ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আবারো আলোচনায় উঠে এসেছে ‘আয়নাঘর’ নামের ভয়ংকর এক বন্দিশালার নাম। ক্ষমতার পালাবদলের পর সেখানে বহু বছর ধরে বন্দি থাকা তিনজন মুক্তি পেলে বন্দিশালাটির অস্তিত্ব সম্পর্কে যেমন নিশ্চিত হওয়া যায়, তেমনি সেখানকার লোকহর্ষক নির্যাতন ও অত্যাচার সম্পর্কেও জানেন বিশ্বাসী। আইনের তোয়াক্কা না করেই বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী ব্যক্তিদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় দিয়ে বাসা কিংবা কর্মস্থল থেকে তুলে নিয়ে তাদের কোনো ধরনের তথ্য না জানিয়ে আটকে রাখা হতো সেখানে। তিনজনের মুক্তির পর বহু বছর ধরে যাদের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না- তাদের পরিবার ও স্বজনেরা নতুন করে আশায় আছেন হয়তো এবার তারা হারানো স্বজনের খোঁজ পাবেন। তাদের দাবি, গুম, খুন, অত্যাচার, নির্যাতনে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের বিচার নিশ্চিত করার পাশপাশি স্বল্পতম সময়ের মধ্যে বন্দিদের সার্বিক তথ্য প্রকাশ করে তাদের মুক্তি দিতে হবে।
গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর কাউন্টার-টেরোরিজম ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (সিটিআইবি) দ্বারা পরিচালিত একটি গোপন আটক কেন্দ্রের নাম আয়নাঘর। ধারণা করা হয়, সেখানে অন্তত ১৬টি কক্ষ রয়েছে এবং একসঙ্গে ৩০ বন্দি রাখার সক্ষমতা রয়েছে। আয়নাঘরটি বাংলাদেশের ঢাকা সেনানিবাস এলাকায় অবস্থিত বলে ধারণা করা হয়।
সুইডেন ভিত্তিক স্বাধীন নিউজ পোর্টাল নেত্র নিউজের একটি অনুসন্ধানী হুইসেল ব্লোয়ার প্রতিবেদন প্রকাশ করে যেখানে অভিযোগ করা হয়, বাংলাদেশের কর্মকর্তারা আয়নাঘরে (আয়নাঘর) বলপূর্বক গুমের শিকারদের আটক ও নির্যাতন করছে। সুইডেন ভিত্তিক নিউজ পোর্টাল গোপন কারাগারের সম্ভাব্য অবস্থানও প্রকাশ করে, যেখানে বলপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের বাংলাদেশে রাখা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। প্রতিবেদনটি বলপূর্বক গুমের শিকার দুই ব্যক্তি হাসিনুর রহমান এবং শেখ মোহাম্মদ সেলিম-এর অন দ্য রেকর্ড অ্যাকাউন্টের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়, যেখানে তারা বলেছেন যে, তাদের ঢাকার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত কারাগারের ভিতরে রাখা হয়েছিল।
ভারতের জি নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে আয়নাঘর। শুনতে যতটা সাদামাটা ততটাই রহস্যময়। শেখ হাসিনার আমলে তৈরি এই আয়নাঘরেই রাখা হতো গুম করে রাখা মানুষদেরকে। আলো বাতাসহীন একটি কক্ষ। সেখানে সারাক্ষণ ঘড়ঘড়িয়ে চলে ফ্যান।
গণমাধ্যমের খবরে আরো বলা হচ্ছে, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বিরোধীদলের বহু নেতাকর্মী নিখোঁজ হন, বহু বছর পেরিয়ে গেলেও তারা কোথায় তার কোনো খোঁজ নেই। এমনকি সেনাবাহিনীর লোকজন রয়েছেন ওই তালিকায় বলে আলোচনায় রয়েছে। আয়নাঘর আসলে গোয়েন্দাদের একটি গোপন বন্দিশালা বা ডিটেনশন ক্যাম্প বলে অনেকেই ধারণা করে থাকেন।
আনন্দোবাজারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আয়নাঘর’ হচ্ছে ‘গুমখানা’। শেখ হাসিনার শাসনকালে ২০০৯ সাল থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সেখানে মোট ৬০৫ জনকে গোপনে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদে নিখোঁজ হন ৪০২ জন মানুষ। এ তথ্যটি প্রকাশ করে ঢাকা ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন অধিকার। ২০১৪ থেকে জুলাই ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ৩৪৪ জন ব্যক্তি গুমের শিকার হয়। তাদের মধ্যে ৪০ জন ব্যক্তিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়, ৬৬ জনকে সরকারি হেফাজতে গ্রেফতার অবস্থায় পাওয়া গেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে, ২০৩ জন এখনো গুম রয়েছেন।
