-->
শিরোনাম

আসুন, বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াই

ভোরের আকাশ প্রতিবেদক
আসুন, বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াই

আকস্মিক বন্যায় দেশের ১১টি জেলা আক্রান্ত হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪৮ লাখ ৬৯ হাজার ২৯৯ জন মানুষ। মারা গেছেন ১৫ জন। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় তথ্য বিবরণীতে এ তথ্য জানিয়েছে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়। এদিকে উদ্ধার হওয়ার অপেক্ষায় প্রখর গুণছেন পানিতে আটকেপড়া লোকজন। তারা উদ্ধারের আকুতি জানিয়েছেন। মোবাইল নেটওয়ার্ক অচল হওয়ায় আটকেপড়া বিপুল বন্যার্তকে খুঁজে পাওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে। উদ্ধার কার্যক্রমের বিলম্বতায় বেড়ে চলেছে পানিবন্দি মানুষের জীবনঝুঁকি। ফলে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন তাদের স্বজনরা। উদ্ধার কার্যক্রমে সর্বাত্মক শক্তি ও সামর্থ্য প্রয়োগ করার ওপর জোর দিচ্ছেন সরকারি-বেসরকারি উদ্ধারকর্মীরা। অনেক বন্যার্ত অনাহারে রয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তি পর্যায়ে ত্রাণ তৎপরতাও চলছে; কিন্তু তারা সব জায়গায় পৌঁছতে পারছেন না। দুর্গত এলাকায় খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে।

তথ্য বিবরণীতে বলা হয়েছে, আকস্মিক বন্যায় দেশের ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, সিলেট, লক্ষীপুর ও কক্সবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব জেলার ৭৭টি উপজেলা এবং ৫৮৯টি ইউনিয়ন বা পৌরসভা প্লাবিত হয়েছে। এই ১১ জেলায় মোট ৯ লাখ ৪৬ হাজার ৭৬৯ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। যাতে মোট ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা ৪৮ লাখ ৬৯ হাজার ২৯৯ জন।

এখন পর্যন্ত বন্যায় ১৫ জন মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে দুজন নারী। জেলাভিত্তিক হিসাবে কুমিল্লায় ৪ জন, ফেনীতে একজন, চট্টগ্রামের চারজন, নোয়াখালীতে একজন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একজন, লক্ষ্মীপুরে একজন এবং কক্সবাজারের ৩ জন মারা গেছেন। পানিবন্দি বা ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের আশ্রয় প্রদানের জন্য মোট ৩ হাজার ১৭৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মোট ১ লাখ ৯৫ হাজার ৩০ জন লোক এবং ১৮ হাজার ৯৬টি গবাদি পশুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। বিবরণীতে বলা হয়েছে, ১১টি জেলার ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য মোট ৬৩৯টি মেডিক্যাল টিম চালু রয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে এখন পর্যন্ত মন্ত্রণালয়গুলো থেকে ৩ কোটি ৫২ লাখ নগদ টাকা ২০ হাজার ১৫০ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলেও জানানো হয়েছে।অ

