-->
শিরোনাম

শিক্ষাঙ্গনে বড় বিপর্যয়

নিখিল মানখিন
শিক্ষাঙ্গনে বড় বিপর্যয়

পড়াশুনা থেকে বিচ্ছিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা। গত চার বছর ধরে দফায় দফায় ব্যাহত হচ্ছে তাদের শিক্ষাজীবন। করোনা ভাইরাস মহামারিতে ঝরে পড়ে অসংখ্য শিক্ষার্থী। করোনার ক্ষত শুকানোর আগেই চলতি বছর আরেক দফা বড় বিপর্যয়ে শিক্ষাঙ্গন। গত সাত মাসে বেশিদিন ক্লাসে যাওয়ার সুযোগ পায়নি শিক্ষার্থীরা। প্রাকৃতি দুর্যোগ ও দুই ঈদের ছুটির আবহ দূর না হতেই শুরু হলো শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন। সৃষ্ট পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর গত ৬ আগস্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার কথা জানায় আন্তঃবাহিনীর জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। কিন্তু অরাজক পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা হুমকিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থী উপস্থিতি নেই।

রাজধানীর বিয়াম মডেল স্কুল এন্ড কলেজে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছে কৃষ্টি বনোয়ারী। গত সাত মাসেও হাইস্কুলে পড়ার স্বাদ পায়নি সে। স্কুলে যেতে না যেতেই একের পর এক ছুটিতে ব্যাহত হয় তার হাইস্কুল জীবন। ওয়্যারড্রোবে পড়ে আছে তার নতুন স্কুলড্রেস। স্কুলে যেতে এবং সহপাঠীদের দেখা পেতে সে ব্যাকুল হয়ে পড়ছে। পড়াশুনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে সে। মেজাজ হয়ে যাচ্ছে খিটখিটে।

কৃষ্টি বনোয়ারীর বড় বোন মাটি বনোয়ারীরও একই সমস্যায় ভুগছে। এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছে সে। কিন্তু কোটা আন্দোলনের সময় ভর্তি হওয়ায় সে এখনও কলেজে যাওয়ার সুযোগ পায়নি। সুযোগ মেলেনি নতুন কলেজড্রেস পরার। কলেজ খোলার অপেক্ষায় অস্থির তার মন। মনোযোগ দিতে পারছে না পড়াশুনায়।

ঢাকার শহিদ বীর উত্তম লে. আনোয়ার গার্লস কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী মোহাইমিনা ইসলাম বলেন, টানা পরীক্ষা হলে একটা ছন্দ থাকে। পড়াশোনাও ঠিক থাকে। এখন নতুন করে পড়ার কিছু নাই। শুধু রিভিশন দিচ্ছি। কিন্তু পরীক্ষা বন্ধ থাকায় এখন কোনটা ছেড়ে কোনটা পড়ব, ভেবে পাচ্ছি না বলে জানান মোহাইমিনা।

এভাবে শুধু মাটি,কৃষ্টি ও মোহাইমিনা নয়, দেশের সকল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। প্রাইমারি স্কুলের অবস্থা আরও নাজুক। করোনা মহামারির সময়ের মতো এবছরও অনেক প্রাইমারি শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়ার শঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা :গত সাত মাসে দীর্ঘ সময় ক্লাসের বাইরে থাকায় সন্তানদের লেখাপড়া নিয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা। তারা বলছেন, নানা কারণে চলতি বছরের বেশির ভাগ দিন ছুটি ছিল। ক্লাস না থাকায় গৃহবন্দি হয়ে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। অরাজক পরিস্থিতিতে বাইরে বের হওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। লেখাপড়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে তারা। ইন্টারনেটে চলমান পরিস্থিতির বীভৎস দৃশ্য দেখতে দেখতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কোমলমতি ছেলেমেয়েদের মানসিকতার। পরিস্থিতির কারণে অভিভাবকরাও সন্তানদের মানসিকতার বিরুদ্ধে যেতে পারছেন না। নিরাপত্তাহীন পরিবেশে সন্তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠানোর সাহস পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন অভিভাবকরা।