আয়নাঘরে যারা বন্দি থেকেছেন বলে জানা যায়, তাদের মধ্যে রয়েছে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ মোবাশার হাসান, সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান, ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ কুমার রায়সহ অনেকেই রয়েছেন যারা কখনো মুক্তি পেলেও সেখানকার পরিবেশ সম্পর্কে কিছু বলতে রাজি হননি।
সম্প্রতি ঢাকার নিউ মার্কেট থানার একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার চাকরিচ্যুত সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান রিমান্ড শুনানিতেও কথা বলেছেন ‘আয়নাঘর’ নিয়ে। অভিযোগ করেন, আটকের পর থেকে তাকেও রাখা হয়েছিল এমন এক বন্দিশালায়। তার বিরুদ্ধে আনা হত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে শুক্রবার বিকেলে ওই মামলায় আদালতে নেওয়া হলে রিমান্ড শুনানিতে তিনি বলেন, আমি এনটিএমসির প্রধান ছিলাম। এটি একটি নিরস্ত্র সংস্থা। আমি কীভাবে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকি।
আদালতে প্রায় ৩৫ মিনিটের শুনানিতে উভয়পক্ষের বক্তব্য শুনে টেলিযোগাযোগ নজরদারির জাতীয় সংস্থা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) চাকরিচ্যুত মহাপরিচালক জিয়াউলকে আট দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন বিচারক। শুনানিতে জিয়াউল আহসান নিজেকে ‘নির্দোষ’ দাবি করলেও আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে তার বিরুদ্ধে গুম, খুন, নির্যাতন ও ‘আয়নাঘরের’ সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আনেন আইনজীবী মোহাম্মদ উল্লাহ খান জুয়েল। আইনজীবীর অভিযোগ, এ আসামি (জিয়াউল) ‘আয়নাঘরের’ একজন প্রবক্তা। তিনি গুম-খুন ও বিগত সরকারের বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গী। তার মতো কতিপয় অফিসারের কারণে আওয়ামী সরকার স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। এই বাংলাদেশ হয়ে যায় আফগানিস্তানের মতো।
এরপর ‘আয়নাঘরের’ সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততা ও অন্যান্য অভিযোগ অস্বীকার করেন জিয়াউল আহসান। বিচারকের অনুমতি নিয়ে শুনানিতে তিনি বলেন, আমি নিজেই আয়নাঘরের বিরোধী। আমাকে গত ৭ (আগস্ট) তারিখ রাতে সেনাপ্রধানের কথা বলে আমার সহকর্মীরা নিয়ে আসেন। আমি নিজেই গত সাত-আট দিন ‘আয়নাঘরে’ আটক ছিলাম।
বহু বছর বন্দি থাকার পর সম্প্রতি আয়নাঘর থেকে ছাড়া পান বাংলাদেশী ব্যারিস্টার এবং জামায়াতে ইসলামী নেতা মীর কাসেম আলীর ছেলে মীর আহমদ বিন কাসেম, সাবেক সামরিক জেনারেল এবং জামায়াতে ইসলামী নেতা গোলাম আযমের ছেলে আবদুল্লাহিল আমান আজমি, পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সংগঠন ইউপিডিএফের মুখপাত্র মাইকেল চাকমা। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ এইসব ঘটনার জন্য জাতিসংঘ ও বিভিন্ন মানবাধিকার রক্ষাকারী সংস্থা, যেমন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারকে নিন্দা প্রস্তাব জানায়।
২০১৬ সালে জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর ছেলে ব্যারিস্টার আহমদ বিন কাসেমকে (আরমান) গুম করা হয়। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ‘আয়নাঘর’ নামে গোপন কারাগারে। যেখানে তিনি দীর্ঘ আট বছর বন্দি ছিলেন। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর চোখ বেঁধে, হাতকড়া পরিয়ে গত আট বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো গোপন কারাগার থেকে বের করা হয় ব্যারিস্টার আহমদ বিন কাসেমকে। ৪০ বছর বয়সি আহমেদকে একটি গাড়ি থেকে ঢাকার উপকণ্ঠে একটি কর্দমাক্ত খাদে জীবিত ফেলে দেওয়া হয়। তিনি গণমাধ্যমকে জানান, আট বছরে এই প্রথম আমি তাজা বাতাস পেলাম। আমি ভেবেছিলাম ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।
