শ্রাবণেই ‘বসন্ত’ নেমে এসেছে বাংলায়। তারুণ্যের রক্তে রাঙা বসন্তের ফুল আজ রঙে রঙিন। ‘আমার দেশের ছাত্রছাত্রী পারমাণবিক বোমার চেয়ে শক্তিশালী’। এমন তো তাঁরা লিখতেই পারেন। কারণ, সেই শক্তির প্রকাশ তাঁরা ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১ সালে দেখিয়েছেন। দেখিয়েছেন ১৯৯০ সালে। আবার দেখালেন ২০২৪ সালে।
দেশ মেরামতের কাজ করছেন তরুণরা। তাদের হাতেই নতুন করে গড়ে উঠছে বাংলাদেশ। বিপ্লবের মুষ্টি ছেড়ে তারা হাতে তুলে নিয়েছেন রং-তুলি। নতুন করে সাজাচ্ছেন অগোছালো দেয়ালগুলো। ঢাকাসহ সারা দেশে শিক্ষার্থী ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মীরা দল বেঁধে দেয়ালে নানা লেখা মুছে ফেলে সেখানে আঁকছেন ছাত্রজনতার আন্দোলন ঘিরে গৌরবময় নানা গ্রাফিতি। বিপ্লবের মুষ্টি ছেড়ে তারা হাতে তুলে নিয়েছেন রং-তুলি। নতুন করে সাজাচ্ছেন অগোছালো দেয়ালগুলো।
টা সংস্কার আন্দোলনের নানান স্লোগান, আন্দোলনের নানান চিত্র, রাষ্ট্র সংস্কারের গ্রাফিতি, অসাম্প্রদায়িক বাংলার নানান দৃশ্য এখন ছড়িয়ে পড়েছে দেয়ালে দেয়ালে। সড়কে চোখ মেললেই নতুন বাংলাদেশের প্রতিবাদ কাব্য।গ্রাফিতিতে নতুন বাংলাদেশের গল্প ফুটে উঠছে যে গল্পে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে। গ্রাফিতি আর্টে জায়গা করে নিয়েছে, আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়, বাসায় আমার বোন আছে, আর আবু সাঈদের বীরত্বের গল্প-এমন কতো কতো কথা।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, স্বাধীন ও রঙিন দেশ বাংলাদেশ। সেই রং ফিরিয়ে দিতেই গ্রাফিতি করা হচ্ছে। তাদের মতে, সহপাঠীদের ত্যাগ যেনো ভূলুণ্ঠিত না হয় সেজন্যই স্মৃতি ধরে রাখার চেষ্টা। সেই সঙ্গে দেখতে চান অরাজকতা মুক্ত নতুন এক বাংলাদেশ।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন সরকার বদলের সাথে বদলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন দেয়ালের রুপ। দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে প্রতিবাদ, দেশপ্রেম, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধের বার্তা। সকালে ঘুরে দেখা যায় শিক্ষার্থীরা দেয়ালে গ্রাফিতি ও প্রতিবাদী কণ্ঠে দেয়াল লিখনে রং তুলিতে মেতে উঠেছে। কেউ কেউ দেয়াল পরিষ্কার করছে আবার কেউ কেউ রং মিশানোর কাজ করতে।
শিক্ষার্থীদের কাঁচা হাতের লেখা আর আলপনাতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ হওয়া ছাত্র-জনতার স্মৃতি ও বিজয়ের চিহ্ন ভেসে উঠেছে শহরের অলিগলির দেয়াল গুলোতে। 'পানি লাগবে পানি’, ‘স্বাধীন করেছি, সংস্কারও করবো’, ‘আমিই বাংলাদেশ’, ‘আপনি কখনো মনে করবেন না যে, জালিমরা যা করে সে বিষয়ে আল্লাহ উদাসীন’, তোর কোটা তুই ফেরত নে, আমার ভাইকে ফেরত দে, দ্বিতীয় স্বাধীনতা ৩৬ শে জুলাই"। এসব অসংখ্য লিখনী ও চিত্রাঙ্কনে ভরে গেছে গোটা দেশ। প্রতিটি দেয়াল এখন রং তুলির রঙে রঙিন।