রাজধানীর মগবাজার মোড়ে ওয়াকফ ভবনের সামনে চায়ের দোকান চালান মো. ফারুক। তার একমাত্র ছেলে মো. সুমন সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। মো. ফারুক ভোরের আকাশকে জানান, প্রায় এক মাস ধরে ছেলের লেখাপড়া নেই। দিনের কয়েক ঘণ্টা চা দোকানে আমার সঙ্গে থাকে। চা বানানো শিখে গেছে। দোকানে বসে সে বেশ মজা পাচ্ছে। কিন্তু ছেলেকে নিয়ে চিন্তার শেষ নাই বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন মো. ফারুক।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরস্থ ওয়াইডব্লিউসিএ স্কুলে পড়ে সুজিত বনোয়ারীর দুই ছেলেমেয়ে। তিনি ভোরের আকাশকে জানান, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই। তাদের চেহারার দিকে তাকালে ভারি হয়ে উঠে মন। সন্তানদের ওপর চাপ দেয়ারও কিছু নেই। তারা নিজেদের মত করে লোক দেখানো পড়াশুনা করছে। পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ার অপেক্ষায় আছি বলে জানান সুজিত বনোয়ারী।

গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের অবস্থা আরো বেশি নাজুক হয়ে পড়েছে। চলাফেরায় স্বাধীনতা বেশি থাকায় ঘরে থাকছে না তারা। সারাদিন চলে দলবদ্ধভাবে আড্ডা। খাবার খেতে বাড়িতে হাজিরা দিয়েই ছুটে যায় পথে-প্রান্তরে।

ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার বিড়ইডাকুনী উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ে সাইফুল ইসলাম। তার মাতা আয়েশা খাতুন ভোরের আকাশকে জানান, দীর্ঘদিন ধরে বইয়ের সঙ্গে ছেলের সম্পর্ক নেই। সকালের নাস্তা শেষ করেই বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। অনেক সময় দুপুরের খাবার খেতেও আসে না। রাতে দেরিতে ঘুমায়। কিছু বলার চেষ্টা করলেই নানা যুক্তি তুলে ধরে। সারাদিন কোথায়, কী করে তা জানি না। ক্লাসে যাওয়া শুরু হলে এমন পরিস্থিতি থেকে রেহাই পেতাম বলে মনে করেন আয়েশা খাতুন।

শিক্ষার্থীরা অপূরণীয় ক্ষতির শিকার : শিক্ষাবিদরা বলছেন, চলতি বছর নানা কারণে অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হয়েছেন শিক্ষার্থীরা। এবার দুই ধাপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের শিক্ষা ও শিক্ষার্থীরা। কোটা আন্দোলনটি ছিল শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক। এই আন্দোলনে দেশের সকল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মানসিক সমর্থন ছিল। আন্দোলনকেন্দ্রিক পরিস্থিতিতে তাদের অনেকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। সহিংসতা ও হতাহতের ঘটনা তাদের কোমলমতি মনে আঘাত দিয়েছে। দীর্ঘদিনের অস্বাভাবিক অবস্থার জট কাটিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার পথে ছিল দেশের শিক্ষাদান কার্যক্রম। এমন সময়ে ঘটেছে কোটা আন্দোলনের অনাকাঙ্খিত বীভৎস ঘটনা। দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় লেখাপড়ার বাইরে রয়েছে শিক্ষার্থীরা। প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের মাঝে লেগেছে বড় ধরনের আঘাত। শিক্ষা থেকে মন উঠে যাচ্ছে তাদের অনেকের। বাসার বাইরে যেতে পারছে অধিকাংশ শিক্ষার্থী। বিশেষ করে প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যাযের শিক্ষার্থীরা। আর সহিংসতার কারণে কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদেরকেও বাসার বাইরে যেতে দিচ্ছেন না অভিভাবকেরা। বর্তমানে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের দায়িত্ব পালন করছেন শিক্ষার্থীরা। এভাবে তাদেরও শিক্ষার মানসিকতা উঠে যাচ্ছে।

