- নতুন এলাকা প্লাবিত
- মৃত্যু বেড়ে ২৭
- পানিবন্দি এখনো ১২ লাখ মানুষ
- ক্ষুধার জ্বালায় কাঁদছে শিশুরা
উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর টানা প্রবল বর্ষণে সৃষ্ট বন্যায় দেশের ১১ জেলার ১২ লাখ মানুষ এখনো পানিবন্দি। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বন্যায় মৃত্যু বেড়ে ২৭ জনে দাঁড়িয়েছে। লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে ফেনীতে। তবে পানি নামছে ধীরগতিতে। এই তিন জেলায় বন্যাকবলিত প্রত্যন্ত এলাকাগুলোয় সুপেয় পানি ও খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। নৌযানের অভাবে স্বেচ্ছাসেবীরা ত্রাণসামগ্রী পৌঁছাতে পারছেন না। ক্ষুধার জ¦ালায় কাঁদছে শিশুরা।
জানা গেছে, নোয়াখালী থেকে রহমতখালী খাল হয়ে বন্যার পানি ঢুকছে লক্ষ্মীপুরে। এতে পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। জেলার প্রায় সাত লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। প্রায় ২৩ হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে। বেশিরভাগ মানুষ কষ্ট করে বাড়িঘরেই রয়েছে। দুর্গম এলাকায় ত্রাণ পৌঁছাতে পর্যাপ্ত নৌকার প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহান বলেন, ৭ লাখ ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে ২৩ হাজার ৪০৪ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। এখন পর্যন্ত ৯ হাজার ৯৪৩ প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। এদিকে, উজান থেকে আসা পানির চাপ এবং প্রবল বৃষ্টির কারণে নোয়াখালীর বন্যা পরিস্থিতিরও অবনতি হয়েছে। ৯টি উপজেলার মধ্যে আটটিতেই বন্যার পানি বেড়েছে। পরিস্থিতি বেশি খারাপ হয়েছে সেনবাগ, বেগমগঞ্জ, সদর, সোনাইমুড়ী ও চাটখিল উপজেলায়। এসব উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকাগুলোয় সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ পৌঁছানো যাচ্ছে না বলে জানা গেছে। এ পর্যন্ত জেলায় বন্যায় পাঁচজনের মৃত্যু হলো।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নোয়াখালী কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আমির ফয়সাল বলেন, উজান থেকে ধেয়ে আসা পানি ও অতিবৃষ্টির চাপ নিতে না পারার কারণে স্লুইসগেটটি ভেঙে গেছে বলে তারা ধারণা করছেন। ফলে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম, নাঙ্গলকোট, ফেনী সদর, দাগনভূঞা, সোনাগাজীর একাংশ এবং নোয়াখালীর সেনবাগ ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার একাংশে জমে থাকা বন্যার পানি দ্রুত নামতে পারবে না। পাশাপাশি সাগরে যখন বেশি জোয়ার হবে, তখন লোনা পানিতে আশপাশের এলাকা প্লাবিত হতে পারে।
ফেনীতে বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সংকট : বন্যায় পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হয়েছে ফেনীতে। এখানকার ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী, পরশুরাম, ফেনী সদর, দাগনভূঞা ও সোনাগাজী-এ ছয় উপজেলা পুরোপুরি বন্যাকবলিত। পানি কমছে ধীরে ধীরে। প্রত্যন্ত ও দুর্গম গ্রামগুলোয় পানি ও খাবারের সংকট রয়েছে। বিশেষ করে কহুয়া, মুহুরী ও সিলোনিয়া নদী-লাগোয়া গ্রামগুলোয় ঢুকতেই পারছেন না স্বেচ্ছাসেবকরা। গ্রামগুলোর দোতলা ভবন পর্যন্ত ডুবে গেছে।
চট্টগ্রাম থেকে ত্রাণ নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক নাফিজ উদ্দিন জানান, তারা ২০০ প্যাকেট শুকনা খাবার নিয়ে গেছেন। কিন্তু নৌকা না পাওয়ায় দুর্গম গ্রামে যেতে পারেননি। তাই হেঁটে যত দূর যেতে পেরেছেন, সেখানেই ত্রাণ বিতরণ করেছেন। লস্করহাটের শোয়াব মিয়া নামে একজন জানান, পানি বেশি হওয়ায় তাদের গ্রামে কেউ ত্রাণ নিয়ে যায়নি। বিশুদ্ধ পানি আর খাবারের জন্য মানুষ হাহাকার করছে।
জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার বলেন, দেড় লাখ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৬২ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার এবং ১ হাজার ৩০০ টন চাল দেওয়া হয়েছে।
পানি কমছে কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে : কুমিল্লায় গোমতী নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে বন্যাকবলিত এলাকাগুলো থেকেও একটু একটু করে পানি নামতে শুরু করেছে। তবে এখনো অনেক মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে। কুমিল্লার জেলা প্রশাসক খন্দকার মুশফিকুর রহিম জানান, যেখান থেকে যে তথ্য পাচ্ছেন সেভাবে বন্যাদুর্গতদের জন্য ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি, হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলায়ও পানি কমেছে। ফটিকছড়ির আশ্রয়কেন্দ্রে আসা মানুষজন বাড়িতে ফিরে গেছে। তবে পানি জমে থাকায় হাটহাজারীর কয়েক শ মানুষ এখনো ঘরে ফিরতে পারেনি।
উপকূলীয় দ্বীপ ও নিচু এলাকা প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা : বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া সুস্পষ্ট লঘুচাপের কারণে প্রচুর মেঘ তৈরি হচ্ছে। মৌসুমি বায়ু দ্রুত শক্তি অর্জন করছে। এবার দেশের উপকূলের অন্য তিন এলাকা চট্টগ্রাম, বরিশাল ও খুলনায় ভারী বৃষ্টি শুরু হয়েছে। লঘুচাপের প্রভাবে উপকূলীয় দ্বীপ ও নিচু এলাকায় জলোচ্ছ্বাস এবং নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে।
মৃত্যু বেড়ে ২৭ : সপ্তাহ খানেক ধরে দেশে যে বন্যা চলছে তাতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ২৭ জনে দাঁড়িয়েছে। বেশির ভাগ জায়গায় পরিস্থিতির উন্নতি হলেও এখনো পানিবন্দি আছে ১২ লাখ ৭ হাজার ৪২৯টি পরিবার। গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে এ তথ্য জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী রেজা। তিনি জানান, বন্যায় কুমিল্লায় মারা গেছে ১০ জন, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামে পাঁচজন করে এবং কক্সবাজারে তিনজন মারা গেছে। এছাড়া ফেনী, খাগড়াছড়ি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও লক্ষ্মীপুরে মারা গেছে একজন করে। বন্যায় বর্তমানে ১১ জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৫৬ লাখ ১৯ হাজার ৩৭৫ জন। দুর্গতদের জন্য তিন হাজার ৮৮৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা আছে জানিয়ে তিনি বলেন, এসব আশ্রয়কেন্দ্রে পাঁচ লাখ ৯ হাজার ৭২৮ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। পাশাপাশি ৩৪ হাজার ৪২১টি গবাদি পশুও সেখানে আশ্রয় পেয়েছে।
কাঁদছে শিশুরা : কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ফকিরবাজার উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছেন দুই শতাধিক বানভাসি মানুষ। তাদের মধ্যে অন্তত ১৫ জন শিশু। যাদের মধ্যে ১ থেকে ৩ বছরের শিশু আছে অন্তত ১০ জন। এসব শিশুদের মধ্যে যাদের বয়স ৩ বছরের ওপরে তাদের শুকনো বিস্কুট ও কলা খাইয়ে কোনোরকম দিন পার করা যাচ্ছে। যাদের বয়স এক থেকে তিন বছরের মধ্যে সেসব শিশুদের নিয়ে মহাদুশ্চিন্তায় আছেন তাদের অভিভাবকরা। এসব শিশুরা সবসময় যে খাবারে অভ্যস্ত তারা এখন তা পাচ্ছে না। যার কারণে প্রতিনিয়ত কান্না করছে। আর বাবা-মায়ের কাছে খাবার চাইছে। কিন্তু অসহায় বাবা-মা খাবার দিতে না পেরে নিজেরাও কান্নায় ভেঙে পড়ছেন।
বাকশিমুল গ্রাম থেকে আশ্রয়কেন্দ্রটিতে স্ত্রী ও দুই বছরের মেয়ে মরিয়মকে নিয়ে এসেছেন জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, মাস দুয়েক আগে মায়ের দুধ খাওয়া ছাড়ছে মরিয়ম। দুই বছর বয়সী মেয়েটা শক্ত কোনো খাবার খেতে চায় না। গরুর দুধ মিশিয়ে নরম ভাত ও সুজি খাওয়ানো হতো তাকে। কিন্তু গত তিনদিন মেয়েটা আমার অনেক কষ্টে আছে। চিড়া-মুড়ি দিলে খায় না। দুধ খেতে চায়। আমি তাকে কোথা থেকে দুধ দেব বলেন?