শিক্ষার্থীরা জানান, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর সারা দেশে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অংশ হিসেবে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বাসা বাড়ির দেয়ালে রং-তুলির আঁচড়ে দেয়াল সাজাতে শুরু করেছেন তারা। বিভিন্ন বয়সি শিক্ষার্থীরা দেয়াল অঙ্কনে অংশ নিচ্ছে । একইসঙ্গে ছাত্র-জনতার বিজয়ের বিভিন্ন প্রতীকী ছবিও আঁকা হয়েছে।
ছাত্র-জনতার বিক্ষোভে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর রাজধানীর মুগদা, কমলাপুর, বাসাবো, শাহজাহানপুর, খিলগাঁও রেলগেইট, রাজারবাগ, ফকিরেরপুল, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, নিউ বেইলি রোড, মিন্টো রোড, সায়েন্স ল্যাবরেটরিসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্রাফিতি চোখে পড়ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বহু ভবনের দেয়াল, সীমানাপ্রাচীর, সড়কদ্বীপ, মেট্রোরেলের স্তম্ভ, উড়ালসড়কের স্তম্ভে গ্রাফিতি আঁকছেন শত শত শিক্ষার্থী। তাঁরা নিজেরাই অর্থ জোগাড় করে রং ও আঁকার সরঞ্জাম কিনে মেতে উঠেছেন দেয়াল পরিষ্কার করে গ্রাফিতি লেখাসহ নানা পঙ্ক্তি লেখার কাজে। এসব গ্রাফিতিতে অভ্যুত্থানে প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের প্রতিকৃতি ও তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধার পাশাপাশি উঠে এসেছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি, সমাজের-রাষ্ট্রের সংস্কার, ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ করা, স্বৈরতন্ত্রের অবসান, বাক্স্বাধীনতা, সম-অধিকার থেকে শুরু করে সব রকমের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ আর প্রতিরোধের অগ্নিময় উক্তি। এসেছে বহু কালজয়ী গান ও কবিতার পঙ্ক্তি। আছে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নের কথাও।
সাতমসজিদ রোডের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দেয়ালে এক গ্রাফিতিতে কালোবাজারি সিন্ডিকেটের প্রতি হুঁশিয়ারি দিয়ে লেখা হয়েছে, ‘শোনো মহাজন আমি নই তো একজন/ শোনো মহাজন আমরা অনেকজন’ নিচে অনেক হাতের পাঞ্জার ছাপ।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতিসহ লেখা, ‘এসো ১ হই’, ‘রুখে দাঁড়াও স্বৈরাচার’, ‘ধর্ম যার যার দেশ সবার’, ‘দেশ গড়ব করছি পণ/ ক্ষমতায় আজ জনগণ’ ‘দুর্নীতির গদি নয়, নতুন আলো দেখতে চাই’, ‘স্বাধীনতা এনেছি সংস্কারও আনব’। কোনো গ্রাফিতিতে আঁকা দৃঢ় মুষ্টিবদ্ধ হাত, উদ্যত তর্জনী, কোনোটিতে ছিন্ন করা শিকল এমন নানা কিছু।
