-->
শিরোনাম

পলিথিন ব্যাগের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হচ্ছে

হেলাল সাজওয়াল
পলিথিন ব্যাগের বিরুদ্ধে
অভিযান শুরু হচ্ছে

নিষিদ্ধ হলেও দেশে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার থামছে না। বরং দিন দিন এর ব্যবহার বাড়ছেই। কাঁচাবাজার থেকে শপিং মল সব পণ্য বহন করার জন্যই ভরসা এই পলিব্যাগ। ৫ টাকার কাঁচা মরিচ কিনলেও দোকানি অবলীলায় দিয়ে দেন পলিব্যাগে। এতে মারাত্মকভাবে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে পলিথিন ব্যাগের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে যাচ্ছে সরকার। আগামী মাসেই এ অভিযান শুরু হতে পারে। কিন্তু পলিথিন ব্যাগের বিকল্প হিসেবে পাটের পলিমার ব্যাগ বাজারজাত করার উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। কিন্তু সেই উদ্যোগ তেমন আগায়নি।

 

জানা গেছে, ২০০২ সালে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়। আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় পলিথিন এখন ছড়িয়েছে সর্বত্র। মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে বাজারে নেই বিকল্প কোন পণ্য। মাঝে মাঝে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। অন্তর্বর্তী সরকারের বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, সেপ্টেম্বরে শুরু হবে পলিথিনের বিরুদ্ধে অভিযান। তবে বাজারে বিকল্প না দিয়ে অভিযান কোন ফল বয়ে আনবে না বলে মনে করছেন কেউ কেউ।

পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে বিবেচনা করে ২০০২ সালে ‘পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫’- এর পরিপ্রেক্ষিতে পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার, উৎপাদন, বিপণন ও পরিবহন নিষিদ্ধ করা হয়। আইনের ২৫ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিনসামগ্রী উৎপাদন করে, তাহলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। সেই সঙ্গে পলিথিন বাজারজাত করলে ছয় মাসেই জেলসহ ১০ হাজার টাকার জরিমানার বিধান করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে বাজারগুলোয় প্রকাশ্যে ব্যবহার করা হলেও এ আইনের কোনো প্রয়োগ নেই। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সরকার পতনের পর দেশের সকল সেক্টরের মত পরিবেশের জণ্য হুমকি এমন বিষয়গুলো নিয়ে সোচ্চার সংশ্লিষ্ট মহল।

সেই ধারাবাহিকতায় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, পলিথিনের বিরুদ্ধে আগামী সেপ্টেম্বর থেকে অভিযান কার্যক্রম শুরু হবে। গত ২১ আগস্ট দুপুরে সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জানান তিনি।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অভিযান শুরুর তারিখ এখনো নির্ধারণ হয়নি। কারণ এর সঙ্গে আরও কয়েকটি সংস্থা সম্পৃক্ত। এখন সবাই একটা আন্দোলনের মুডে আছে। সবাই সবার দাবি পেশ করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ওইদিকে ব্যস্ত আছে। তবে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই আপনারা কার্যক্রমের শুরু দেখতে পারবেন।

কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজারে প্রয়োজন রয়েছে বলেই পলিথিনের ব্যবহার বেড়েছে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ যেমন হয় না তেমনি বাজারে পলিথিনের পর্যাপ্ত বিকল্প নেই। পলিথিন কেন ব্যবহার করতে হচ্ছে। বাজার করে সেটা বাসায় বহন করে নিয়ে যাওয়ার জন্য এখন পলিথিন ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বাজারে দোকানি এবং ভোক্তাকে একটা কিছু দিতে হবে যেটা পলিথিনের মতো সহজলভ্য এবং সমমূল্যের। তারা বলছেন এটা পাট দিয়ে পূরণ করা সম্ভব। পলিথিন সদৃশ পাটের তৈরি একই জিনিস বাংলাদেশে তৈরি করা সম্ভব। এখন দরকার উদ্যোগ। পলিথিন বন্ধ করতে হলে প্রথমে এর বিকল্প তৈরি করতে হবে। বাজারে পলিথিনের কোনো বিকল্প সরবরাহ নিশ্চিত না করে অভিযান কোনো ফল বয়ে আনবে না। উপরন্তু একটি মহল তাদের বিনিয়োগ নিয়ে ভোগানিততে পড়বেন।

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পরিবেশ দূষণের জন্য যেসব উপাদানকে সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয়, তার মধ্যে পলিথিন অন্যতম। পলিথিন পরিবেশ সুরক্ষার জন্য চরম হুমকি ও বিরাট চ্যালেঞ্জ।

