ছাত্র-গণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অভ্যন্তরীণ ও সমুদ্রগামী নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের জোর প্রতিশ্রুতি দিলেও এই খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের অদূরদর্শীতা এবং সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে আর্থিক ক্ষতিসহ বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হচ্ছে। সমুদ্রগামী জাহাজের নাবিকদের অত্যাবশ্যকীয় ‘ধারাবাহিক অব্যাহতিপত্র (কন্টিনিউয়াস ডিসচার্জ সার্টিফিকেট) বা সিডিসি’ প্রদানের ওপর অধিদপ্তরের অহেতুক অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় শত শত নাবিক চাকরিবঞ্চিত হয়েছেন। অধিদপ্তরের এই অদূরদর্শী সিদ্ধান্তে প্রতিবছর ৬০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স হারাচ্ছে বাংলাদেশ।
অন্যদিকে, জাল কাগজপত্রের ভিত্তিতে অযোগ্য বহু নাবিককে ‘পানামা সিডি’র বিপরীতে বাংলাদেশি সিডিসি প্রদান করায় বিদেশের অনেক সমুদ্রবন্দরে তারা অযোগ্যঘোষিত ও অবাঞ্ছিত হয়েছেন। বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানির জাহাজ থেকে চাকরিহারা এসব নাবিকের অনেকে দেশে ফিরে হতাশাগ্রস্ত জীবন কাটাচ্ছেন, আবার অনেকে ওইসব বন্দর থেকে পালিয়ে অন্য দেশে চলে গেছেন। এতে বহির্বিশে^ বিশেষ করে আন্তর্জাতিক মেরিটাইম সেক্টরে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে।
প্রাপ্ততথ্য মতে, নৌ অধিদপ্তরের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের প্রভাবে দীর্ঘদিন ধরে এসব অনিয়ম ও দুর্নীতি চলছে। এ সিন্ডিকেটের হোতা হলেন চলতি দায়িত্বপ্রাপ্ত চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার (সিএনএস) ক্যাপ্টেন মো. গিয়াসউদ্দিন আহমেদ। এ কাজে তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে আছেন অধিদপ্তরের অধীনস্থ সংস্থা চট্টগ্রামের বাংলাদেশ শিপিং অফিসের শিপিং মাস্টার জাকির হোসেন। এছাড়া একটি দালালচক্রের সঙ্গে গভীর সখ্য রয়েছে তার। সদ্যক্ষমতাহারা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১২ সালে চাকরিপ্রাপ্ত গিয়াসউদ্দিন গোপালগঞ্জের মকসুদপুরের বাসিন্দা; যার ক্ষমতার উৎস ছিল সাবেক মন্ত্রী ফারুক খান এবং পুলিশের সদ্যসাবেক অতিরিক্ত আইজিপি (স্পেশাল ব্রাঞ্চ) মনিরুল ইসলাম।
নৌ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা হয়ে পুলিশের সাবেক এই বড়কর্তাকে তার (সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি) কার্যালয়ে গিয়ে ফুলের তোড়া দিয়ে শুভেচ্ছা জানানোর ছবিও এ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে; যে ছবি অধিদপ্তরে নিজকক্ষে এতোদিন লেমিনেটিং করে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন গিয়াসউদ্দিন। এছাড়া অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থবলে নৌ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আশির্বাদও পেয়ে আসছেন তিনি। বিষয়টি বারবার তৎকালীন নৌ-প্রতিমন্ত্রীকে জানানো হলেও গিয়াসউদ্দিন সিন্ডিকেটের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে রহস্যজনকভাবে নীরব ছিলেন তিনি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সরকার অনুমোদিত বেসরকারি মেরিটাইম প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে পাস করা শত শত নাবিককে সিডিসি দেয়নি এই গিয়াস-জাকির সিন্ডিকেট। ফলে তারা চাকরিও পাননি। তবে তাদেরকে না দিয়ে অবৈধ আর্থিক সুবিধার নিয়ে অযোগ্যদের (পানামা সিডিসিধারী) সিডিসি প্রদান করা হয়েছে। সিডিসি প্রদানের নীতিমালা-২০১৮ এর অনুচ্ছেদ ৪ ও ৮ ভঙ্গ করে প্রি-সী স্পেশাল রেটিং কোর্স নামে নৌ অধিদপ্তরের অনুমোদিত কোনো কোর্স না থাকা সত্ত্বেও এবং অনাবাসিক প্রি-সীর স্পেশাল রেটিং কোর্স-২০২৩ চালু করে সম্পূর্ণ নীতিমালা বহির্ভুতভাবে জনপ্রতি ৭ লাখ টাকা করে নিয়ে প্রায় ২০০ জন অযোগ্য প্রার্থীকে সিডিসি প্রদানের জন্য মনোনীত করা হয়। এই মনোনয়ন কমিটির প্রধান ছিলেন ক্যাপ্টেন গিয়াস।
