সমগ্র নৌ যোগাযোগ (অভ্যন্তরীণ ও সমুদ্রগামী) সেক্টরের নিয়ন্ত্রক সংস্থা নৌ পরিবহন অধিদপ্তরে সদ্যক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগীরা এখনও ক্ষমতাধর। বিশেষ মহলের আশির্বাদে অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক (সিইএসএস) এবং চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ারের (সিএনই) পদ দুটি কয়েক বছর যাবৎ দুই কর্মকর্তার দখলে রয়েছে। এ দুজন হলেনÑ সিইএসএস মনজুরুল কবির ও সিএনএস গিয়াস উদ্দিন আহমেদ। দুটি পদই যুগ্ম-সচিব মর্যাদার। তবে তারা কেউই এসব পদে স্থায়ী কর্মকর্তা নন। এমনকি তাদের একজন নৌ মন্ত্রণালয়ের অধীন ভিন্ন একটি সংস্থার কর্মকর্তা। তা সত্ত্বেও মন্ত্রণালয় তাদেরকে চলতি দায়িত্বে ও সংযুক্তিতে নিয়োগ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি পদে দীর্ঘদিন বহাল রেখেছে।
জনশ্রুতি আছে, মনজুরুল কবির প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য আবুল হাসনাত আবদুল্লাহর আশির্বাদপুষ্ট ছিলেন। আর গিয়াস উদ্দিন আহমেদের প্রতি ছিল সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান এবং সম্প্রতি বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো পুলিশের বিশেষ শাখার অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মনিরুল ইসলামের আশির্বাদ। গিয়াস উদ্দিন, ফারুক খান ও মনিরুল ইসলামÑ তিনজনেরই পৈতৃকনিবাস গোপালগঞ্জের মকসুদপুর উপজেলায়। আর বরিশালে পৈতৃকনিবাস মনজুরুল কবির ও আবুল হাসনাত আবদুল্লাহর। এছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই গিয়াস উদ্দিনের চাকরি হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগ নেতা শাজাহান খান নৌমন্ত্রী থাকাকালে এ দুই কর্মকর্তাকে পদায়ন ও নিয়োগ দেওয়া হলেও পরবর্তী সময়ে নৌ প্রতিমন্ত্রী (তৎকালীন) খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর বিশেষ আশির্বাদ লাভ করেন তারা। এ কারণে কর্মক্ষেত্রে তারা খুবই প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পরও এ দুই কর্মকর্তা স্বপদে বহাল রয়েছেন এবং দাপটের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। নতুন সরকারের দুসপ্তাহে তাদেরকে অপসারণ না করায় অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ নৌ সেক্টরের সঙ্গে যুক্ত অনেকের মাঝেই হতাশা ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
নৌ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ১২ এপ্রিল নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্বে) ড. এস এম নাজমুল হক দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) হাতে গ্রেপ্তার হন। এর এক সপ্তাহের মাথায় বাংলাদেশ মেরিন একাডেমির (চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমি) কর্মকর্তা প্রকৌশলী মনজুরুল কবিরকে সংযুক্তিতে নৌ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী পদে পদায়ন করে নৌ মন্ত্রণালয়। এই পদায়ন ছিল সম্পূর্ণ অস্থায়ী। রীতি অনুযায়ী, অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে থেকে জ্যেষ্ঠতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে এসব পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু সদ্যসাবেক নৌ প্রতিমন্ত্রীর আশির্বাদপুষ্ট হওয়ায় মন্ত্রণালয় তাকে এখনও স্বপদে বহাল রেখেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গিয়াস উদ্দিন নটিক্যাল সার্ভেয়ার পদে অধিদপ্তরে যোগ দেন ২০১২ সালের শেষ দিকে। ফারুক খান ও মনিরুল ইসলামের আশির্বাদপুষ্ট হওয়ায় সহজেই তৎকালীন নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের আশির্বাদ লাভে সক্ষম হন তিনি। নৌমন্ত্রীর বদান্যতায় তিন বছরের মাথায় যুগ্ম-সচিব মর্যাদার চিফ মেরিটাইম এক্সামিনার (সিএমই) পদে চলতি দায়িত্ব পান তিনি। এ পদে বছর তিনেক দায়িত্ব পালনের পর ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে নৌ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।
অল্পদিনের তাকেও ম্যানেজ করে ফেলেন গিয়াস উদ্দিন। এবার প্রতিমন্ত্রীর ইচ্ছায় অধিদপ্তরের অঙ্গ সংস্থা নৌ বাণিজ্য দপ্তরের মুখ্য কর্মকর্তা (পিওএমএমও) পদে সংযুক্তিতে নিয়োগ দিয়ে চট্টগ্রাম পাঠানো হয় তাকে। সেখানে কয়েক বছর দায়িত্ব পালন এবং ঘুষ, দুর্নীতি ও অনিয়মের নানা কেলেঙ্কারীতে জড়িয়ে পড়ার পর ২০২২ সালের ডিসেম্বরে তাকে ঢাকায় অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে ফেরত আনা হয়। তবে গিয়াস উদ্দিনকে এবার দেওয়া হয় আরো গুরুত্বপূর্ণ সিএনএসের চলতি দায়িত্ব। সেই থেকে প্রচণ্ড দাপটের সঙ্গেই এ দায়িত্ব পালন করে আসছেন তিনি।
এদিকে, নৌ সংশ্লিষ্টদের মুখে মুখে গিয়াস উদ্দিনের বিরুদ্ধে সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ শোনা যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামে। অনুসন্ধানে গিয়াস ও তার স্ত্রীর নামে জ্ঞাত আয়বহির্ভুত সম্পদের তথ্য প্রমাণ পায় দুদক। এছাড়া সম্পদবিবরণীর সঙ্গে অনেক জাল ও ভুয়া কাগজপত্রও জমা দেন তিনি। তবুও এখনো তার নামে মামলা করেনি দুদক। অভিযোগ রয়েছে, কালো টাকা ও ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে দুদক থেকে ‘ক্লিন সার্টিফিকেট’ (দায়মুক্তি সনদ বা ছাড়পত্র) নেওয়ার জন্য গত দেড় বছর যাবৎ উঠে পড়ে লেগেছেন তিনি। প্রথম অনুসন্ধান কর্মকর্তা তাকে দায়মুক্তি দেওয়ার সুপারিশও করেছিলেন। কিন্তু তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে সেই সুপারিশ নাকচ করে দেয় কমিশন। অনুসন্ধানের জন্য নিয়োগ দেয় নতুন কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে কথা বলতে কয়েকদিন আগে গিয়াস উদ্দিনের মুঠোফোনে কল দিয়ে এবং হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠিয়ে কোনো সাঁড়া পাওয়া যায়নি। আর মনজুরুল কবিরের মুঠোফোনে কল দিলেও তার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। জানতে চাইলে নিরাপদ কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, এভাবে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো বছরের পর বছর আঁকড়ে রাখা রীতিনীতিবিরোধী। এতে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সরকারের উচিত, এসব বিতর্কিত কর্মকর্তাকে অবিলম্বে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার এবং জ্যেষ্ঠতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া। অন্তর্বর্তী সরকার সেই কাজটি করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন নাগরিক অধিকার আন্দোলনের এই নেতা।
ভোরের আকাশ/মি## শব্দসংখ্যা ৬৯৪।
মন্তব্য