-->
শিরোনাম

স্বৈরাচারের রাজনৈতিক দোসররা কে কোথায়?

এম আর মিজান
স্বৈরাচারের রাজনৈতিক দোসররা কে কোথায়?

ধরাছোঁয়ার বাইরে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক নেতারা। জাতীয় পার্টিসহ শরিক দলগুলোকে অংশগ্রহণ করিয়ে বিগত সময়ের তিনটি জাতীয় নির্বাচনের বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতা আদায়ের চেষ্টা করে আওয়ামী লীগ। শুধু তাই নয়, গত সাড়ে ১৫ বছর ধরে বিদায়ী সরকারের সব অনিয়ম, কু-শাসন ও স্বেচ্ছারিতার সমর্থন দিয়ে এসেছে তারা। কিন্তু সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগ সরকারের ওইসব ব্যর্থতার দায় নিতে রাজি নন তারা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, শেখ হাসিনা সরকারকে যদি জাতীয় পার্টির পাশাপাশি ১৪ দলের এসব নেতারা স্বীকৃতি না দিতেন তাহলে আজ দেশের এ পরিণতি হতো না। স্বেচ্ছাচারি হওয়ার সুযোগ পেতো না আওয়ামী সরকার। আর দলটিকেও এত করুণ পরিণতি ভোগ করতে হতো না। তাই আওয়ামী লীগ সরকারের অপকর্ম ও অপরাধের দায় এড়াতে পারে না শরিকদলের নেতারা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগের টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পেছনে ১৪ দলের শরিকদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে এসব জোটসঙ্গীকে এমপি বানানো হয়েছে, মন্ত্রিত্বও দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতার ভাগাভাগিতে বড় ভূমিকা রেখেছে জাতীয় পার্টি (এরশাদ)। দলটি সব সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে ক্ষমতায় যুক্ত থাকার কৌশল অবলম্বন করেছে। প্রকাশ্যে সমালোচনা করলেও ক্ষমতা ভাগাভাগির ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে সমঝোতার নীতি গ্রহণ করে এসেছে দলটি। এভাবে শরিকদের মধ্যে আওয়ামী লীগের সরকারের কাছ থেকে ক্ষমতার ভাগ পাওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে আছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের হাসানুল হক ইনু, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়া, তরিকত ফেডারেশনের নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী ও জাতীয় পার্টি-জেপির আনোয়ার হোসেন মঞ্জু।

গত ৫ আগস্ট সরকার প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগের পরে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দেশ ছাড়েন। এর পরই দলটির সকল পর্যায়ের নেতারা আত্মগোপনে চলে যান। প্রায় সব নেতা মোবাইল ফোন বন্ধ করে রাখেন। আওয়ামী লীগের শরিক দলের নেতারাও অনেকটা নিশ্চুপ হয়ে যান। তবে ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে স্বাগত জানায় আওয়ামী লীগের শরিক একাধিক দল। এরই মধ্যে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের নামে বিভিন্ন থানায় মামলা হচ্ছে। এর কয়েকটিতে আসামি করা হয়েছে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনুকে। আদালতে অভিযোগ করা হয়েছে তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীর বিরুদ্ধেও। তাদের মধ্যে ইতিমধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ইউটার্ন দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ১৪ দলের অন্য শরিক নেতারা রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

অভিযোগ অনুযায়ী, তেমন কোনো জনসমর্থন না থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে ১৪ দলীয় জোটে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু। প্রতিদান হিসেবে ২০১২-২০১৯ সাল পর্যন্ত পেয়েছেন তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব। ইনুর বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে মিডিয়ার স্বাধীনতা হরণের অভিযোগ আছে। তার সময়েই বন্ধ করা হয় দিগন্ত টেলিভিশন, ইসলামিক টেলিভিশন ও দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা। একই অবস্থা নামসর্বস¦ দল বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের। ২০১৪ সালের মহাজোট সরকার পঠনের পর তিনি পান ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। পরে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয় বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব।

৪ দলের আরেক সমালোচিত নেতা নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী। তরিকত ফেডারেশনের এই নেতা আওয়ামী লীগকে বৈধতা দেওয়ার পাশাপাশি জামায়াত নিষিদ্ধের দাবিতে মামলা করে দেশকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্রেও লিপ্ত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। গত ২৯ জুলাই গণভবনে অনুষ্ঠিত ১৪ দলীয় জোটের বৈঠকে এই নেতা বলেন, ‘কোনো অবস্থাতেই এখন কারফিউ তোলা যাবে না। জামায়াত-শিবির ও বিএনপি এখনো ঘরে ফেরেনি। কারফিউ তোলা হলেও সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এখন মাঠ থেকে তোলা যাবে না। আর ১৫ দিন বা কমপক্ষে এক মাস রাখতে হবে মাঠে।’