ঘটনা ফাঁস হলে গেলে নজরুল ইসলাম নামে এক সংক্ষুব্ধ নাবিক এবং বাংলাদেশ সিমেন্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শফিকুর রহমান বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে গিয়সউদ্দিন ও শিপিং মাস্টার জাকির হোসেনসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেন। হাইকোর্ট ২৭ মে স্পেশাল ব্যাচের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ প্রদানকে কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে বিবাদীদের ওপর রুল জারি এবং এদের সিডিসি প্রদানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এর আগে গত ৫ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি এম ডি নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী ইবাদত হোসেনের দ্বৈতবেঞ্চ দুর্নীতির ঘটনা তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) নির্দেশ দেন। কিন্তু তদন্তের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।
উচ্চ আদালত থেকে পাঠানো রিটের কপিতে বলা হয়, সরকার অনুমোদিত বেসরকারি মেরিটাইম ইনস্টিটিউট থেকে রেটিং কোর্স উত্তীর্ণ শত শত নাবিক সিডিসি না পাওয়ায় জাহাজে চাকরি পাচ্ছেন না। ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন নৌ অধিদপ্তরে চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার পদে যোগদানের পর থেকে দুর্নীতিবাজ শিপিংমাস্টার জাকির হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে নীতিমালা পাশ কাটিয়ে জনপ্রতি ৮ লাখ টাকা নিয়ে ১২৭ জনকে অবৈধ পন্থায়, আরামবাগ প্রেসে ছাপানো নকল পানামা সিডিসির অনুকূলে বাংলাদেশি সিডিসি প্রদান করেন। সেখান থেকে প্রায় ১০ কোটি টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে হাতিয়ে নেন। এসব ভুয়া পানামা সিডিসিপ্রাপ্তরা বিভিন্ন শিপিং এজেন্টকে টাকা দিয়ে জাহাজে ওঠার পর ইউরোপ আমেরিকার বিভিন্ন বন্দরে পালিয়ে যেয়ে দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন করেন। ফলে জাহাজ মালিকদের মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার জরিমানা দিতে হয়। এরপর জাহাজ মালিকরা তাদের জাহাজে বাংলাদেশি নাবিক নেওয়া নিষিদ্ধ করেন। কিছু নাবিক জাহাজে চাকরি করলেও তাদের কাজের মান খারাপ হওয়ায় জাহাজ মালিকরা পরবর্তীতে বাংলাদেশি নাবিকদের অদক্ষ বিবেচনায় নিষিদ্ধ করেন। এজন্য সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত বেসরকারি মেরিটাইম প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে সিডিসি পেলেও বিদেশি পতাকাবাহী জাহাজে চাকরি পাচ্ছেন না তারা। এভাবে প্রতি বছর প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছে বাংলাদেশ।
এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য নৌ অধিদপ্তরের চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার (চলতি দায়িত্বে) ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দীন আহমেদের মুঠোফোনে কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। এরপর এ প্রতিবেদক নিজের পরিচয় দিয়ে এবং কথা বলার কারণ জানিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে ক্ষুদেবার্তা পাঠান। কিন্তু ক্ষুদেবার্তার কোনো জবাবও দেননি তিনি। এরপর এ প্রতিবেদক মুঠোফোনে পুনরায় কল দেন তাকে। কিন্তু কল রিসিভ করেননি গিয়াস।
ভোরের আকাশ/মি
মন্তব্য