আলোচিত ব্যবসায়িক গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে আসার পর ইসলামী ব্যাংকের ঋণ অনিয়মে নাম আসা রাজশাহীভিত্তিক শিল্প গ্রুপ নাবিলের ঋণ গিয়ে ঠেকেছে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকায়; যেসব ঋণ দিতে নিয়ম না মানার তথ্য উঠে এসেছে বেসরকারি খাতের বৃহত্তম এ ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নথিপত্রে। ইসলামী ব্যাংকের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, গত কয়েক বছরে ঋণ অনিয়মে নাম আসা আলোচিত নাবিল গ্রুপকে নামে ও ভিন্ন নামে ঋণ দেওয়া হয়েছে ইসলামী ব্যাংকের রাজধানীর গুলশান এবং রাজশাহী অঞ্চলের কয়েকটি শাখা থেকে। নিয়ম ভেঙে গ্রুপটিকে বিশেষ সুবিধায় সীমার অতিরিক্ত ঋণ প্রদান করেছে ব্যাংকটি।
ইসলামী ব্যাংকের নথিপত্র পর্যালোচনা করে ও সংশ্লিষ্ট একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নাবিল গ্রুপ দুইভাবে ঋণ নিয়েছে। প্রত্যক্ষ বা সরাসরি ঋণ, আরেকটি হল পরোক্ষ ঋণ। প্রত্যক্ষ ঋণগুলো নাবিলের গ্রুপভুক্ত কোম্পানির নামে হলেও পরোক্ষ ঋণগুলো কাগজে কলমে অন্য কোম্পানির নামে নেওয়া হয়েছে। তবে পরোক্ষভাবে ঋণগুলো ওই সময় নাবিল গ্রুপকেই দেওয়া হয়। এসব কোম্পানি ভিন্ন কয়েকটি শাখা থেকে ৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এক্ষেত্রেও ব্যাংকের একক ঋণ সীমার নিয়ম নীতি মানা হয়নি। আর নাবিল গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানিকে দেওয়া হয়েছে মোট প্রায় তিন হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা। একক ঋণ সীমার নিয়ম এক্ষেত্রেও মানা হয়নি। খবর বিডিনিউজের।
দেশের বৃহত্তম বেসরকারি এ ব্যাংকের ঋণ বিতরণ সংক্রান্ত বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ওই সময় ব্যাংকের প্রভাবশালীদের কথায় কোনো রকম নিরীক্ষা ছাড়াই এসব কোম্পানিকে ঋণ দেওয়া হয়েছে। নামে ভিন্ন হলেও ইসলামী ব্যাংকের নথিপত্রে এ ঋণগুলো স্পষ্ট নাবিল গ্রুপের নামেই রয়েছে।
নাবিল গ্রুপকে ঋণ প্রদান করা শাখা পরিদর্শনের তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ইসলামী ব্যাংক থেকে নাবিল গ্রুপের নামে ঋণ নেওয়া হলেও এর সুবিধাভোগী মূলত ওই সময় ব্যাংকের মালিকানায় থাকা চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ। উত্তরাঞ্চলে চাল, ডাল, গম, চিনি ও ভোজ্যতেলের আমদানিকারক ও সরবরাহকারী হিসেবে এস আলম গ্রুপের সঙ্গে ব্যবসা রয়েছে নাবিল গ্রুপের। ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারাও একই তথ্য দিয়েছেন।
কোনো ব্যাংকের পরোক্ষ ঋণ বলতে ঋণপত্র বা এলসি ঋণ, ব্যাংক গ্যারান্টি, চেক বন্ধক, রপ্তানি ও অভ্যন্তরীণ বিল কেনাকে বুঝায়। ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, ইসলামী ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখাগুলো নাবিল গ্রুপভুক্ত কোম্পানির পক্ষে এসব পরোক্ষ উপাদানের বিপরীতে ঋণ দিয়েছে। সেই ঋণ দীর্ঘদিন ধরে সমন্বয় না করায় বা পরিশোধ না করায় এরইমধ্যে তা ‘ফোর্সড ঋণে’ পরিণত হয়েছে। ২০১৭ সালে ‘জোরজবরদস্তি’ করে ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয় আলোচিত ব্যবসায়িক গোষ্ঠী এস আলম। এরপর এ গ্রুপও যেমন নামে ও ভিন্ন নামে একাধিক কোম্পানি খুলে অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাপক ঋণ নিয়েছে, তেমনি সুবিধাভোগীদেরও সুযোগ করে দিয়েছে বলে খবরে এসেছে। নাবিল গ্রুপেরও বিপুল ঋণ নেওয়ার বিষয়টিও তখন সামনে আসে। এটির সুবিধাভোগীও এস আলম বলে তখন খবরে আসে।