শিক্ষাবিদ অধ্যাপক এ কে আজাদ বলছেন, গত সাত মাসে খুব বেশি শিক্ষা পায়নি শিক্ষার্থীরা। ঘন ঘন অরাজক পরিস্থিতিতে শিক্ষাগ্রহণের অনুকূল পরিবেশ পাচ্ছে না তারা। ফলে সীমাহীন ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। প্রয়োজনে সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্র ও শনিবার এবং যে কোনো সরকারি ছুটির দিনও ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করে ক্ষতি যতটা পুষিয়ে নেওয়া যায়, সেই চেষ্টাই করতে হবে।

শ্রেণি কার্যক্রমের পরিসর বাড়াতে হবে : শুধু শিক্ষার্থী নয়, শিক্ষকদের মনও ভালো নেই। তারা বলছেন, ক্লাস শুরু করতে আমরা প্রস্তুত আছি। যতই ক্লাস বন্ধ থাকবে তত বেশি আমাদের ওপর চাপ বাড়বে। ক্লাসে আসছে না শিক্ষার্থীরা। বারবার বন্ধের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকদেরও কষ্ট হবে। নতুন শিক্ষাক্রমে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। ১২ মাসের সিলেবাস কয়েক মাসে শেষ করানো সম্ভব হবে না। সংক্ষিপ্ত সিলেবাস দিয়ে বার্ষিক পরীক্ষা নেয়ার চিন্তাভাবনা করছেন শিক্ষকরা। বারবার বন্ধ হওয়ার প্রেক্ষাপটে শিখন ঘাটতির ধাক্কা কাটাতে যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে শ্রেণি কার্যক্রমের পরিসর বাড়ানোর পরামর্শ শিক্ষকদের। তারা সময় বাড়িয়ে অতিরিক্ত ক্লাস পরীক্ষা নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণে সরকার এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা পর্ষদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

ঢাকার শেরেবাংলা নগর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিধান কুমার সাহা বলেন, “এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষার্থীদের কষ্ট হবে। কারণ এখনকার লেখাপড়া কিন্তু পুরোটাই ক্লাস অ্যাক্টিভিটি বেইজড। সেটা করতে হলে স্কুল খোলা রাখার কোনো বিকল্প নেই। নানা রকম সমস্যায় আমরা বারবার পিছিয়ে যাচ্ছি।”

ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের সেন্ট এন্ড্রুস উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ললিত দ্রং ভোরের আকাশকে বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষকদেরও বাড়তি প্রস্তুতি নিয়ে পড়াতে হয়, সেক্ষেত্রে শনিবার স্কুল খোলা রাখলে শিক্ষকদের জন্য তা চাপ হয়ে যাবে। শুক্রবার ব্যক্তিগত কাজ করতে করতেই সময় চলে যায়। সপ্তাহে আমাদের ১২-১৩টা ক্লাস নিতে হয়। অনেক সময় শিক্ষক ঘাটতির কারণে অন্যান্য ক্লাসও নিতে হয়। এই ক্লাসগুলোর জন্য প্রস্তুতি নিতে হয়। আমার কাছে মনে হয়েছে, শনিবার স্কুল খোলা থাকলে শুধু নামেই ক্লাস হচ্ছে। ইফেক্টিভ ক্লাস নিতে হলে শিক্ষকদেরও টাইম দিতে হবে। আর প্রত্যন্ত এলাকার জন্য এটি আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং বলে জানান ললিত দ্রং।

 

ভোরের আকাশ/মি

 

 

মন্তব্য

Beta version