উপজেলার বাকশিমুল এলাকার দিনমজুর কামাল হোসেন বলেন, বৃহস্পতিবার রাত থেকে পানিতে তলিয়ে যেতে শুরু করে বুড়িচং। ভেবেছিলাম পানি কমে যাবে বা ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামত করা হবে- এজন্য বাড়িতে ছিলাম শনিবার পর্যন্ত। কিন্তু কিছুই হয়নি। ঘরের ভেতরে কোমরসমান পানি দেখে স্থানীয় আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছি। কিন্তু খাবার না থাকায় দুই বছরের মেয়েটা বারবার কান্না করছে। আশ্রয় কেন্দ্রে চিড়া-মুড়ি দেয়। এসব মেয়েটা খেতে চায় না। অসহায় এই বাবা বলেন, অনেক কষ্টে শুকনো বিস্কুট আর কলা দিয়েছি। কিন্তু মেয়েটার কান্না থামছে না। টাকার অভাবে মেয়েটাকে একটু দুধও কিনে খাওয়াতে পারছি না। কারণ আমি এক নিঃস্ব বাবা।
বুড়িচংয়ের ফকির বাজার এলাকার বাসিন্দা মানিক মিয়া বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে গোমতী নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভাঙার পর পানিতে তলিয়ে যায় পুরো উপজেলা। আমাদের গ্রামে শুকনো জায়গা নেই। ঘরের ভেতর পানি উঠে গেছে। তাই স্ত্রী ও দেড় বছরের শিশু সন্তানকে নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছি। কিন্তু শিশুটির খাবার নিয়ে তীব্র সংকটে পড়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা চিড়া মুড়ি খেয়ে থাকতে পারলেও আমার ছেলেটা এসব খেতে চায় না। আশ্রয়কেন্দ্র ও গ্রামের অন্য শিশুদেরও একই অবস্থা। যারা ত্রাণ নিয়ে আসছেন তারা যেন শিশুদের কথাও মাথায় রাখেন- এটাই আমার অনুরোধ। পানিতে তলিয়ে গেছে জেলার মনোহরগঞ্জ উপজেলার মান্দুয়ারা গ্রামটিও। ওই গ্রামের বাবুল মিয়া স্ত্রী ও ২২ মাস বয়সী শিশুকে নিয়ে এসেছেন স্থানীয় একটি আশ্রয়কেন্দ্রে। কিন্তু এখানে শিশুদের কোনো খাদ্য দেওয়া হয় না। যার কারণে চরম কষ্টে দিন কাটছে তার। বাবুলের বড় ছেলে মাসুমের বয়স ৪ বছর। সেও মুড়ি খেয়ে থাকতে চায় না। বাবুল মিয়া বলেন, পুরো আশ্রয়কেন্দ্রে ২০ জনের মতো শিশু আছে। রাত হলে শিশুদের কান্নায় কেউ ঘুমাতে পারে না। ক্ষুধার জ্বালা শিশুরা মুখ ফুটে বলতে পারে না, শুধু কান্না করে।
জেলার চৌদ্দগ্রাম সদরের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা দিদার হোসেন বলেন, ছোট্ট দুইটা শিশু সন্তানকে নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছি চারদিন হলো। গত দুদিন ধরে আশ্রয়কেন্দ্রে দেওয়া খাবার খেতে চাচ্ছে না শিশুরা। বিভিন্ন মাধ্যমে বড়দের জন্য খাবার এলেও শিশুদের জন্য খাবার আসছে না। মুড়ি-চিড়া, শুকনো বিস্কুটসহ বড়দের খাবার একেবারেই মুখে নিতে চায় না বাচ্চারা।
জেলার বুড়িচং উপজেলার ভরাসার উচ্চ বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছেন বানভাসি স্থানীয় ইছাপুরা এলাকার রুমা আক্তার ও জয়নাল আবেদীন। তাদের কোলে ১৬ মাসের ছেলে আব্দুল্লাহ। এই দম্পতি বলেন, আব্দুল্লাহ এখনও মায়ের দুধ খায়। তিনদিন ধরে আশ্রয়কেন্দ্রে আছি। আশ্রয়কেন্দ্রে ওঠার পর থেকে বুকের দুধ একেবারেই মুখে নিতে চাচ্ছে না ছেলেটা। আশ্রয়কেন্দ্রে অপরিচিত মানুষ আর মানুষের কোলাহল থাকে সবসময়। মানুষের কারণে যত্ন করে দুধ খাওয়ানোর সঠিক পরিবেশ থাকে না। ফলে শিশু আব্দুল্লাহর খাদ্য নিয়ে দুশ্চিন্তায় মা-বাবা। নিয়মমতো খাবার মুখে না নিলে পুষ্টিহীনতাসহ নানান স্বাস্থ্য ঝুঁকির আশঙ্কা করে সরকার ও মানবিক সংগঠনগুলোর প্রতি শিশুখাদ্য সহায়তা প্রদানের আহ্বান জানান এই দম্পতি। শিশুদের খাদ্য সংকটের বিষয়ে কেন্দ্রীয় বিএনপির ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিষয়ক সম্পাদক এবং কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক হাজী আমিন উর রশিদ ইয়াছিন বলেন, শুকনো খাবারের পাশাপাশি আমরা খিচুড়ি বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছি। তবে বন্যা দুর্গত এলাকায় মূল সমস্যা হলে নৌযান সংকট। নৌযান সংকটের কারণে রান্না করা খিচুড়ি সব জায়গায় পৌঁছানো যাচ্ছে না। দেখা গেছে কয়েক ঘণ্টার বেশি সময় রাখলে খাবার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) পঙ্কজ বড়ুয়া বলেন, শিশুদের বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা সংশ্লিষ্ট সবাইকে দিকনির্দেশনা দিচ্ছি। বন্যাকবলিত মানুষের মাঝে শুকনা খাবার, স্যালাইন ও ওষুধ বিতরণ করা হচ্ছে। অন্যান্য ত্রাণসামগ্রী বিতরণও অব্যাহত আছে। আমরা সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর রাখছি।
ভোরের আকাশ/ সু
মন্তব্য