জানা গেছে, একবার ব্যবহারের পর পলিথিন ব্যাগগুলো যত্রতত্র ফেলে দেওয়া হচ্ছে। অপচনশীল সর্বনাশা পলিথিনের যত্রতত্র ব্যবহারের ফলে ভরাট হচ্ছে নগরÑ মহানগরের পয়ঃনিষ্কাশনের নালা-নর্দমা। ভেঙে পড়ছে ড্রেনেজ ব্যবস্থা। পলিথিন বর্জ্যরে কারণে বাতাসে ছড়াচ্ছে বিষ। ভরাট হচ্ছে খাল-বিল-নদী, দূষিত হচ্ছে পানি। পলিথিন খাল-বিল, নদী-নালায় জমা হয়ে তলদেশ ভরাট করে ফেলে। নাব্য নষ্ট হওয়ায় নৌপরিবহনে বিঘ্ন ঘটে। ড্রেনেজ ব্যবস্থা অচল হয়ে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ পানিবদ্ধতা। দুর্ভোগের শিকার হয় নগরবাসী।

পলিথিন উৎপাদন, বাজারজাত, বিক্রি ও ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকার পরও প্রকাশ্যে এর ব্যবহার হচ্ছে। পলিথিন নিয়ে নৈরাজ্য বন্ধের বিষয়ে পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, অবাক করার মতো বিষয় দেশে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ। কিন্তু প্রকাশ্যে তা উৎপাদন, বিক্রি ও ব্যবহার হচ্ছে। আইনটি খুব স্পষ্ট। মোড়ক উৎপাদনের জন্য কিছু অনুমোদন দেওয়া আছে। কিন্তু মোড়কের নামে পলিথিন উৎপাদন চলবে না। আমরা মার্কেট মনিটরিং করব। ২০০৪-২০০৬ সময়ে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করা গেছে মার্কেট মনিটরিংয়ের মাধ্যমে। প্রথম আমরা বিভাগীয় শহরগুলো দিয়ে শুরু করব। পলিথিনের বিকল্প নিয়ে প্রশ্ন তুলে লাভ নেই। দেশে কাগজ, পাট, কাপড় সব কিছুই আছে। বাজারে চাহিদা থাকলে বিকল্প এমনিতেই চলে আসবে। আমরা বলে দেব বিকল্প কি কি হবে। এখানেও আইন প্রয়োগে আমাদের কঠোর হতে হবে।

পরিবেশবিদদের মতে, ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহৃত হয় পলিথিন তৈরিতে। পলিথিন মাটির স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। পচনশীল না হওয়ায় বাধা সৃষ্টি করে সব ধরনের চাষাবাদে। পলিথিন মাটির অভ্যন্তরে চলে যাওয়ার ফলে মাটিতে থাকা অণুজীবগুলোর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। মাটির নিচেও তা পানি চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ফলে, মাটির গুণগত মান ও উর্বরতা হ্রাস পাওয়ায় শস্যের উৎপাদন কমে যায়। মাটির নীচের পলিথিনের কারণে গাছ খাবার পায় না। এ কারণে গাছ কম আক্সিজেনের উৎপাদন করায় বাতাসে কার্বনডাই অক্সাইড, সিসা এসবের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং অক্সিজেনের স্বল্পতার প্রভাবে মানুষের মধ্যে হাঁপানি কিংবা শ্বাসরোগ বেড়ে যায়।

জাহাঙ্গীরনগর বিম্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ভোরের আকাশকে বলেন, বাজারে পলিথিনের বিকল্প পণ্য সরবরাহ না করে শুধু অভিযান পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না। উপরন্তু যারা এখন পলিথিন উৎপাদনে বিনিয়োগ করেছেন; তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তিনি বলেন, এটি স্বল্প মেয়াদি একটি নীতিমালার মাধ্যমে করা গেলে ভালো হবে। এ ক্ষেত্রে বিকল্প হিসেবে পাটের তৈরি মসৃণ ব্যাগ বাজারে আনা যেতে পারে।

পাটের পলিব্যাগ আসবে কবে : পাট থেকে বায়োডিগ্রেডেবল পলিব্যাগ পেতে আরও এক বছর অপেক্ষা করতে হবে বলে জানিয়ে ছিলেন সাবেক পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন। ২০২১ সালের জুন তিনি এ কথা বলেছিলেন। কিন্তু এরপর তিন বছর কেটে গেলেও সেই ব্যাগ বাজারে আসেনি।

বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক ট্রাস্টি বোর্ডের ৫৪তম সভায় মন্ত্রী একথা জানান। তিনি বলেন, পরিবেশ দূষণকারী পলিথিন ব্যাগের বিকল্প হিসেবে পাটের তৈরি ব্যাগ উদ্ভাবনে সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। এলক্ষ্যে সরকার জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট উদ্ভাবককে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ প্রদান করেছে। কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে এখনও পাট হতে বাজারজাতকরণের মতো বায়োডিগ্রেডেবল পলিথিন প্রস্তুত করা সম্ভব হয়নি। উদ্ভাবক ২০২২ সালের জুনের মধ্যেই এটা করতে সক্ষম হবেন বলে মত প্রকাশ করেছেন। পাটের পলিব্যাগ প্রচলন করতে পারলে দেশের পরিবেশ সংরক্ষণে ‘এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

পাটের আঁশ থেকে পলিমার তৈরির পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা অধ্যাপক মোবারক আহমদ খান। দুই দশক ধরে পাটের বাণিজ্যিক ব্যবহার নিয়ে গবেষণা করা এই বিজ্ঞানীকে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি স্বর্ণপদক দেয়।

 

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version