দেয়ালের লেখা আর ছবি দৃষ্টি আকর্ষণ করছে সবার। নিউ এলিফ্যান্ট রোডে এমনই দেয়াললিখন পড়ছিলেন এই সড়কের একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক মোবারক হোসেন। দেয়ললিখনগুলো কেমন হলো, জানতে চাইলে বললেন, ‘আমি এসব দাবির সঙ্গে শতভাগ একমত।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোড এলাকায় অর্থনীতি বিভাগের সায়মা বিনতে কুদ্দুসের নেতৃত্বে গ্রাফিতি আঁকছিলেন ইশরাত জাহান, আবরার হাফিজসহ অনেকে। তাঁরা বললেন, ‘আমাদের দাবিগুলো যেন হারিয়ে না যায়, এ জন্যই দেয়ালে লিখে রাখা হচ্ছে।’ দেয়ালে একটি গ্রাফিতিতে দেখা যাচ্ছে, মাইক্রোফোন ধরা হাতে ছবিতে লেখা, ‘কণ্ঠ ছাড়ো জোরে’। টিএসসি মিলনায়তনের দেয়ালের একটি গ্রাফিতিতে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিচ্ছে, ‘বিকল্প কে? আমি, তুমি, আমরা’।
উপাচার্যের বাসভবনের দেয়ালে লেখা, ‘ঘুষ চাইলে ঘুষি’, ‘নতুন দিনের নতুন সূর্য/ জাগ্রত হোক বাংলাদেশ’, ‘শিক্ষক রাজনীতি নিপাত যাক, মেধা পাচার থেমে যাক’, ‘ছাত্ররাজনীতি নিপাত যাক, শিক্ষাঙ্গন মুক্তি পাক’। ফুলার রোডের শিক্ষকদের আবাসিক এলাকার দেয়ালে লেখা ‘চলো রাষ্ট্র সংস্কার করি’, ‘অরুণ প্রাতের তরুণ দল’, ‘মনে হয় রক্তই সমাধান বারুদই অন্তিম তৃপ্তি’। এমন নানা উক্তিসহ অজস্র গ্রাফিতিতে বর্ণিল সারা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা।সায়েন্স ল্যাবরেটরির দেয়ালে একটি গ্রাফিতিতে প্রশ্ন করা হয়েছে, ‘স্বাধীন বাংলাদেশে কেউ গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে চাঁদা চাইলে কী করব?’ উত্তর, ‘না বলব, সকলে মিলে রুখে দাঁড়াব’।
বাংলাদেশের মানচিত্রের সামনে দুই হাত প্রসারিত করে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সাহসিকতার প্রতীক আবু সাঈদ। পাশে লেখা, ‘বল বীর চির উন্নত মম শির’। দেখে মনে হয় যেন আবু সাঈদের জন্যই বিদ্রোহী নজরুল এই অমর পঙ্ক্তি রচনা করেছিলেন। কারণ, শহরে পথে পথে বহু গ্রাফিতিতে দেখা যাচ্ছে আবু সাঈদকে সশ্রদ্ধ স্মরণ জানাতে তরুণ প্রজন্ম স্মরণ করেছে কবির এই অবিস্মরণীয় পঙ্ক্তি। আরও আছে মীর মুগ্ধর প্রতিকৃতি। গ্রাফিতিতে পানির বোতলের নামও হয়ে গেছে ‘মুগ্ধ পানি’। নিউ বেইলি রোড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, উত্তরা অনেক এলাকার গ্রাফিতিতে এসেছে, মুগ্ধ এসেছে পানির বোতলের প্রতীক হয়ে। মুগ্ধ পানি নিয়ে গিয়েছিলেন রাজপথে, বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের তৃষ্ণা মেটাতে। গুলিতে প্রাণ হারান মুগ্ধ।