নাবিল গ্রুপের ঋণের বিষয়ে বক্তব্য জানতে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলে তিনি রিসিভ করেননি। নাবিল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিনুল ইসলাম নাবিলের গ্রুপভুক্ত কোম্পানির এবং অন্য কোম্পানির নামে ঋণ নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেননি। গ্রুপভুক্ত ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি কোম্পানি নাবিলের নামে কেন ঋণ নিয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইসলামী ব্যাংক অনুমোদন দিয়েছে। তাই ঋণ নেওয়া হয়েছে। ইসলামী ব্যাংক থেকেই অনুমোদন অনুযায়ী এ ঋণ পাওয়া গেছে। ব্যাংক আইন সম্পর্কে আমি জানি না। তাই এটা আমার বলার কথা না। এ প্রশ্ন আপনি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে করুন।
ইসলামী ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ভিন্ন নামের যেসব কোম্পানি খুলে ঋণ নিতে যেসব ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে সেই ভবনে শুধু সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখা হয়। আসলে সেখানে কোনো কোম্পানির অস্তিত্ব নেই। ভিন্ন নামে কোম্পানি খুলে পরোক্ষ ঋণ সৃষ্টি করা এসব কোম্পানির অস্তিত্ব রয়েছে কি না জানতে চাইলে নাবিল গ্রুপের এমডির দাবি, ‘অস্তিত্ব রয়েছে।’ সম্পূরক আরেক প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা আমার জানার বিষয় না। এটা ইসলামী ব্যাংক জানবে। আমি তো নাবিলের এমডি হিসাবে আপনাকে বলতে পারি না।
ইসলামী ব্যাংকের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, সরাসরি ঋণ হিসেবে নাবিল গ্রেইন ক্রপস লিমিটেডকে ১ হাজার ৭৩ কোটি টাকা, নাবা এগ্রো ট্রেডকে ৭৫৪ কোটি টাকা, নাবিল ফিড মিলসকে ৪১০ কোটি টাকা, নাবিল অটো রাইস মিলসকে ৩৮ কোটি টাকা, নাবিল অটো ফ্লাওয়ার মিলসকে ৭৪ কোটি টাকা, নাবিল নাবা ফুডসকে ৭২৪ কোটি টাকা, শিমুল এন্টারপ্রাইসকে ৮০৯ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এসব কোম্পানিক সব মিলে ৩ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। এসব ঋণ ইসলামী ব্যাংকের গুলশান ও রাজশাহী শাখা থেকে বিতরণ করা হয়েছে। অন্যদিকে পরোক্ষ ঋণ দেওয়া হয়েছে নাবিল গ্রুপের বাইরে ভিন্ন নামে খোলা আট কোম্পানিকে। জামান সিন্ডিকেটকে ১ হাজার ১২৭ কোটি টাকা, সুলতান অ্যাসোসিয়েটকে ১ হাজার ১২৩ কোটি টাকা, মার্কেট মাস্টার এনালাইজারকে ১ হাজার ৯০ কোটি টাকা, নাবা ফার্ম লিমিটেডকে ৫৪৫ কোটি টাকা, এজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে ১ হাজার ৫৩১ কোটি টাকা, আনোয়ার ফিড মিলসকে ১ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা, ইন্টারন্যাশনাল প্রোডাক্ট প্যালেসকে ১ হাজার ১২২ কোটি টাকা ও আনোয়ার ট্রেড ইন্টারন্যাশনালকে ১ হাজার ১১৮ কোটি টাকা।
ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, ২০২২ সালে ইসলামী ব্যাংক থেকে ভুয়া কাগজপত্র ও অস্তিত্বহীন কোম্পানি বানিয়ে এসব ঋণ নেওয়া হয়। কোনো রকম যাচাই বাছাই ছাড়াই বেশির ভাগ ঋণ দেওয়া হয়েছে। তাতে সরাসরি জড়িত ছিলেন ইসলামী ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। কিছু কর্মকর্তার দাবি ঋণ দিতে বাধ্য করা হয়েছে তাদের। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও তাদের ওপর কঠোর কোন পদক্ষেও নেয়নি।
ছয়টি কোম্পানি নিয়ে নাবিল গ্রুপ প্রতিষ্ঠিত। এগুলো হলো- শিমুল এন্টারপ্রাইস, নাবিল অটো ফ্লাওয়ার মিলস, নাবিল ফিড মিলস, নাবিল নাবা ফুড লিমিটেড, নাবিল অটো রাইস মিলস ও নাবিল কোল্ড স্টোরেজ। এসব কোম্পানির বাইরে নাবিল গ্রুপ ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারে না। বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকের প্রধান দপ্তরের কর্মকর্তরা বলেন, সেজন্য ভিন্ন নামে অন্য কোম্পানি খোলা হয়। তারপরও ঋণ বিতরণের সীমা মানা হয়নি।
