- মানা হচ্ছে না কোনো নিয়মকানুন
- সড়কগুলো হয়ে উঠছে অনিরাপদ
রাজধানীজুড়ে বেপরোয়াভাবে চলাচল করছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। প্রধান প্রধান সড়কে এগুলোর চলাচলের ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গতকাল সকাল থেকেই দুপুর পর্যন্ত রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সড়ক পরিদর্শন করে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। স্থানীয়ভাবে তৈরি বিভিন্ন ডিজাইনের এসব বাহনের চালকদেরও কোনো প্রশিক্ষণ নেই। যে যার মতো করে রিকশার বডি নির্মাণ করে ব্যাটারি লাগিয়ে চালকদের কাছে দৈনিক ভিত্তিতে ভাড়া দিচ্ছেন, দিন শেষে আদায় করছেন ভাড়ার টাকা। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তীব্রতর হওয়ায় বাস, অটোরিকশা ও অটোটেম্পুসহ যাত্রীবাহী যানবাহনের সংখ্যা মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ার সুযোগে ঢাকার সড়কগুলোতে বেড়ে যায় ব্যাটারিচালিত রিকশার দৌরাত্ম্য। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ঝুঁকিপূর্ণ এ বাহনের সংখ্যা আকস্মিকভাবে বেড়ে যায়।
পরিবহন বিশেষজ্ঞসহ সড়ক দুর্ঘটনাবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত সামাজিক সংগঠনগুলোর নেতারা বলছেন, কোনো নীতিমালা ছাড়াই রাজধানীর সব সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলছে। এতে সড়কগুলো অনিরাপদ হয়ে উঠছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও। তবে কেউ কেউ এ জন্য সদ্যক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই বেশি দায়ী করেন। তার একক ইচ্ছায়ই ঢাকায় এই বাহন চলাচলের সুযোগ পেয়েছে বলে অভিযোগ করেন তারা।
ব্যাটারিচালিত রিকশার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে রিকশা শ্রমিকদের একাধিক সংগঠনসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ঢাকা মহানগরীতে প্রায় এক লাখ এই বাহন চলাচল করে। তিন মাস আগেও এই সংখ্যা ছিল আনুমানিক ৩০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার। তখন দিনে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় এবং রাতে ছোট ছোট সড়কে এগুলো চলাচল করতো। দুই বছর আগে উচ্চ আদালতে দায়ের করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে রাজধানীতে এই রিকশা চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন আদালত। এরপর ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা কমে আসে এবং পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে কিংবা পুলিশকে ম্যানেজ করে সীমিতভাবে চলাচল করতে থাকে।
গত মে মাসে তৎকালীন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধে অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন। এরপর এ বিষয়ে পুলিশ তৎপর হয়। এতে চরম ক্ষুব্ধ হয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশার শত শত শ্রমিক রাস্তায় নামেন এবং নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবিতে রাজপথ উত্তপ্ত করেন তোলেন। অনেক স্থানে তাদের সঙ্গে পুলিশের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষও হয়। এমনকি পুলিশবক্স ও পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে। এরই এক পর্যায়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করবে; তবে ভিআইপি সড়কগুলো চলবে না। তবে এমন ঘোষণা দেওয়ার আগে তিনি একবারও ভেবে দেখলেন না যে, এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ বাহন চলাচলের ওপর উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অর্থ্যাৎ আদালতের আদেশকে তোয়াক্কাই করলেন না শেখ হাসিনা। আর প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি পেয়ে রাজধানীতে বাড়তে থাকে ব্যাটারিচালিত রিকশা। বিভিন্নজন যে যার মতো করে এই বাহনের বডি নির্মাণ করে চালকদের কাছে ভাড়া দিতে থাকেন।
তবে বিভিন্ন মহলের মতামত ও দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ঝুঁকিপূর্ণ এ বাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য ঢাকা মহানগর পুলিশ জুলাইয়ের প্রথমদিকে এ সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয় এবং নীতিমালা চূড়ান্ত হওয়ার আগে রিকশা চলাচল সীমিত করার নির্দেশনা জারি করে। তবে বৈষম্যবিরোধী তীব্র ছাত্র আন্দোলনের কারণে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ রাজধানীতে বাস, অটোরিকশা ও অটোটেম্পুসহ যাত্রীবাহী যানবাহনের সংখ্যা মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। এতে মহানগরীর কর্মজীবীরা তীব্র যানবাহন সংকটে পড়েন। এই সুযোগে রাতারাতি বাড়তে থাকে ব্যাটারিচালিত যানবাহন। আর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর কয়েকদিনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং ঢাকাসহ দেশজুড়ে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নিয়ে রাজধানীর সকল সড়ক দখল করে নেয় তিন চাকার এই বাহন।