ধানমন্ডি ৭/এ সড়কের স্কলার্স স্কুলের ফটক আছে ‘মুগ্ধ পানি’র গ্রাফিতি। মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের সড়কদ্বীপ আর পাশের ভবনের দেয়াল গ্রাফিতিতে ভরিয়েছেন ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভের (ইউডা) চারুকলার শিক্ষার্থীরা। এখানে একটি গ্রাফিতিতে টেলিভিশনের পর্দায় লেখা দাবি, ‘বাক স্বাধীনতা’, পাশে লেখা, ‘নতুন বাংলাদেশ গড়ব মোরা, জেন-জেড’। গ্রাফিতিতে পতাকা হাতে সবার আগে আছেন আবু সাঈদ, আসছেন মিছিল নিয়ে। তাঁর সঙ্গে আছে আন্দোলনে প্রাণ হারানো প্রিয়, ফায়াজ, তামিম, হৃদয়, ইফাজ, ওমর শুভ,শান্ত, রাসেল, সোহাগ, ফয়েজ, আকাশের নাম। আরও আছে মাথায় লাল ফিতায় ঝুঁটি করা রিয়া গোপের (৬) ছবি। আরেকটি গ্রাফিতিতে দেখা যাচ্ছে, অজ্ঞাতনামা শহীদদের স্যালুট দিচ্ছে তরুণ প্রজন্ম।
বেইলি রোডের দেয়ালে লেখা, ‘সব মানুষের স্বপ্ন তোমার, চোখের তারায় সত্যি হোক/ আমার কাছে দেশ মানে, এক লোকের পাশে অন্য লোক’, মিন্টো রোডে আছে, ‘ন্যায়ের সাথে জনতা অন্যায় হলেই একতা’। এখানে গ্রাফিতি আঁকছেন শিক্ষার্থীদের ফেসবুক গ্রুপ ‘আমরা ফাউন্ডেশন’-এর শিক্ষার্থীরা। এই দলের একজন সমন্বয়ক বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজের উচ্চমাধ্যমিক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী তাকবীর তাহরীম। তিনি জানালেন, তাঁদের দলে নটর ডেম, ভিকারুননিসা নূন, সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুল ও কলেজ, আদমজী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শতাধিক শিক্ষার্থী কাজ করছেন। তাঁরা মতিঝিল, ফকিরাপুল, নটর ডেম কলেজ, আইডিয়াল স্কুল, নিউ বেইলি রোড, সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় গ্রাফিতি আঁকছেন।
মিরপুর কাজীপাড়া এলাকায় মেট্রোরেলের স্তম্ভে আঁকা ফুলবাগানের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে পাখির ঝাঁক। লেখা, ‘আঁধারে ভয় পেয়ো না আলো আছে আড়ালে/ আঁধার কেটে যাবে তুমি উঠে দাঁড়ালে’। কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর এলাকায় উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাশন ডিজাইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী বর্ণা আসলামের নেতৃত্বে গ্রাফিতি আঁকছেন শান্ত-মারিয়াম ক্রিয়েটিভ বিশ্ববিদ্যালয়, বিইউবিটি, মিরপুর কমার্স কলেজের একদল শিক্ষার্থী। বর্ণা জানালেন, তাঁদের একটি বড় দল চার দিন থেকে মিরপুর এলাকা এবং উত্তরার মাসকট প্লাজা ও হাউস বিল্ডিং এলাকায় গ্রাফিতি আঁকার কাজ করছেন।
অনেকে দিনপঞ্জিকার মতো করে গ্রাফিতি এঁকেছেন। জিগাতলার ডেসকো কার্যালয়ের সামনের দেয়ালে এমন একটি গ্রাফিতিতে বিভিন্ন তারিখের ঘরে কোনোটিতে আছেন আবু সাঈদ, কোনো তারিখে মুগ্ধ, কোনো দিন ‘বাংলা ব্লকড’ উঠে এসেছে। সাতমসজিদ রোডের গ্রাফিক আর্টস ইনস্টিটিউটের প্রাচীরে একটি গ্রাফিতিতে দিনপঞ্জিকার গণ-অভ্যুত্থানের দিনগুলো আঁকা হয়েছে লাল রঙের হরফে। এই লাল রঙের দিনগুলো স্মরণীয় হয়ে থাকবে ইতিহাসে, গণমানুষের স্মৃতিতে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শক্তি, সাহস ও প্রেরণা হয়ে।
ভোরের আকাশ/মি
মন্তব্য