বুড়িচংয়ের মানুষ দিশেহারা : কুমিল্লা প্রতিনিধি জানান, ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢল ও কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে কুমিল্লা গোমতী নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে গোটা বুড়িচং উপজেলাই তলিয়ে গেছে। উপজেলার নয়টি ইউনিয়নের পানিবন্দি মানুষ বিশুদ্ধ পানি আর খাবার সংকটের কারণে দিশেহারা অবস্থার মধ্যে পড়েছেন। যেভাবে তীব্র বেগে পানি ঢুকছে এতে দ্রুতই পাশের ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা থেকে শুরু করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবাও প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এই অবস্থায় পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পাশাপাশি কাজ শুরু করেছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরাও।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জমান শুক্রবার বেলা ৩টায় বলেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে বুড়বুড়িয়া এলাকায় প্রতিরক্ষা বাঁধের নিচ দিয়ে পানি বের হচ্ছিল। স্থানীয় লোকজন বালুর বস্তা ফেলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। রাত পৌনে ১২টার দিকে বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকতে থাকে। বাঁধের অন্তত ৩০ ফুট ভেঙে গেছে। নদীর পানি না কমলে এই বাঁধ মেরামত করা সম্ভব না। নদীর পানি যতদিন না কমবে ততদিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হতে থাকবে।বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাহিদা আক্তার বিকাল সাড়ে ৩টায় বলেন, এখন আর গ্রাম, ইউনিয়ন হিসাব করে লাভ নেই। পুরো বুড়িচংই পানির নিচে। প্রবল স্রোতে পানি প্রবেশ করায় প্রতিনিয়ত পানির উচ্চতা বেড়েই চলেছে। এভাবে চলতে থাকলে আশপাশের উপজেলাও প্লাবিত হতে পারে। বাঁধ ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকেই স্থানীয় লোকজনকে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে এলাকায় মাইকিং করা হয়। এরই মধ্যে অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে গেছেন। পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধারকে কাজ চলছে। স্থানীয় প্রশাসন, সাধারণ মানুষ, বিভিন্ন সংগঠনের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর সদস্যরাও পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছে দিচ্ছেন বলে জানান সাহিদা আক্তার। এদিকে আশ্রয়কেন্দ্রে খাবার সঙ্কটে শিশু-বৃদ্ধসহ বিপাকে পড়েছেন মানুষজন। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে বুড়িচং উপজেলা প্লাবিত হতে শুরু করলে মানুষজন প্রাণ রক্ষায় ছুটতে থাকেন আশ্রয়কেন্দের দিকে। তবে সেখানে রয়েছে খাবার ও চিকিৎসা-সংকট।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বুড়িচং উপজেলার মহিষমারা উচ্চবিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত প্রায় ৫০০ মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে সেখানে কেউই খাবার ও চিকিৎসাসেবা নিয়ে যায়নি। যে কারণে ২০ জনের বেশি শিশু ও ১০ বৃদ্ধকে নিয়ে বিপাকে পড়েছেন আশ্রয় গ্রহণকারীরা।

শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে মহিষমারা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রশিদ আহমেদ বলেন, খাবার না থাকার বিষয়টি আমরা আমাদের স্বেচ্ছাসেবীদের জানিয়েছি। কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের পরিবার নিয়ে ব্যস্ত, তারাও বিপদে আছে। যাদের পক্ষে সম্ভব দ্রুত ত্রাণ নিয়ে মহিষমারা উচ্চবিদ্যালয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে প্রধান শিক্ষক বলেন, এখানকার প্রায় ৫০০ মানুষ না খেয়ে আছে। শিশুরা কান্না করছে। বের হওয়ার কোনো অবস্থা নেই। কারণ বিদ্যালয়ের নিচতলা পানিতে ডুবে গেছে। এদিকে বুড়িচংয়ে গোমতীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর থেকেই আতঙ্কে ঘুম নেই কুমিল্লা নগরবাসীর। কারণ গোমতী নদীর পাড়েই অবস্থান এই নগরী। বৃহস্পতিবার প্রায় পুরো রাতই নগরীর সিংহভাগ মানুষ জেগে ছিলেন বাঁধ ভাঙার আতঙ্কে। নগরীর বাসিন্দাদের শঙ্কা, গোমতীর বাঁধ ভাঙলেই তলিয়ে যাবে গোটা শহর।

আমার ঘরে গলা সমান পানি, কিছুই খাইনি : আমার ঘরে গলাসমান পানি। বৃহস্পতিবার রাত থেকে কিছুই খাইনি। আমার চার ছোট ছেলেমেয়ে এবং স্ত্রীসহ ছয় জনের পরিবার। পাশের চাচাতো ভাইয়ের দোতলা ভবনের ছাদে আমরা রাত কাটিয়েছি। ওই ছাদে আমার পরিবারের মতো কমপক্ষে ৫০ জন মানুষ রাত কাটিয়েছি। এখনও সেখানে আছি। গতকাল বিকালে চট্টগ্রামের নাজিরহাট কলেজ সড়কে দাঁড়িয়ে বন্যায় দুর্ভোগের কথা এভাবেই বললেন হাটহাজারী উপজেলার ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের পূর্ব মন্দাগিনি এলাকার বাসিন্দা মো. হোসেন (৫০)। পেশায় কৃষক হোসেন আরও বলেন, দিনভর আমরা ভালো ছিলাম। এতদিনের টানা বৃষ্টিতেও আমাদের ঘরে পানি ঢোকেনি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নাজিরহাট নতুন ব্রিজ সংলগ্ন হালদা নদীর বাঁধ ভেঙে যায়। রাত ৮টা থেকে পানি এলাকায় প্রবেশ করে। রাত ১০টা হওয়ার আগেই ঘরের ভেতর গলাসমান পানি ঢুকেছে। ঘর থেকে কিছুই বের করতে পারিনি। এত বছর ধরে গড়ে তোলা সংসারের সব জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে গেছে।

ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা আবুল কাসেম বলেন, আমার টিনের ঘরে ছেলেমেয়েসহ সাত জন সদস্য। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে ঘরে পানি ঢুকেছে। নৌকায় করে কিছু স্বেচ্ছাসেবী আমাদের তীরে নিয়ে এসেছেন। পরিবারের সদস্যদের আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমি কাল থেকে চায়ের দোকানে বসে সময় কাটাচ্ছি। কখন পানি কমবে সে অপেক্ষায় আছি। একই এলাকার আবুল হোসেনের ছেলে মো. কামাল (৩০) বলেন, আমি চট্টগ্রাম শহরে গ্রিল ওয়ার্ক গ্রিল ওয়ার্কশপে কাজ করি। পরিবারে ১২ জন সদস্য। আমার টিনের ঘরে গলাসমান পানি। ঘরে চালসহ সবকিছু নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক কষ্টে আছি। রাত থেকে এখন পর্যন্ত বনরুটি খেয়েছি। এখনও ভাত খাইনি। এদিকে, সকাল থেকে বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে ত্রাণ সহায়তা নিয়ে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের পাশে দাঁড়াতে দেখা গেছে। বন্যাকবলিত এলাকায় কাজ করছে বিভিন্ন চিকিৎসা টিম। হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, হাটহাজারী উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের ৪ হাজার ৫০০ পরিবারের ৪৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। আজ (শুক্রবার) সারাদিন বৃষ্টি না হওয়ায় পরিস্থিতি আগের চেয়ে উন্নতির দিকে।

ফেনীর সাথে যোগাযোগ নেই : পড়াশোনার জন্য বছর দু’য়েক হল ইউরোপের দেশ বেলজিয়ামে থাকছেন ফেনী জেলার আইনুল ইসলাম। পরিবার-প্রিয়জনের তার যোগাযোগ হয় মোবাইল টেলিফোন কিংবা ইন্টারনেট-ভিত্তিক বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে।। কিন্তু দু’দিন ধরে বন্যা কবলিত ফেনীতে আত্মীয়দের সাথে কথা বলতে না পেরে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মাঝে দিন কাটছে তার। গতকাল তিনি বলেন, বাবা-মায়ের সাথে যোগাযোগ তো বন্ধ হয়েছেই, মামা বাড়ির সাথেও তারা যোগাযোগ করতে পারছেন না। একই ধরনের উদ্বেগের সাথে দিন কাটাচ্ছেন ফেনীর সিলোনিয়া এলাকার দুবাই প্রবাসী সাইফুল হাসানও। তিনি শুক্রবার সকালের দিকে ফেসবুকে একটি ভিডিও বার্তার মাধ্যমে তার পরিবারকে উদ্ধার করার আকুতি জানান।

কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, আমার বউ, বাচ্চা, বাবা, মা- সবাই খাবার অভাবে মারা যাইতেছে। শেষে কথা হয়েছে হাননান মুহাম্মদ চৌধুরীর সাথে। তিনি একজন স্বেচ্ছাসেবক। ফেনীর বন্যাদুর্গতদের সাহায্য করার জন্য বৃহস্পতিবার রাতে তিনি চট্টগ্রাম থেকে ছুটে গিয়েছেন। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তিনি ফেনীতে পৌঁছাতে পারেননি। কোনোমতে ফেনীর লালপুর পর্যন্ত গিয়েছিলেন। পরে বাধ্য হয়ে রাত ১১টার দিকে তিনি ফিরে এসেছেন। রাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নিকটবর্তী একটি আশ্রয়কেন্দ্রে তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন। ফেনীর লালপুরে তিনি কী অবস্থা দেখেছেন? জানতে চাইলে তিনি বিাংলাকে বলেন, ম্যাসাকার অবস্থা ওখানে। কাল যখন গেছি, অনেক পানির স্রোত ছিল। পরে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছি।

বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) প্রতিবেদন অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ওই জেলায় তিন লাখ মানুষ বন্যা আক্রান্ত এবং এপর্যন্ত ২০ হাজার মানুষকে উদ্ধার করে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। ফেনী প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ফুলগাজী, পরশুরাম, আনন্দপুর এলাকাগুলোতে মানুষ আটকা পড়েছেন। এখন কোথাও কোনো নেটওয়ার্ক নেই। পানিবন্দি বন্যার্তরা খাবার চান না, তারা বাঁচতে চান। চারদিকে মানুষ শুধু বাঁচার আকুতি জানাচ্ছেন। কেউ কেউ টিনের ঘরের চালের ওপর অবস্থান করছেন। যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে ঘর। অবস্থা এতটাই খারাপ, কল্পনারও বাইরে। আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে কথা বলে জানতে পারছি, মৃতের সংখ্যা সরকারি তালিকার অনেক গুণ বেশি হবে। ফুলগাজী পশুরামের অবস্থা ভালো না। সিলেটে যে এলাকায় বন্যা হয়েছিল, তারা কিন্তু পানি নৌকার সঙ্গে ইউজ টু ছিলেন। কিন্তু এটা এমন একটা অঞ্চল, এখানে কোনো নদী নেই, নৌকা নেই। তারা পানিবন্দী অবস্থায় টিকতে পারছেন না। বেশির ভাগ মানুষ জীবনে বন্যাই দেখেননি। তারা বুঝে উঠতে পারছেন না। দেশের বন্যাকবলিত ১০ জেলার প্রায় ১১ শতাংশ মোবাইল টাওয়ার অচল হয়ে পড়েছে। শুধু ফেনী জেলায় ৯২ শতাংশ টাওয়ারই অচল হয়ে পড়েছে। বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকা এবং টাওয়ার এলাকা ডুবে যাওয়ায় নেটওয়ার্ক সচল করা যাচ্ছে না।

এ অবস্থায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ফেনীবাসীর পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় দলের অলরাউন্ডার মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন। তার নিজের বাড়িও ফেনীতে। গত রাতে দেওয়া এক ফেসবুক পোস্টে তিনি লিখেছেন, সবার কাছে বিনীত অনুরোধ আমাদের ফেনীর মানুষকে বাঁচান, খুব বাজে অবস্থা গ্রামের মানুষের গগনবিদারী চিৎকার আর সহ্য হচ্ছে না। আসলে অনেক ভয়াবহ অবস্থার মধ্য দিয়ে পার করতেছি, ঘরে বসে থাকতে পারলাম না। আমরা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন, মোবাইল নেটওয়ার্ক কিছুই নাই। এই মুহূর্তে আসলে দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আমাদের অনেক বেশি স্পিড বোট বা নৌকার প্রয়োজন। বিশেষ করে আমাদের গ্রামাঞ্চলে শিবপুর, পরশুরাম, ফুলগাজি, ছাগলনাইয়া সব জায়গার মানুষ খুব কষ্টে দিন পার করতেছে। যোগাযোগও করতে পারছি না ওদের সাথে। কিন্তু আপনারা বাংলাদেশের যে প্রান্তে বোট বা স্পিড বোট আছে প্লিজ ব্যবস্থা করুন। এখানে যে পরিমাণ রেসকিউ টিম প্রয়োজন, সে পরিমাণ আসেনি। আপনাদের কাছে অনুরোধ থাকবে, আসলে এই মুহূর্তে আমাদের অনুরোধ করা ছাড়া আর উপায় নাই। কারণ আমাদের হাতে কিছু নেই। নেটওয়ার্ক নেই যে যোগাযোগ করবো কোথাও...। সবাই ইনশাল্লাহ এগিয়ে আসুন। কারণ আমাদের ফেনীর মানুষ খুব ভয়াবহ অবস্থার মধ্য দিয়ে দিন পার করতেছে। সবাই দোয়া করবেন।

