-->

‘স্বজনের লাশের জন্য অপেক্ষা’

ভোরের আকাশ ডেস্ক
‘স্বজনের লাশের জন্য অপেক্ষা’

রূপগঞ্জের রূপসীতে গাজী টায়ারস কারখানায় আগুন লাগার পর ছেলেকে খুঁজতে আসার পর থেকে নিখোঁজ ভাইয়ের লাশটা অন্তত পেতে চান রফিকুল ইসলাম রতন। গতকাল মঙ্গলবার সকালে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া কারখানার প্রধান ফটকের সামনে বিলাপ করতে করতে তিনি বলছিলেন, আমার ভাইরে খুঁইজা দেন গো। আমার ভাইয়ের লাশটাও পাইতেছি না গো।

রূপগঞ্জ উপজেলার কলাবাগান এলাকার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম রতনের ভাতিজা ইয়াসিন গাজী টায়ারস কারখানার টিউব সেকশনের কর্মী ছিলেন। রোববার রাতে কারখানাটিতে লুটপাটের পর দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনের ঘটনার পর রতনের ভাই আব্দুল মোতালেব (৪০) তার কিশোর ছেলেকে খুঁজতে কারখানায় এসছিলেন। পরে ইয়াসিন বাড়িতে ফিরলেও তার বাবার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানান রতন। রোববার রাত থেকেই জাতীয় পরিচয়পত্র ও ছবি হাতে ভাইয়ের খোঁজে কারখানার সামনে অপেক্ষায় আছেন তিনি। ভাইকে ‘জীবিত পাবার আশা’ নেই জানিয়ে মঙ্গলবার সকালে তিনি বলেন, আমার ভাইরে তো জিন্দা পামু না। লাশটাও পাইতেছি না গো ভাই। লাশটারেও খুঁইজা দিতেছে না কেউ।

আল্লার কাছে কী দোষ করছি গো, আমার ভাইডারে নিলো গা। ভাতিজারে খুঁজতে আইয়া ভাইয়ে নিজেই ফাঁইসা গেছে গা। আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজীর মালিকানধীন কারখানাটিতে লুটপাটের পর রোববার রাতে ছয়তলা একটি ভবনে আগুন দেওয়া হয়। এর ৩২ ঘণ্টা পর মঙ্গলবার ভোর ৫টার দিকে আগুন নেভাতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিস। তবে বেলা ১টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ভবনটিতে উদ্ধার অভিযান শুরু করতে পারেনি তারা।

ভবনটি নাজুক অবস্থায় থাকায় এখন পর্যন্ত ভেতরে ঢুকে উদ্ধার অভিযান শুরু করা যায়নি বলে সকাল ১০টায় জানান ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক আনোয়ারুল হক। তিনি বলেন, ভোর ৫টার দিকে আগুন নেভাতে সক্ষম হয়েছেন তারা। তবে ভেতরের উত্তাপ থেকে আবারও আগুন ধরে যেতে পারে শঙ্কা রয়েছে। এদিকে, রোববার লুটপাটের পর ভবনটিতে আগুন দেওয়া হলে ভেতরে থাকা শতাধিক ব্যক্তি আর বের হতে পারেননি বলে দাবি নিখোঁজদের স্বজনদের। গত সোমবার বিকাল পর্যন্ত নিখোঁজ ১৭৪ জনের একটি তালিকাও করে ফায়ার সার্ভিস। তবে উদ্ধার অভিযান শুরু না হওয়ায় নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনদের অপেক্ষার শেষ হচ্ছে না। সোমবার মধ্যরাত পর্যন্তও কারখানার সামনে অপেক্ষমান ছিলেন তারা। পরে রাতে যারা বাড়িতে ফিরেছিলেন তারাও ভোর থেকে আবারও কারখানার সামনে নিখোঁজ স্বজনদের অন্তত লাশটা পাবার অপেক্ষায় আছেন।

নিখোঁজদের মধ্যে আছেন ৩৫ বছর বয়সী আলী নূর। গাউসিয়া এলাকায় তার একটি মাছের খামার রয়েছে। ছেলের ছবি হাতে কারখানার সামনে রাস্তায় বসে কাঁদছিলেন তার বৃদ্ধা মা লিলি বেগম। লুটপাট চলাকালীন আলী নূর কারখানাটিতে এসেছিলেন জানিয়ে এই বৃদ্ধা বলেন, ছেলের সঙ্গে তিনিও কারখানাটি এসেছিলেন। লিলি যখন ভবনটির নিচে ছিলেন, আলী ছিলেন ভবনর উপরে। আগুনের ঘটনার পর আর বের হতে পারেননি আলী। আমি দেহি চারদিকে খালি ধুয়া আর ধুয়া (ধোঁয়া)। পোলারে ডাকি, খুঁইজা পাই না। পোলায় আর বাইর হইতে পারে নাই। ও আলী নুর রে তোর মাছ কেডায় পাহারা দেয়। তুই কিয়ের লাইগা এইহানে আইছিলি। বাবারে তুই কেন এইহানে আইছোত। তোর মার বুকটা তো খালি রে আলী নূর, এই বলে বুক চাপড়ে কাঁদছিলেন লিলি। এ প্রতিবেদকের কাছে বারবার আকুতি জানিয়ে তিনি বলছিলেন, বাবাডার লাশটা খালি আইন্না দেও। রোববার ভোররাতে রাজধানীর শান্তিনগর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজী।

তার গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়ার পরপরই স্থানীয় কিছু মানুষ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের একটি মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে লোকজন জড়ো করে; পরে তারা তারাবো রূপসী এলাকায় গাজী টায়ারসের কারখানায় হামলা চালায় এবং লুটপাট শুরু করে। দিনভর লুটপাট চালিয়ে রাত ৯টার দিকে কারখানায় আগুন লাগিয়ে দেয় তারা। রোববার রাতে লুটপাটের সময় কারখানায় আসা আশপাশের অনেক মানুষ নিখোঁজ রয়েছেন বলে স্বজনরা দাবি করেছেন। তারা সোমবার দিনভর কারখানার সামনে নিখোঁজদের খোঁজে আহাজারি করেছেন। নিখোঁজের নাম সেখানে দায়িত্বরত ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সদস্যদের কাছে দিয়েছেন স্বজনরা। মঙ্গলবার সকালেও কারখানার সামনে নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনদের ভিড় দেখা গেছে। এর আগে গণঅভ্যুত্থানের মুখে ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এক দফায় গাজীর রূপসী ও কর্ণগোপের দুটি কারখানায় হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছিল।

ভোরের আকাশ/ সু

মন্তব্য

Beta version