-->
শিরোনাম

পুুলিশের ট্রমা কাটবে কিভাবে

হেলাল সাজওয়াল
পুুলিশের ট্রমা কাটবে কিভাবে

পুলিশ স্বাভাবিকভাবে এখনো কাজ করতে পারছে না। বিভিন্ন জায়গায় ‘ভুয়া ভুয়া’ বুলিংয়ের শিকার হতে হচ্ছে। তাদের মধ্যে এক অজানা হতাশা বিরাজ করছে। কোনোভাবেই কাটছে না এই বাহিনীর সদস্যদের মনে তৈরি হওয়া ট্রমা। যদিও তাদের মনের জোর বাড়াতে নেওয়া হয়েছে নানামুখী উদ্যোগ। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বলছেন, পুলিশ ও জনগণের একটি যৌথ অঙ্গিকার তৈরি করতে পারলে; একসঙ্গে চলতে পারলে দূর হবে ট্রমা। একই সঙ্গে পুলিশের রাজনৈতিক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।

পুলিশের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের ভূমিকা বিতর্কিত ছিল। কিছু সংখ্যক ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার দমন-পীড়ন নীতিই পুলিশকে জনগণের প্রতিপক্ষ করেছে। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পর ভেঙে পড়ে পুলিশের চেইন অব কমান্ড। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সবচেয়ে বেশি তোপের মুখে পড়ে বাংলাদেশ পুলিশ। সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ছাত্র জনতার সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ ও হামলায় ৪৪ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন।

সরকার পতনের পর সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। ছাত্র-জনতার রোষের মুখে পুলিশের অধিকাংশ সুবিধাবাদী ও সরকার ঘেঁষা কর্মকর্তারা গা ঢাকা দিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশ বাহিনীকে পুনর্গঠন ও সংস্কার করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ও পুলিশকে স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফেরাতে ইতোমধ্যে সেই উদ্যোগ বাস্তবায়নে নেওয়া হয়েছে নানামুখী পদক্ষেপ। পুলিশ সদস্যরা বলছেন, তাদের মনে যে ট্রমা তৈরি হয়েছে, হৃদয়ে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে তা কতদিনে কাটবে সেটাই এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ বলেন, আবু সাঈদকে প্রকাশ্যে গুলি করা ছিল বড় ভুল। ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে পুলিশের ভূমিকা সবাই দেখেছে।

সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে এনে পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিক ব্যবহার মুক্ত করতে হবে। আর এজন্য পুলিশকে পরিচালনার জন্য স্বাধীন কমিশন গঠনের দাবি উঠেছে।

জানা গেছে, ‘পুলিশ হবে জনতার’ সব সময় এমন সেøাগান দিয়ে আসা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাই জনতার বিরুদ্ধে গুলি চালানোর আদেশ দিয়েছেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় বিরোধী মত ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের দমন-পীড়নে পুলিশের কিছু কর্মকর্তাকে ব্যবহার করা হয়েছে। সরকার পতনের পর সেই কর্মকর্তাদের তালিকা করা হচ্ছে বলে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে।

একাধিক পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বলপ্রয়োগের নির্দেশনার পর আমাদের কিছুই করার থাকে না। অনেক সহকর্মী আন্দোলনকারীর ওপর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ ও গুলি করেছে। বিরোধিতা করেও কোন লাভ হয়নি। যার ফলশ্রুতিতে এখন চাকরির নিরাপত্তার সঙ্গে জীবনের নিরাপত্তারও শঙ্কা রয়েছে। আতঙ্ক এখনো কাটেনি।

পুলিশের একাধিক সদস্যের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে কথা বলে জানা যায়, ডিএমপির সেন্ট্রাল কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার আক্রান্ত হওয়ার পর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জুনিয়র সদস্যদের ফেলে পালিয়ে যান। সেদিন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পরিস্থিতি বুঝেও শক্তি প্রয়োগে মনোযোগী ছিলেন। পরবর্তীতে নিজেরা পালিয়ে যান। কিন্তু সাধারণ পুলিশ সদস্যদের কী হবে, সেটা ভাবেননি।

তারা বলেন, এবারের মত আর কখনো এমন নাজুক অবস্থায় পড়েনি পুলিশ। সরকারঘেঁষা কর্মকর্তাদের কারণে সাধারণ অনেক পুলিশ সদস্য মার খেয়েছে, নির্মমভাবে নিহত হয়েছে। জনগণের আস্থা ফেরানোই এখন পুলিশের বড় চ্যালেঞ্জ। সেই বন্দোবস্ত ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।

গত শনিবার সকালে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি কমিশনার মো. মাইনুল হাসান বলেছেন, বাহিনীর যারা অপেশাদার আচরণ করেছেন, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে। বিশেষ কোনো জেলার সদস্যদের দিয়ে ডিএমপি পরিচালিত হবে না, ডিএমপি পরিচালিত হবে পেশাদার কর্মকর্তাদের দিয়ে। তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী এই আন্দোলনে ঢাকা মহানগরের ৫০টি থানার মধ্যে ২২টি থানা পুড়েছে, অনেক পুলিশ নিহত-আহত হয়েছেন, যার জন্য এখনো অনেকে আতঙ্কে আছেন।

এর আগে ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর কর্মস্থলে নিরাপত্তা, সহিংসতায় আহত-নিহতদের ক্ষতিপূরণ, পুলিশ সংস্কারসহ ১১ দফা দাবিতে বিক্ষোভসহ কর্মবিরতি পালন করেছিল পুলিশ। নতুন আইজিপি ময়নুল ইসলাম রাজারবাগে বিক্ষুব্ধ পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে দরবারে বসেছিলেন। সেখানে হট্টগোল হয়। বেশ কিছু দাবি জানানো হয়। আতঙ্ক-নিরাপত্তাহীনতায় ট্রমায় ভোগা পুলিশ সদস্যদের মনোবল ফেরানোর উদ্যোগের কথাও বলেন নতুন আইজিপি।