নোয়াখালীতে দুর্দশা : স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, নোয়াখালীতে আজ (গতকাল) আটদিন পর সূর্য উঠেছে। সেখানকার স্থানীয় সাংবাদিক হাসিব আল-আমিন বলেন, সূর্য ওঠাতে পরিবেশ আগের চেয়ে স্বাভাবিক। তবে পানি নাম্বার ফ্লোটা ধীরে। তিনি জানান, ফেনী থেকে যে পানি নোয়াখালী হয়ে মেঘনা নদী ও সাগরে নামবে, এতে সময় লাগবে। পানিটা স্লুইস গেট দিয়ে নামতে হয়। কিন্তু জোয়ারের সময় উল্টো দিক থেকে পানি ঢোকার চেষ্টা করে বিধায় তখন স্লুইস গেট বন্ধ থাকে। সকাল থেকে পানি নামা শুরু হয়েছে। দুপুর ১২টায় গেট বন্ধ হয়েছে। জোয়ার নেমে গেলে আবার গেট খোলা হবে, তখন আবার পানি নামবে।

তার মতে, বিগত ২০-২৪ বছরে নোয়াখালীতে এমন বন্যা হয়নি। ২০০৪/১৯৯৮ এর বন্যাকেও হার মানিয়েছে এটি। এর আগে ফেনীর পানি সরাসরি মাইজদীতে আসেনি। তিনি বলেন, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ, বেগমগঞ্জ, সেনবাগে মুহুরি নদীর পানিতে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু অনেক উপজেলায় যা হয়েছে, তা কেবল জলাবদ্ধতা। নোয়াখালী নদীবেষ্টিত এলাকা, উপকূল দিয়ে পানি নামা সহজ। কিন্তু পানি নামবে কিভাবে? দখলের কারণে পানি নামার পথ বন্ধ। তাই বন্যার রূপ ধারণ করেছে জলাবদ্ধতা। তিনি জানান, নোয়াখালীর হাতিয়া বাদে বাকী সব উপজেলা এখন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। পুরো নোয়াখালীতে এখন ২০ লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দি এবং ৮৭ টি ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত। চলমান পরিস্থিতিতে সেখানে ৫০২ টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে এখনও লক্ষাধিক মানুষ এবং ১৫-২০ হাজার গবাদি পশু আশ্রয় নিয়েছে বলেও তিনি জানান। মানুষের সেবা করার জন্য সেখানে ৮৮টি মেডিকেল টিম কাজ করছে।

ফটিকছড়ির অবস্থা : ফেনী জেলার লাগোয়া চট্টগ্রাম জেলার একটি উপজেলা হল ফটিকছড়ি। চট্টগ্রামের স্থানীয় সাংবাদিক শ্যামল নন্দী বলেন, তার নিজের ঘরেও বর্তমানে হাঁটু সমান পানি আছে। হালদার বাঁধ, বারোমাসিয়া খাল— দু’টোই ভেঙ্গেছে। ফটিকছড়ির ২১টি ইউনিয়নের ১৮টিতেই এখন পর্যন্ত পানি আছে। শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে পানি কমছে, কিন্তু তা-ও একটু একটু করে।