তবে, এসব বাহন কোনো নিয়মকানুন ছাড়াই যত্রতত্র চলাচল করছে। গতকাল অন্যতম ভিআইপি এলাকা কাকরাইল, মিন্টু রোড, হেয়ার রোডসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সড়কে এমন চিত্র দেখা গেছে। ভিআইপি সড়কগুলোতেও অন্যান্য যানবাহনের মতো অতিরিক্ত গতিতে চলাচল করছে এই রিকশা। ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে। এসব স্থানে ট্রাফিক পুলিশ থাকলেও বেআইনিভাবে চলাচলকারী ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। কাকরাইলের তবলিগ জামাতের মসজিদ মোড়ে দায়িত্বরত এক ট্রাফিক সার্জেন্ট নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভোরের আকাশ’কে বলেন, নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো মূল সড়কে চলাচল করছে। কিন্তু ওপরের নির্দেশনা না থাকায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।
মো. আলম নামের এক অটোরিকশা চালক বলেন, দেশ এখন স্বাধীন হয়ে গেছে। আমরা এখন যেখানে খুশি সেখানে গিয়ে রিকশা চালাবো। এখন আর আমাদের অনুমতি নেওয়া লাগে না। ভিআইপি এলাকায় ঢুকে অতিরিক্ত গতিতে রিকশা চালানোর বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বিষয়টিকে এড়িয়ে দ্রুত রিকশা চালিয়ে অন্যত্র চলে যান।
অন্যদিকে, চোখে-মুখে হতাশা নিয়ে বসে আছেন পায়ে চালিত রিকশাচালক মো. লিটন। দিনকাল কেমন কাটছে জিজ্ঞসা করলে তিনি বলেন, ‘অটোরিকশা রাস্তায় চলাচলের কারণে আমরা যারা প্যাডেল- রিকশা চালাই, আমাদের ইনকাম একেবারেই কমে গেছে। অটোরিকশা তিন-চারজনকে একসঙ্গে বহন করে কম ভাড়ায় যেতে পারে। কারণ তাদের কষ্ট তুলনামূলক কম হয়, সময়ও কম লাগে। ব্যাটারি রিকশার কারণে আমাদের আয়-রোজগারে ভাটা পড়েছে।’
সোমবার (২৬ আগস্ট) বেলা ১১টার দিকে পায়ে চালিত রিকশা নিয়ে শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেন শত শত চালক। এতে মোড়ের চারপাশে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
এ সময় ‘চলবে না চলবে না, অটোরিকশা চলবে না’, ‘অবৈধ অটোরিকশা চলতে দেওয়া হবে না’, ‘বাংলাদেশে বৈষম্য মানি না মানবো না’সহ নানা স্লোগান দিতে থাকেন প্যাডেল চালিত রিকশাচালকরা।
বৃহত্তর ঢাকা সিটি করপোরেশন রিকশা মালিক ঐক্যজোটের ব্যানারে এ অবরোধ কর্মসূচি পালন করছেন চালকরা। এ সময় তারা বেশ কিছু দাবি উত্থাপন করেন।
তাদের দাবিগুলো হলো, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মতো ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন থেকে রিকশা মালিকরা নতুন লাইসেন্স প্রদান ও পুরাতন লাইসেন্স নবায়ন করতে হবে; সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে ও বৈধ লাইসেন্সধারী রিকশা পেশাজীবীদের স্বার্থে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে চালক লাইসেন্স দিতে হবে। অসুস্থ চালকদের ফ্রি ফ্রাইডে মেডিক্যাল চিকিৎসা দিতে হবে; ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের লাইসেন্সপ্রাপ্ত রিকশা পেশাজীবীদের ব্যবসায়িক ট্রেড লাইসেন্স দিতে হবে।
তাদের দাবি, আগে এলাকার অলিগলিতে অটোরিকশা চলতো, এখন তারা প্রধান সড়কে অটোরিকশা চালায়। প্রধান সড়কে অটোরিকশা ট্রাফিক আইন মেনে চলে না। এদের কারণে যানজট তৈরি হয়, দুর্ঘটনা ঘটে। ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা ইনকামের জন্য নিয়ম না মেনে ইচ্ছা মতো চালায়।
উল্লেখ্য, ১৫ মে সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম বৈঠকে সড়কে শৃঙ্খলা আনতে রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়। ওই বৈঠকে তৎকালীন সড়কমন্ত্রী নিজেই রিকশা বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এরপর ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে অভিযানে নেমেছিল পুলিশ।
২০ মে ডিএমপির তখনকার অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) ড. খ. মহিদ উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মূল সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধ থাকবে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা পাওয়ার পর আমরা ব্যবস্থা নেব, কোথায় চলবে আর কোথায় চলবে না।’
ভোরের আকাশ/ সু
মন্তব্য