ইতোমধ্যে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া পুলিশের স্থাপনাগুলো নতুন করে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সারাদেশে থানা, পুলিশ ক্যাম্প, পুলিশ বক্সসহ পাঁচ শতাধিক স্থাপনা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনাগুলোর কম্পিউটারসহ অন্যান্য সরঞ্জাম নষ্ট হয়ে গেছে। কোনো থানা থেকে আগ্নেয়াস্ত্র লুট হয়েছে। মামলার নথি পুড়ে গেছে। এরই মধ্যে দেশের সব কটি থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

ঢাকার কয়েকটি থানায় গিয়ে পুলিশের কর্মতৎপরতা দেখা গেছে। কয়েকটি থানার পুলিশ সদস্য ভোরের আকাশকে বলেন, যদিও আমরা কাজে যোগ দিয়েছি কিন্তু পুলিশ সদস্যরা ট্রমার মধ্যে আছেন এখনও। তবে জনগণ আমাদের নানাভাবে আশ^স্থ করছেন। রয়েছে বিড়ম্বনাও।

রাজধানীর ওয়ারী থানায় কর্মরত পুলিশের সাব ইন্সপেক্টও বাহাউদ্দিন বাবলা ভোরের আকাশকে জানান, গত শনিবার ওয়ারির বিসিসি রোডে পুলিশ হট লাইন ৯৯৯ এর একটি কলের পরিষেবা দিতে গেলে স্থানীয় কয়েকজন ছেলে ভুয়া ভুয়া বলে বুলিং করছিল। তিনি বলেন, পুলিশ যদি বুলিং এর শিকার হয়; নাজেহাল হয় তাহলে পুলিশ আরও আতঙ্কিত হবে।

তিনি বলেন, একজন পুলিশ অপরাধ করলে পুরো বাহিনীর দোষ হয়। কিছু সংখ্যক পুলিশ সদস্যের জন্য এমন ধ্বংসযজ্ঞ মেনে নিতে পারছি না। আমরা যারা অধস্তন আমরা শুধু উপরস্থদের আদেশ পালন করি। আর ব্যক্তিগত যে দুর্নীতির দোষে পুলিশকে দোষারোপ করা হচ্ছে সেটা শুধু পুলিশের মধ্যে না পুরো জাতীর সমস্যা কোথায় দুর্নীতি নাই। যদি সংষ্কার করতে হয় তবে ওপর থেকেই করতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের আইনগুলো পরাধীন যুগের আইন; মানুষ পরিবর্তন হলেও আইন একই থাকে। আর এই আইনের চরিত্রই হচ্ছে দমন পীড়ন। সুতরাং যে আসে সেই তার প্রাধান্য বিস্তার করতে চায়।

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ পরিচালক ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, পুলিশের সবচে বড় যে সমস্যা তা হলো তারা জন মানুষের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে।

একটা টানাপড়েনের সৃষ্টি হয়েছে। সামগ্রিকভাবে আন্দোলনকারীরা পুলিশকে প্রতিপক্ষ ভেবেছে। এটা হয়েছে কিছু সংখ্যক পুলিশের কারণে। তিনি বলেন, ওপর থেকে আদেশ আসলে মাঠে থাকা পুলিশের পক্ষে সম্ভব হয় না আদেশ অমান্য করা। তবে তিনি মনে করেন, পুলিশের এ অবস্থা একদিনে হয়নি; যে জনগণের জন্য পুলিশ তৈরি হয়েছে, জনগণ দীর্ঘ দিন পুলিশ কর্তৃক নানা ধরনের শোষণ, নীপিড়ন, বঞ্চনা, প্রবঞ্চনার শিকার হয়ে আসছে। মোটকথা জন্ম থেকে নিয়ে পুলিশের ভাবমূর্তি কখনোই পরিচ্ছন্ন ছিল না। দীর্ঘ দিনের ক্ষোভ এবার চরম অসন্তোষে রূপ নিয়েছে।

ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, পুলিশের মনে যে ট্রমা ভর করেছে তা দূর করতে শুধু লোগো পরিবর্তন, পোশাক পরিবর্তন করলেই হবে না। আইজি কমিশনারের আদেশ নির্দেশ কিংবা চাকরি হারানোর ভয় তাদের শরীর ও মনে সৃষ্ট এই আঘাত দূর করতে পারবে না। এজন্য সমাজের সকল শ্রেণির মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। যাদের জন্য পুলিশের প্রয়োজন জনগণকে পুলিশের কাছে আসতে হবে। প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে বিভিন্ন প্রকার বৈঠক-সৌহার্দ্য সমাবেশ করতে হবে। আমরা কেমন পুলিশ চাই; পুলিশ আমাদের কাছ থেকে কেমন আচরণ চায়Ñ এমন একটি বোঝাপড়া করতে পারলেই হয়তো আমরা পুলিশের মনের ক্ষত বা ট্রমা দূর করতে পারবো।

পুলিশের মহাপরিদর্শক ময়নুল ইসলাম জানিয়েছেন, জনগণের পুলিশ হতে যা যা করা দরকার, সেভাবেই ঢেলে সাজানো হচ্ছে। খুব শিগগিরই থানাসহ পুলিশের সকল কর্মস্থল সচল হয়ে যাবে।

 

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version