-->
শিরোনাম

রাজধানীজুড়ে দাবি আদায়ের কর্মসূচি

শিপংকর শীল 
রাজধানীজুড়ে দাবি আদায়ের কর্মসূচি
পুলিশ সদর দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ করছেন চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্যরা। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সড়ক অবরোধে আছেন গ্রাম পুলিশ। একই স্থানে চাকরিতে পুনর্বহালের দাবিতে বিডিআর সদস্যদের অবস্থান। সচিবালয়ের বাইরে অবস্থান নিয়েছেন খাদ্য অধিদপ্তরাধীন বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। এভাবে গত এক সপ্তাহ ধরে রাজধানীজুড়ে চলছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন  সরকারের কাছে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের দাবি আদায়ের কর্মসূচি। তাদের অধিকাংশই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে একত্রিত হয়েছেন। কেউ কেউ এসেছেন পরিবার নিয়ে। সারাদেশ থেকে হাজার হাজার দাবি আদায়কারীর আগমনে নগরীর আবাসিক হোটেলগুলোতে সিট  খালি না থাকার খবর বেরিয়েছে। এতদিন বিভিন্ন দাবিসমূহ দাবিয়ে রাখার কারণেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আসার সঙ্গে সঙ্গে একই সময়ে সব বঞ্চিতরা দাবি আদায়ে নেমেছেন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। 
 
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, গত এক সপ্তাহ ধরে রাজধানী যেন দাবি আদায়কারীদের নগরীতে পরিণত হয়েছে। দাবি আদায় করতে আন্দোলনকারীদের সচিবালয়ের ভেতরে মিছিল নিয়ে প্রবেশ করার ঘটনাও ঘটেছে।  সরকারের কাছে দাবি-দাওয়ার যেন শেষ নেই। দায়িত্ব গ্রহণের পর বৈষম্য দূর ও রাষ্ট্রকাঠামোয় সংস্কারের লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। বাড়ানো হচ্ছে সরকারের পরিধি। প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল চলছে। বৈষম্য দূরের আশা নিয়ে প্রতিদিনই নতুন এ সরকারের কাছে দাবি-দাওয়া নিয়ে হাজির হচ্ছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। তাদের কেউ বিক্ষোভ করছেন রাস্তায়, কেউ করছেন মানববন্ধন, কেউ স্মারকলিপি দিচ্ছেন সরকারের কাছে। দাবি আদায়ে গতকালও রাজধানীতে বিভিন্ন পেশার মানুষকে বিক্ষোভ করতে দেখা যায়। জাতীয় প্রেস ক্লাব থেকে  শাহবাগ মোড় পর্যন্ত বিভিন্ন কর্মসূচির সংখ্যা বেশি দেখা গেছে। 
 
চাকরি জাতীয়করণের এক দফা দাবি আদায়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবে সড়ক অবরোধে অবস্থান নিয়েছেন গ্রামপুলিশের সদস্যরা। তাদের সংখ্যা হবে পাঁচ শতাধিক। চাকরি জাতীয়করণের দাবি তাদের। কর্মসূচিতে আসা ফরিদপুরের মো. কাশেম বলেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা রাজপথ ছাড়ব না।  প্রয়োজনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে গিয়েও আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেন তিনি। 
 
মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উপজেলা পর্যায়ে মহিলাদের জন্য আয়বর্ধক (আইজিএ) প্রশিক্ষণ প্রকল্পে কর্মরত জনবলকে রাজস্বকরণের সুপারিশ অনতিবিলম্বে বাস্তবায়নের দাবিতে মহাসমাবেশ করেছেন প্রশিক্ষক ও কর্মচারীরা। গতকাল বুধবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সরকারি গেস্ট হাউস যমুনার সামনে তারা মানববন্ধন ও সমাবেশ করেন। এই প্রশিক্ষণ প্রকল্পের ৯৫ ভাগ প্রশিক্ষকই নারী। কুমিল্লার সাবিনার সঙ্গে এসেছেন তার স্বামী ও শিশু সন্তান। তিনি ভোরের আকাশকে জানান, প্রয়োজনে কয়েকদিন ঢাকায় থাকতে হতে পারে। তাই স্বামীকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাব বলে জানান সাবিনা। 
 
একই স্থানে অবস্থান নিয়েছেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় মহিলা সংস্থা কর্তৃক বাস্তবায়িত ‘তথ্য আপা’ প্রকল্পে কর্মরত নারীরা। রাজস্ব খাতে  চাকরি স্থানান্তরের এক দফা দাবি জানিয়েছেন। গাজীপুরের শ্রীপুরবাসী ফরিদা আকতার তাদের একজন। তিনি ভোরের আকাশকে জানান, গত দুদিন ধরে গাজীপুর থেকে আসা-যাওয়া করে কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছি। আমাদের সামান্য আয় দিয়েই সংসার চলে। চাকরি রাজস্ব খাতে গেলে কষ্ট কমতো বলে জানান ফরিদা আকতার। 
 
