ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সব চেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে পুলিশ। বিভিন্ন স্থানে থানা ও ফাঁড়িতে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও অস্ত্র লুট করেছে দুর্বৃত্তরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে অনেকে অস্ত্র জমা দিয়েছেন। কিন্তু এখনো অনেক অস্ত্র জমা হয়নি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এসব অস্ত্র অপরাধে ব্যবহার করা হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে প্রয়োজনে যৌথ অভিযান পরিচালনা করা যেতে পারে বলেও কেউ কেউ মনে করছেন। কতগুলো অস্ত্র লুট হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান পুলিশ জানাতে পারছে না। তবে অস্ত্রগুলো উদ্ধার করা যাবে বলে আশা করছে এই বাহিনী।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সারা দেশের বহু থানা, পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা, অগ্নিসংযোগের পাশপাশি অস্ত্র লুটের ঘটনা ঘটে। কোনো কোনো থানায় দীর্ঘদিন ধরে সংরক্ষিত গুরুত্বপূর্ণ নথি ও মামলার আলামত ধ্বংস হয়ে গেছে। এক পর্যায়ে পুলিশের নন-ক্যাডার সদস্যরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে নিজেদের নিরাপত্তার কথা তুলে ধরে ১১ দফা দাবিতে কর্মবিরতিতে যান। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে শিক্ষার্থীরা কাজে নামলে ট্রাফিক পুলিশ শূন্য হয়ে পড়ে সড়ক-মহাসড়ক। পরে সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নিয়ে মতবিনিময়সহ নানা ধরনের পদক্ষপ নেয়। ফলে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসতে থাকে পুলিশের কার্যক্রম। লুট হওয়া অস্ত্র ফিরে পেতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে তৎপরতাও চালতে থাকে। এরই মধ্যে অনেকেই অস্ত্র জমা দিয়ে পুলিশকে সহযোগিতাও করে।
৯ অগাস্ট আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন থানা ও কারাগার থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুটপাটের কিছু ঘটনা ঘটে। এক্ষেত্রে কারও কাছে রক্ষিত এ ধরনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ অথবা এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য থাকলে দ্রুত নিকটস্থ সেনাক্যাম্পে জমা অথবা যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা হলো। অন্যদিকে পুলিশের পক্ষ থেকেও লুট হওয়া অস্ত্র নিকটস্থ থানায় জমা দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তর থেকে জানা গেছে, ১৯ আগস্ট পর্যন্ত তারা সারাদেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের ৮২৬টি অস্ত্র উদ্ধার করেছে। এছাড়া ২০ হাজার ৭৭৮ রাউন্ড গুলি, ১ হাজার ৪৮২টি টিয়ার শেল ও ৭১টি সাউন্ড গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়েছে। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নও (র্যাব) পুলিশের থানা, ফাঁড়ি থেকে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করেছে। র্যাব সদর দপ্তরের তথ্য বলছে এখন পর্যন্ত তারা উদ্ধার করেছে ৯৭টি অস্ত্র; ৬ হাজার ৫৮৫ রাউন্ড গোলাবারুদ ও ২৮টি ম্যাগজিন।
লুট হওয়া অস্ত্র নিয়ে যে শঙ্কা : ক্ষমতার পালাবদলের পর ফেনী মডেল থানা থেকে লুট হওয়া একটি পিস্তল বিক্রির সময় ধরা পড়েন মো. রুবেল (২৯) নামে এক যুবক। এসময় পিস্তলটি উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ জানায়, ১৪ অগাস্ট রাতে ফেনী শহরের শাহীন একাডেমি এলাকায় এক ক্রেতার সঙ্গে দরকষাকষির সময় পিস্তলসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়েন রুবেল। শুধু একটি নাইন এমএম পিস্তল নয়, রুবেলের কাছ থেকে ১৪ রাউন্ড গুলি ও দুটি ম্যাগাজিনও উদ্ধার করা হয়। ফরিদপুরের সদরপুর থানা থেকে লুট করা অস্ত্র নিয়ে তিন বন্ধু টিকটক ভিডিও করতে গিয়ে ‘অসাবধানতাবশত’ গুলিবিদ্ধ হয়ে পলাশ হোসেন (১৮) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়। গত ১২ অগাস্ট ঢাকা নিউরো সায়েন্স হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান পলাশ। গত ৬ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হন তিনি।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা : পুলিশের সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা ভোরের আকাশকে বলেন, লাইসেন্স ছাড়া অস্ত্র কারো কাছে থাকাই নিরাপদ নয়। সেটি ব্যক্তিগত শত্রুতা থেকে শুরু করে নানা ধরনের অপরাধে ব্যবহার হতে পারে। পুলিশের থানা ও ফাঁড়ি থেকে যে অস্ত্রগুলো লুট হয়েছে; সেগুলো খুব শিগগিরই উদ্ধার করা দরকার। পাশাপাশি অস্ত্র জমা দেওয়ার সময়ও নির্ধারণ করা হয়েছিল। সেই সময়ের মধ্যে কেউ অস্ত্র জমা না দিলে তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. সাবের আহমেদ চৌধুরী ভোরের আকাশ’কে বলেন, পুলিশের যে অস্ত্রগুলো লুট হয়েছে; সেগুলো উদ্ধার হওয়া দরকার। তা না হলে খুব স্বাভাবিকভাবেই সেগুলো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার হতে পারে। অস্ত্রগুলো নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ফেরত না এলে সেগুলো উদ্ধারে প্রয়োজনে যৌথ অভিযান পরিচালনা করা যেতে পারে। কারণ, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার হওয়ার আগেই সেগুলো উদ্ধার করা প্রয়োজন।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারপার্সন শাহারিয়া আফরিন বলেন, অস্ত্র লুটের বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। যতদিন পর্যন্ত না সেগুলো যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়া হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত একটা শঙ্কা থেকেই যায়। তাই একজন শিক্ষক হিসেবে মনে করি যে বা যারাই অস্ত্রগুলো নিয়েছেন; দেশের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তারা সেগুলো আবারো জমা দিয়ে দেবেন।
পুলিশের প্রচেষ্টা অব্যাহত : লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের এআইজি ইনামুল হক সাগর বলেন, বিষয়টি পুলিশের পক্ষ থেকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হচ্ছে। অস্ত্রগুলো উদ্ধারে পুলিশ তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
ভোরের আকাশ/মি
মন্তব্য