দেশের প্রতিটি নাগরিকের মাথায় এখন এক লাখ ৯ হাজার টাকার ঋণ। এমনকি আজ যে শিশুটি জন্ম নিয়েছে, তার নামেও রয়েছে এই পরিমাণ ঋণের বোঝা। দেশের নাগরিকদের ঋণে জর্জরিত করে গেছে ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা সরকার। আর এসব-ই হয়েছে কথিত উন্নয়নের অজুহাতে। গত ১৫ বছরে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে সাড়ে ১৮ লাখ কোটি টাকা ঋণ করেছে বিদায়ী হাসিনা সরকার। ঋণ করে ঘি খেয়েছে ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা সরকার। তবে দেশের বেজেছে বারোটা। ভয়াবহ ঋণের ফাঁদে দেশ।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের তথ্যের দিকে নজর দিলে যে কারো চোখ কপালে উঠবে। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে যখন শেখ হাসিনা সরকার দায়িত্ব নেয়, তখন দেশি-বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। মাত্র ১৫ বছরের ব্যবধানেই সেই ঋণ এখন প্রায় ১৮ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। উন্নয়নের নমে ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা সরকার প্রতিটি নাগরিকের মাথায় চাপিয়েছে ১ লাখ ৮ হাজার ৮শ টাকার ঋণ। জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া এই ঋণের ১০ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে দেশীয় উৎস থেকে। আর বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে বিদায়ী হাসিনা সরকার নিয়েছে প্রায় ৮ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ জুন পর্যন্ত স্থানীয় মুদ্রায় দেশের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেওয়া হয়েছে ৮৮ বিলিয়ন ডলার বা ১০ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি এবং বাকি ৬৮ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকা বিদেশি ঋণ। এই বিশাল ঋণ কীভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করছে তা বুঝতে হলে প্রস্তাবিত বাজেটের দিকে তাকাতে হবে। চলতি অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সুদ পরিশোধ বাবদ ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা বা ১৪ দশমিক ২ শতাংশ রাখা হয়েছে। এই অঙ্ক ৮ লাখ কোটি টাকার বেশি ব্যয় রাখা খাতগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। অর্থনীতিবিদরা বিপুল ঋণের জন্য খরচ বৃদ্ধি ও মেগা প্রকল্পে দুর্নীতির কারণে স্থবির হয়ে পড়া রাজস্বকে দায়ী করেছেন।
এদিকে সরকার টানা তিন মেয়াদে মোট ব্যয় করেছে প্রায় ৫৪ লাখ কোটি টাকা এবং রাজস্ব আয় হয়েছে মাত্র ৩৭ লাখ কোটি টাকা। সরকারের ব্যয় ২০০৮-০৯ অর্থবছরের ৯৪ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে ৭ লাখ কোটি টাকা হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত ৯ শতাংশের আশপাশে ঘোরাফেরা করছে, যা বিশ্বের সর্বনিম্ন একটি। এজন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) সংস্কার উদ্যোগের অভাব, কর ফাঁকি ও বিভিন্ন গ্রুপকে বিপুল পরিমাণ কর ছাড় দেওয়াকে দায়ী করেন অর্থনীতিবিদরা।
এছাড়া বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে দুর্নীতি ধারাবাহিকভাবে রাজস্ব-ব্যয়ের ব্যবধান বাড়াচ্ছে বলে মনে করেন কয়েকজন শীর্ষ অর্থনীতিবিদ। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, মেগা প্রকল্পগুলোর অধিকাংশই দুর্নীতিতে আচ্ছন্ন। তিনি বলেন, এ দেশে বড় প্রকল্প মানে বড় দুর্নীতি। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে দেশীয় ঋণ নিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছে। কিন্তু কর্তফুলী টানেল ও নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য অর্থ বিদেশি উৎস থেকে এসেছে। তিনি বলেন, ব্যয় বাড়িয়ে প্রকল্পগুলোতে দুর্নীতি করা হয়েছে। রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, প্রকল্পগুলোতে অনেক অপ্রয়োজনীয় বিষয় যোগ করা হয়েছে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান ঋণ বৃদ্ধির পেছনে অন্যতম অভ্যন্তরীণ সম্পদ সচল করতে সরকারের ব্যর্থতাকে দায়ী করেছেন। সেলিম রায়হান বলেন, গত এক দশক বা তার বেশি সময় ধরে সরকার রাজস্ব আদায় বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি জানান, দ্বিতীয়তÑ ঋণ নেওয়ার কার্যক্রমে দুর্নীতি হয়েছে, বিশেষ করে বিদেশি অর্থায়নে মেগা প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে। তার ভাষ্য, স্বার্থান্বেষী একটি গোষ্ঠী বিদেশি ঋণনির্ভর মেগা প্রকল্পগুলোকে কাজে লাগিয়ে একাধিকবার প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়েছে।
উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে ঋণ নিতে হবে, কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারের স্বল্পমেয়াদি ঋণের পাশাপাশি উচ্চ সুদে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা ছিল। বছরের পর বছর ধরে সরকারের এই প্রবণতা বেড়েছে। অথচ সহজ শর্তসহ স্বল্প সুদে ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণের দিকে নজর দেওয়া উচিত ছিল। ক্রমবর্ধমান ঋণ, কম কর ও রপ্তানি আয়ের কারণে বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধ-রাজস্ব অনুপাত প্রথমবারের মতো ১০০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এটি দেশের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতার ক্রমবর্ধমান ঝুঁকিকে সামনে আনে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ অর্থবছরে ঋণ পরিশোধ-রাজস্ব অনুপাত ৫৮ দশমিক ৭ শতাংশ থাকলেও ২০২২ অর্থবছরে তা বেড়ে হয় ৭২ শতাংশ এবং ২০২৩ অর্থবছরে তা দাঁড়িয়েছে ৭১ দশমিক ৮ শতাংশে। চলতি অর্থবছর এই অনুপাত ১০১ দশমিক ১ শতাংশে পৌঁছাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
ভোরের আকাশ/মি
মন্তব্য