নাবিল গ্রুপকে ঋণ দেওয়া নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে একটি পরিদর্শন প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সেই প্রতিবেদন বলছে, ওই বছরই ইসলামী ব্যাংক নাবিল গ্রুপকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করেছে। অথচ বিনিয়োগ সীমা ছিল ২৫ শতাংশ, যা ব্যাংক কোম্পানি আইনের সরাসরি লংঘন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসলামী ব্যাংক বিপুল ঋণ বিতরণের ‘দালিলিক প্রমাণও’ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে দেয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, দুটি বিষয় বড় রকমের অনিয়ম ঘটেছে। ইসলামী ব্যাংক নাবিল গ্রুপ ও ভিন্ন নামের কোম্পানি মিলিয়ে মোট ঋণ বিতরণ করেছে ১২ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা। অথচ গ্রুপটির সর্বোচ্চ ঋণ পাওয়ার কথা ছিল ২ হাজার ৬০৪ কোটি টাকা।
ব্যাংক কোম্পানি আইন বলছে, ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণমূলক মূলধন ১০ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা। ফলে একটি গ্রুপকে ইসলামী ব্যাংক সর্বোচ্চ ফান্ডেড ১ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা ও নন-ফান্ডেড ঋণ ১ হাজার ৪২ কোটি টাকা ঋণ দিতে পারে। ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের নথিপত্র বলছে, নাবিল গ্রুপের আওতাভুক্ত কোম্পানিগুলোর ঋণ ৩ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকা। এ ঋণও সীমার অতিরিক্ত। তাতে গ্রাহককে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে একক গ্রাহকের সর্বোচ্চ সীমাও লঙ্ঘন করা হয়েছে। আর বাকি ৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকাই তাদের পরোক্ষ ঋণ।
দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর সংবাদ সম্মেলনে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ে বলেন, এ ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা নামে বেনামে ঋণ বের হয়ে গেছে। তাই এ ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে। তবে লুটপাটে এ ব্যাংকের সঙ্গে কারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওয়তায় আনা হবে। সকল প্রক্রিয়া আইনের মধ্যে থেকে করা হবে।
ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহীর শাখা ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান বলেন, এসব ঋণ আগে বিতরণ করা হয়েছে। এখন এগুলো নিয়ে অনুসন্ধান করা হচ্ছে। আমি নিজেও নতুন যোগ দিয়েছি এ শাখায়। অনিয়ম যা হয়েছে তা নিয়ে আমি কাজ করব। নাবিল গ্রুপকে বিপুল পরিমাণ ঋণ দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী জোনাল অফিসের ভাইস প্রেসিডেন্ট শফিকুল ইসলাম বলেন, কিছু অনিয়ম হয়েছে। তা ইতোমধ্যে আমরা জানতে পেরেছি। তবে আরও পর্যালোচনা করতে হবে। আমি নতুন দায়িত্ব এ এসেছি। এ নিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
নাবিল গ্রুপের ঋণ অনুমোদনের পর ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়, অধিকাংশ ঋণেই কোনো ধরনের জামানত রাখা হয়নি। এ ঋণের অর্থ কোথায় ব্যবহার হবে সেটিও ঋণ প্রস্তাবে পরিষ্কার করা হয়নি। এছাড়া নতুন একটি গ্রুপকে এত টাকা ঋণ দেওয়া হলেও তার পর্যাপ্ত নথি সংরক্ষণ করা হয়নি। এরপর ২০২৩ সালে পরিচালিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক পরিদর্শন প্রতিবেদন বলা হয়, ব্যাংকটির মোট মূলধনের ২৫ শতাংশ ঋণ বিতরণ করতে পারলেও ইসলামী ব্যাংক নাবিল গ্রুপকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করেছে।
ভোরের আকাশ/মি
মন্তব্য