আট বছরের অন্ধকার জীবনের সেই ভয়াল অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন তিনি। যে সময়টা তাকে দুর্বিষহ যন্ত্রণাদায়ক সময় পার করতে হয়েছে। সেই সময়ের অত্যাচার, নির্যাতন যেন কল্পনাকেও হার মানায়। সেই দিনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে আরমান বলেন, আমার কাছে মনে হয়েছিল, আমি জীবন্ত অবস্থায় কবরের মধ্যে থাকছি। আমি যদি জানতাম, আমার সঙ্গে এই আচরণ করা হবে, তাহলে আমি দুটি মেয়েকে একটু আদর করে দিয়ে আসতাম। আমি এতো দ্রুত আলাদা হয়ে যাব, চিন্তাও করতে পারিনি।
ব্যারিস্টার আরমান বলেন, আমি রাতভর কাটিয়েছি, বন্দিদের কান্নার আওয়াজে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকে শিশুর মতো চিৎকার করতে শুনেছি আমি। মানুষের চিৎকার ও নির্যাতনের আওয়াজে আমি বহু রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। এমন কথাও আমার কানে আসতো, মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করছে। কয়েকজন বন্দি খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। তাদের হাত-পা বেঁধে নাকের নল দিয়ে খাওয়ানো হয়েছে। খাওয়া বন্ধ করে দেওয়ায় মৃত্যুর আশঙ্কা হতো, তখন তাদের ভিটামিন ইনজেকশন দেওয়া হতো; মৃত্যু যাতে না হয়। বন্দিদের মৃত্যুর চেয়ে এক খারাপ অভিজ্ঞতা দেওয়া হয়।
২০১৬ সালের ২২ আগস্ট রাতে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির প্রয়াত গোলাম আজমের মেজো ছেলে সেনাবাহিনীর সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আজমীকে তুলে নেওয়া হয়। সে সময় জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০১৬ সালের ২২ আগস্ট রাত ১২টার দিকে রাজধানীর বড় মগবাজারের বাসা থেকে সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে তাকে আটক করা হয়েছে। পরে আবদুল্লাহিল আমান আযমীকে সেনাবাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক অব্যাহতি দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। তবে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে আটকের বিষয়টি একাধিকবার দাবি করা হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে তা অস্বীকার করা হয়।সরকার পতনের পর দীর্ঘ আট বছর ‘আয়নাঘর’ থেকে মুক্তি পেয়ে তার সঙ্গে ব্যাগে থাকা একটি গামছা বের করে আজমী বলেন, এই গামছাটি আমি নিয়েছিলাম নামাজ পড়ার জন্য কিন্তু এটা দিয়ে যে পরিমাণ চোখের পানি আমি মুছেছি তা দিয়ে একটি দীঘি বানানো যেত। তার কাছে থাকা পবিত্র কুরআন খুলে দেখিয়ে তিনি বলেন, আট বছর এ কুরআন পড়েছি। এটা অনেক ছিড়ে গেছে। এটাই অনেক জোড়া-তালি নিজেই দিয়েছি।
গুম হয়ে যাওয়া পরিবারের সদস্যরা ‘মায়ের ডাক’ নামে একটি প্লাটফর্ম তৈরি করেন। সেখানে যাদের পরিবারের সদস্যরা বাংলাদেশে ২০০৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের শাসনামলে সরকারি সংস্থা কর্তৃক বলপূর্বক গুমের শিকার হয়েছেন তারা রয়েছেন। সংগঠনের সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম ভোরের আকাশকে বলেন, এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব ‘আয়নাঘরে’ এখনো যারা আছেন তাদের সার্বিক তথ্য প্রকাশ করে তাদেরকে নিরাপদে স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া। পাশাপাশি আমরা দাবি করছি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানসহ যারা গুম, খুন, হত্যা, নির্যাতনে জড়িত তাদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে সর্Ÿোচ্চ সাজার ব্যবস্থা করতে হবে।
ভোরের আকাশ/মি
মন্তব্য