চাকরি ফিরে পেতে পুলিশ সদর দপ্তরের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেছেন গত ১৫ বছরের বিভিন্ন সময়ে চাকরি হারানো হাজারো পুলিশ সদস্য। এ সময় পুলিশ মহাপরিদর্শকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পুলিশ সদর দপ্তরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। সরেজমিন দেখা গেছে, সদর দপ্তরের সামনের সড়কের দুই লেন বন্ধ করে তারা বিক্ষোভ ও অবস্থান করলেও বিকাল প্রায় ৫টা পর্যন্ত পুলিশপ্রধান বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কারও দেখা মেলেনি। এ সময় তারা নির্বাহী আদেশে চাকরি ফেরত দেওয়ার দাবি জানিয়ে নানা সেøাগান দেন। 
 
২০০৯ সালে পিলখানা বিদ্রোহের নামে ও বিদ্রোহের দায়ে ‘মিথ্যা ও অন্যায়ভাবে’ বিডিআরের ৭৬তম ব্যাচের ৫১৬ জন সদস্যকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে দাবি করে চাকরিতে পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের (সাবেক বিডিআর) ওই ব্যাচের সদস্যরা। এ দাবিতে গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেন তারা। তারা দাবি করেন, বিডিআর বিদ্রোহের সঙ্গে তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। তার পরও অভিযোগ দিয়ে তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এমনকি ৭৬তম ব্যাচের সব সদস্যকে অন্য কোনো বাহিনীতে চাকরি নেওয়ার সুযোগও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
 
এভাবে সচিবালয়ের সামনে বৈষম্যবিরোধী খাদ্য অধিদপ্তরের নন-ক্যাডার কর্মকর্তা ও কর্মচারী ঐক্য পরিষদ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সামনে মানববন্ধন করেছেন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় কারাগারে থাকা আসামিদের পরিবারের সদস্যরা। 
মেট্রো রেল চলার জন্য প্রস্তুত, কিন্তু কর্মচারীরা তাদের দাবি-দাওয়া পূরণ না হলে চাকরিতে যোগ দেবে না। একই অবস্থা রেল যোগাযোগেও। কর্মচারীদের দাবি দাওয়া পূরণ না হওয়ায় পূর্ণাঙ্গভাবে রেল চলাচল চালু করা যাচ্ছে না। সচিবালয়ে ৯ দফা দাবি জানিয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন সব মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। 
 
এদিকে বিসিএস ১৩তম থেকে ২২তম ব্যাচের প্রশাসন ছাড়া অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে পদোন্নতির দাবি জানিয়ে আবেদন করেছেন। ওই স্মারক লিপিতে তারা ২০০২ সালের প্রণীত সরকারের উপ-সচিব, যুগ্ম-সচিব, অতিরিক্ত সচিব এবং সচিব পদে পদোন্নতি বিধিমালার বৈষম্য রয়েছে বলে দাবি করেন।
 
পেনশন চালুকরণ, পদ সৃজন, পদোন্নতি, সরকারি কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডে অন্তর্ভুক্তি ও আউটসোর্সিং-ডেইলি বেসিসের চাকরি সরকারিকরণের দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অপরদিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের রাজস্ব খাতের স্থায়ী কর্মকর্তারা পদোন্নতির দাবি জানিয়েছেন। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে তারা এমন দাবি জানান।
 
জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্য অবসানের দাবি জানিয়েছেন শিক্ষকদের সংগঠন বাংলাদেশ সোসাইটি ফর প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি একাডেমিকস। আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ বেতারের মূল ফটকের সামনে মানববন্ধন করেছেন বাংলাদেশ বেতারের সর্বস্তরের কর্মকর্তা, কর্মচারী, নিজস্ব শিল্পী এবং কলাকুশলীরা। চাকরিতে পদোন্নতিবঞ্চিতরা বিভিন্ন বৈষম্য নিরসনের দাবি জানিয়েছেন তারা। বিশ দফা দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের চুক্তিভিত্তিক কেবিন ক্রুরা। বাংলাদেশ বিমান কেবিন ক্রু ইউনিয়নের পক্ষ থেকে অন্দোলনরতরা অনশন করেন। দাবি পূরণ না হলে কর্মবিরতির হুমকি দেন ক্রুরা। ফলে বিঘ্নিত হতে পারে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ডমেস্টেক এবং ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটের সময় সূচি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন-২০১২’ বাস্তবায়ন, ফিল্ড পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পদ আপগ্রেডেশনসহ নানা বিষয়ে সংস্কার চেয়ে মানববন্ধন করেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। রাজধানীর মহাখালী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের সামনে দাবি আদায়ে মানববন্ধন করেন তারা।
 
একই সময়ে রাজধানীজুড়ে অসংখ্য সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের দাবি-দাওয়া আদায়ের কর্মসূচি নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ১৫ বছরে বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবিসমূহ আমলে নেওয়া হয়নি। তাদের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ আজ বিক্ষোভে রূপ নিয়েছে। বড় আশা নিয়ে তারা ছুটে যাচ্ছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে। 
 
 
ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version