ফটিকছড়ির গ্রামগুলোর রাস্তায় এখনও কোমর সমান পানি। তবে আশার কথা যে গতকাল রাত থেকেই এখানে বৃষ্টি নাই, বৃষ্টি থাকলে অবস্থা আরও ভয়াবহ হতো বলে স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন। এই উপজেলায় কোনও মানুষের মৃত্যুর খবর এখনও কানে আসেনি। বন্যার জন্য যেসব আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে, সেগুলোতে খুব বেশি মানুষ আশ্রয় নিতে পারেননি। তিনি বলেন, আমাদের এখান থেকে গেলে- মাঝখান থেকে খাল আছে। কিন্তু যেহেতু আমাদের কাছে নৌকা ছিল না, তাই আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। তিনিও বলেন যে তিনি তার জীবদ্দশায় এত ভয়াবহ বন্যা দেখেনি। এমনকি তার বাবাও না। ফটিকছড়ির মানুষেরা প্রায় অনাহারে আছেন এখন এবং সেখানকার গ্রামগুলোতে এখনও ত্রাণ যায়নি। যাদের বাড়িতে গ্যাস আছে, তারা খাটের ওপর রেখে খেতে পারছে কিছু করে। যাদের কাছে শুকনা খাবার আছে, তারাও সেগুলা খেতে পারছেন। এখনও সেভাবে কোনও সহায়তা আসেনি এখানে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া : কুমিল্লার পাশে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাও বন্যা কবলিত। এবারের বন্যার ভয়াবহতা বোঝা যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়ার নয়াদিল গ্রামের বাসিন্দা সাজ্জাদ মাস্টারের কথায়। তিনি বলেন, পানি আসার পর কোনও ঘর থেকে কিছু লওয়ার মতন সময় পাইছে না। খালি মোবাইলডি লইছে হাতে, এতটুকুই। একই এলাকার বাসিন্দা ইয়ার হোসেন জানিয়েছেন, গত ২০ বছরে তিনি তার এলাকায় এত পানি আর দেখেন নাই। তার ভাষ্য, ২০০৪ সালের পর বন্যার পানি এদিক দিয়া আসেনাই। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাংবাদিক মাসুক হৃদয় জানিয়েছেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলায় আরও একটি সেতুর অংশ ধ্বসে পড়ায় কসবা উপজেলার সঙ্গে আখাউড়ার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। আখাউড়ায় এখনও ১০০টির মতো পরিবার আশ্রয়কেন্দ্রে আছে এবং ৫০০ পরিবার পানিবন্দি। আখাউড়ার পৌর শহরের দেবগ্রাম এলাকার একটি সেতুুও ঝুঁকির মাঝে আছে। এটি ধসে পড়লে দেবগ্রামের বাসিন্দাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারে অচল হয়ে পড়বে। এছাড়া, সেখানকার কয়েকটি এলাকা এখন সম্পূর্ণ বিদ্যুৎহীন অবস্থার মাঝ দিয়ে যাচ্ছে।

খাগড়াছড়িতে বন্যার উন্নতি : খাগড়াছড়ি জেলায়ও বন্যা হলেও তা খুব বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি এবং বৃষ্টি না থাকায় খাগড়াছড়ি জেলা সদরের বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সাংবাদিক আবু দাউদ। খাগড়াছড়িতে বন্যা হুট করে আসে এবং চলে যায়। কালকে রাতে পানি আসছিলো। আজকে সকালে পানি নেমে গেছে। আশ্রয়কেন্দ্রে যারা ছিল, ওরাও নেমে এসেছে। তবে খাগড়াছড়ির দিঘীনালা এলাকার ৮-১০ হাজার লোক এখনও আশ্রয়কেন্দ্রে আছে বলে জানিয়েছেন তিনি। দীঘিনালার পানি নামতে কিছুটা সময় লাগেৃমেরুং ইউনিয়নের বেশ কিছু এলাকা নিমজ্জিত।

ধীরে কমছে খোয়াই নদীর পানি : সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার ‘খোয়াই নদীর পানি অল্প অল্প করে কমছে’ বলে জনিয়েছেন সেখানকার স্থানীয় সাংবাদিক প্রদীপ দাশ সাগর। এই জেলার বন্যায় আক্রান্ত উপজেলাগুলো হল— চুনারুঘাট, মাধবপুর, শায়েস্তাগঞ্জ, হবিগঞ্জ সদর ও নবীগঞ্জ। এসব জায়গার ‘প্রায় ৩৩ হাজার মানুষ এখনও পানিবন্দি আছে’। গতকাল রাত থেকে ওইসব উপজেলার পানি কমতে শুরু করেছে। কিন্তু এক্ষেত্রেও “গতি খুবই কম।

চট্টগ্রামে পানিবন্দি ২ লাখ ৬২ হাজার মানুষ : চট্টগ্রামে বন্যায় তিন উপজেলায় চার জনের মৃত্যু হয়েছে। এখনও পানিবন্দি অবস্থায় আছেন ১০টি উপজেলার দুই লাখ ৬২ হাজার ৪০০ জন মানুষ। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হলেও সেগুলো প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলে জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন। মৃতদের মধ্যে ফটিকছড়ি উপজেলায় দুজন, হাটহাজারীতে একজন এবং রাঙ্গুনিয়ায় একজন রয়েছেন। এর মধ্যে হাটহাজারীতে বন্যার পানিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট একজনের মৃত্যু হলেও বাকিদের মৃত্যু হয়েছে পানিতে ডুবে। চট্টগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ছাইফুল্লাহ মজুমদার এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

