশোধিত নীতিমালায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য নির্মিত ফ্ল্যাটগুলো বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ও সেতু বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও পাবেন- এমন সুযোগ রাখা হয়েছে।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য এসব ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হয়েছে উত্তরা মডেল টাউন (তৃতীয় ফেজ) সংলগ্ন বড়কাঁকর, বাউনিয়া ও দ্বিগুণ মৌজায়। এজন্য গড়ে তোলা হয়েছে একটি ‘পুনর্বাসন ভিলেজ’। এখানে দুটি ব্লকে ভাগ করে ১২টি ভবনে ফ্ল্যাটগুলো তৈরি হয়েছে। প্রতিটি ভবন ১৪ তলা। ব্লক-‘এ’র ফ্ল্যাটগুলো ১ হাজার ২৯৪ বর্গফুট আয়তনের। পার্কিং সুবিধাসহ প্রতিটি ফ্ল্যাটের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৪ লাখ ১৪ হাজার টাকা। পার্কিং সুবিধা বাদে ফ্ল্যাটগুলোর দাম পড়বে ৫১ লাখ ১৪ হাজার টাকা। ব্লক-‘বি’তে নির্মিত ফ্ল্যাটগুলো ১ হাজার ৯০ বর্গফুট আয়তনের। পার্কিং সুবিধাসহ প্রতিটি ফ্ল্যাটের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৩ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। পার্কিং সুবিধা ছাড়া ফ্ল্যাটগুলোর নির্ধারিত দাম ৪০ লাখ ৪৪ হাজার টাকা।
সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য মতে, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের পুনর্বাসন ভিলেজে নির্মিত এসব ফ্ল্যাটের পাশাপাশি বিদ্যালয়, মসজিদ, কমিউনিটি সেন্টার, কমিউনিটি মার্কেট, কমিউনিটি ক্লিনিক, খেলার মাঠ, সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন, ইলেকট্রিক্যাল সাব-স্টেশন, অভ্যন্তরীণ সড়ক, নর্দমা, গভীর নলকূপসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে পুনর্বাসন ভিলেজটি নির্মাণে খরচ হয়েছে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। ফ্ল্যাটগুলোর বরাদ্দের জন্য একটি নীতিমালাও তৈরি করেছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের পুনর্বাসন ভিলেজে ক্ষতিগ্রস্তদের অনুকূলে ফ্ল্যাট বরাদ্দ নীতিমালার ধারা-২, অনুচ্ছেদ ১-এ বলা আছে, কেবলমাত্র ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিগণ ফ্ল্যাট বরাদ্দের জন্য আবেদন করতে পারবেন। সম্প্রতি এ অনুচ্ছেদ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ।
প্রস্তাবিত সংশোধনীতে বলা হয়েছে, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিগণ ফ্ল্যাট বরাদ্দের জন্য আবেদন করতে পারবেন। পরবর্তীতে অগ্রগণ্যতার ক্রম অনুযায়ী খালি থাকা সাপেক্ষে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের চলমান প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা-কর্মচারী, সেতু বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি এবং অবশিষ্ট ফ্ল্যাট উন্মুক্ত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বরাদ্দ দেওয়া যাবে। নীতিমালা সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদন হলে ফ্ল্যাটগুলো বরাদ্দ পাওয়ার যোগ্য হয়ে উঠবেন সেতু কর্তৃপক্ষ ও সেতু বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
তবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ফ্ল্যাট বরাদ্দ নীতিমালা সংশোধনের উদ্যোগকে ‘নীতিমালার লঙ্ঘন’ হিসেবে দেখছে। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, ‘এ ধরনের ঘটনাগুলো হতাশাব্যঞ্জক। তিনি মনে করেন, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য তৈরি করা ফ্ল্যাটগুলো প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মাঝেই বরাদ্দ দেওয়া উচিত। কারণ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এমনিতেই নানা সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা বলছেন, ১ হাজার ৩৪৪টি ফ্ল্যাট বরাদ্দের জন্য সেতু কর্তৃপক্ষের কাছে এখন পর্যন্ত আবেদন জমা পড়েছে ২৬১টি। এমন প্রেক্ষাপটে অবশিষ্ট ফ্ল্যাটগুলো ‘খালি থাকা সাপেক্ষে’ সেতু বিভাগ ও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বিভিন্ন প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের বরাদ্দ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সেতু বিভাগের সচিব ও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক মনজুর হোসেন বলেছেন, সংশোধিত নীতিমালা এখনো চূড়ান্ত হয়নি এবং আরো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তাদের ফ্ল্যাট দেওয়ার ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সেতু কর্তৃপক্ষের সর্বশেষ ১১৪তম বোর্ড সভা অনুষ্ঠিত হয় গত ২৫ জুন। আমরা প্রস্তাব তুলেছিলাম, অন্যান্য প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্তসহ আরো কিছু ধরন যুক্ত করে ফ্ল্যাট বরাদ্দ নীতিমালা সংশোধনের। সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে বিষয়টি আরো পর্যালোচনা করা হবে। পর্যালোচনা করে বিষয়টি সেতু কর্তৃপক্ষের পরবর্তী পরিচালনা পর্ষদ সভায় উপস্থাপন করা হবে।’ তবে এরপর বোর্ড সভা আর হয়নি। ফ্ল্যাট বরাদ্দ নীতিমালা পরিবর্তন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ফ্ল্যাটগুলোয় আরো ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে সুযোগ করে দিতে অন্যান্য প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্তদেরও বরাদ্দের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের কারণে যে পরিমাণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার বাইরেও অন্যান্য প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্তদের ফ্ল্যাট বরাদ্দের সুযোগ থাকায় এ পরিবর্তন আনা হচ্ছে।’
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের শিক্ষক ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের এক সময়ের পরামর্শক অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, ‘এ প্রকল্পের জন্য বেসরকারি জমি খ্বু বেশি অধিগ্রহণের প্রয়োজন পড়েনি। এ কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির সংখ্যা কম হতে পারে।’ তবে ফ্ল্যাটগুলো নির্মাণের আগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা নিয়ে যথাযথভাবে সমীক্ষা করা প্রয়োজন ছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি। নাগরিক সমাজের নেতা ও পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য নির্মিত ফ্ল্যাট সেতু কর্তৃপক্ষ ও সেতু বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বরাদ্দ দেওয়ার উদ্যোগ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যারা নীতিমালা পরিবর্তনের উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ভোরের আকাশ/মি
মন্তব্য