জোটের অন্যতম শরিক বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল। ১৯৯১ সাল থেকে এ পর্যন্ত পাঁচটি জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে সবগুলোতেই জামানত হারানো এই দলের সভাপতি দিলীপ বড়ুয়া। ২৯ জুলাই গণভবনের সভা শেষে এই দিলীপ বড়ুয়া বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তার এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত জাতিকে বর্তমান ক্রান্তিকাল থেকে উত্তরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

১৯৯৬ সালে এরশাদের দল জাতীয় পার্টি থেকে বেরিয়ে এসে প্রথমবার সরকার গঠন করতে যাওয়া আওয়ামী লীগের শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগ দেন জাতীয় পার্টি-জেপির আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। পুরস্কার হিসেবে পান ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত যোগাযোগমন্ত্রীর দায়িত্ব। এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে ১৪ দলীয় জোটে যোগ দেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। ২০১৪ সালের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে সরকার গঠনে সহযোগিতার পুরস্কার হিসেবে পান ২০১৪-২০১৮ পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও ২০১৮-১৯ সাল পর্যন্ত পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জেপি থেকে সরাসরি নৌকা মার্কা নিয়ে নির্বাচন করেন তিনি।

নির্বাচনে শরিক দল :২০০৫ সালের ১৫ জুলাই অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ২৩ দফা লক্ষ্য ও কর্মসূচির ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ, ১১ দলীয় জোট, জাসদ ও ন্যাপকে (মোজাফফর) নিয়ে ১৪ দলীয় জোটের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টিসহ মহাজোট নামে নির্বাচনে অংশ নেয় ১৪ দল। ওই নির্বাচনে জোটের শরিক জাসদ তিনটি ও ওয়ার্কার্স পার্টি দুটি আসনে জয়ী হয়। টেকনোক্র্যাট কোটায় জোটের নেতা দিলীপ বড়ুয়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব পান।২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে তরীকত ফেডারেশন ও জাতীয় পার্টি (জেপি) জোটে অন্তর্ভুক্ত হয়। ওই নির্বাচনে সংরক্ষিত দু’জনসহ ১৩ জন সংসদ সদস্য পান ১৪ দলের শরিকেরা। রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনু মন্ত্রী হন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে শরিকদের আটজন সংসদ সদস্য হন। সংরক্ষিত নারী আসন ছিল দুটি। কিন্তু শরিক দলের কেউ মন্ত্রিসভায় স্থান পাননি। সর্বশেষ ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে মাত্র ছয়টি আসনে ছাড় পায় ১৪ দলের শরিকেরা। এর মধ্যে মাত্র দুটি আসনে জয় পায়। মন্ত্রিসভায়ও স্থান হয়নি।

আ. লীগের দায় নেবে না শরিক দল :জোটের শরিক হিসেবে দায় এড়াতে পারেন কি না-এমন প্রশ্নে জাতীয় পার্টির (জেপি) মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের দায় তো নেই। আমরা তো সরকারে ছিলাম না। আমাদের এমপিও ছিল না।’১৪ দলীয় জোটের আরেক শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য কামরুল আহসান বলেন, ‘আমাদের কোনো দায় নেই। কারণ, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তাদের সঙ্গে দূরত্ব ছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পরে আমরা বলার চেষ্টা করেছিলাম, নির্বাচনী ব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণ না থাকলে সেই ব্যবস্থা ধ্বংস হলে তার ফল ভোগ করতে হবে। আমরা দুর্নীতি, টাকা পাচারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে কথা বলেছিলাম। ফলে গত নির্বাচনে আমাদের দূরে ঠেলার জন্য যা যা দরকার, সবই করেছে আওয়ামী লীগ। তার পরও গণতন্ত্রের স্বার্থে নির্বাচনে ছিলাম।’

জোটে আছে তরীকত ফেডারেশনও। দলটির চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীর মোবাইল ফোনে কল দিলে তার ছেলে সৈয়দ তৈয়বুল বশর মাইজভান্ডারী কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘বাবার বক্তব্য সহজ। যে আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বারা এতগুলো সাধারণ মানুষের প্রাণ গেছে, সেই আওয়ামী লীগ বা ১৪ দলের সঙ্গে আমরা নেই।’

তবে সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলেন, ‘দায় তো অবশ্যই পড়বে। এগুলো নিয়ে আমরা মূল্যায়ন করব। সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।’

 

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version