ঢাবির টিএসসিতে ত্রাণযজ্ঞ : শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা যায়, টিএসসির প্রধান ফটকে মাইকে একটু পর পর ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে, ‘চলাচলের রাস্তা বন্ধ করবেন না, শৃঙ্খলা বজায় রাখুন’। আর কিছুক্ষণ পর পর প্রাইভেট কার, ট্রাক, রিকশা এমনকি ঠেলাগাড়ি ভর্তি বন্যার্তদের জন্য শুকনো খাবার, খেজুর এবং পানি নিয়ে আসছেন শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ। প্রবেশপথের পাশে ‘সারা দেশের বন্যায় আক্রান্তদের জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে গণ-ত্রাণ সংগ্রহ’ বুথ বসানো হয়েছে। এসব ত্রাণ রাখা হচ্ছে টিএসসির অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া কক্ষে ও ক্যাফেটেরিয়াসহ আশপাশে। সেখানে বিস্কুট, চিরা-মুড়িসহ প্রতিটি খাবার আলাদা করে প্যাকেজিং করা হচ্ছে। এগুলো পৌঁছানো হবে বন্যা কবলিত এলাকায়। অনেকে নগদ অর্থ সহায়তাও করছেন। সেসব টাকাও হিসাব করে সংরক্ষণ করে রাখা হচ্ছে।

খুলনা বেড়িবাঁধ ভেঙে ১৯ গ্রাম প্লাবিত : খুলনার পাইকগাছা ও দাকোপ উপজেলার দুটি স্থানে বাঁধ ভেঙে ১৯টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পাইকগাছার কালিনগর রেখামারি বেড়িবাঁধ ভেঙে ১৩টি গ্রাম এবং দাকোপের পানখালীর খলিসায় বাঁধ ভেঙে ছয়টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ফলে এ গ্রামগুলোতে লক্ষাধিক মানুষ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। চিংড়িঘের, রোপা আমন ধান ও বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, পাইকগাছা ও দাকোপের বাঁধ স্বেচ্ছাশ্রমে আটকানোর চেষ্টা সফল হয়নি। জোয়ারের পানির চাপ অতিমাত্রায় রয়েছে। এ কারণে বাঁশের খুঁটি দিয়েও মাটি আটকানো যাচ্ছে না। পাইকগাছার বেড়িবাঁধের একটি অংশে ফাটল ছিল। বৃহস্পতিবার সকালে চোখের সামনেই সেখানে ভেঙে যায়। এরপর এলাকার পাঁচটি ওয়ার্ডের মসজিদ-মন্দিরের মাইক দিয়ে এ খবর প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। স্থানীয় লোকজন নিয়ে বাঁধ সংস্কারের চেষ্টা করা হয়। যা সফল হয়নি।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, কালীনগর গ্রামের পাশেই রয়েছে ভদ্রা নদী। দুপুরের দিকে সেখানে পাউবোর ২২ নম্বর পোল্ডারের উপকূল রক্ষার বেড়িবাঁধের প্রায় ৯০ ফুটের মতো অংশ ভেঙে যায়। এ সময় ওই পোল্ডারের ভেতরে থাকা ১৩টি গ্রামের মধ্যে পানি প্রবেশ শুরু করে। প্লাবিত গ্রামগুলো হলো– কালীনগর, দারুল মল্লিক, গোপী পাগলা, তেলিখালী, সৈয়দখালী, খেজুরতলা, সেনের বেড়, হাটবাড়ি, ফুলবাড়ী, বাগীরদানা, দুর্গাপুর, হরিণখোলা ও নোয়াই। এদিকে, দাকোপের খলিসা এলাকা কাজীবাছা নদীর তীরে। এ স্থানটিতে ৫০-৬০ হাত ভেঙেছে। ভাঙন বাড়ছে জোয়ারের চাপের কারণে। ফলে প্লাবিত হওয়া গ্রামগুলো হচ্ছে খলিসা, পানখালী, আনন্দনগর, ছোট চালনা, মৌখালী ও হোগলাবুনিয়া।

 

ভোরের  আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version