-->
শিরোনাম

বেরিয়ে আসছে বন্যার ক্ষতচিহ্ন 

ভোরের আকাশ ডেস্ক
বেরিয়ে আসছে বন্যার ক্ষতচিহ্ন 
বন্যার পানির তীব্র চাপে নোয়াখালীর কোম্পানীাগঞ্জের ‘মুছাপুর ক্লোজার’ স্লুইসগেট ভেঙে গেছে

সাম্প্রতিক বন্যায় দেশের পূর্বাঞ্চলের ১১ জেলায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। শত শত হেক্টর ঘেরের মাছ ভেসে গেছে। ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট ভেঙে গেছে। কয়েকটি জায়গা থেকে পানি নামছে। ফলে বেরিয়ে আসছে ক্ষতচিহ্ন।

এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলা বন্যায় এসব জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৫৮ লাখেরও বেশি মানুষ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী রেজা গতকাল বুধবার দুপুর ১টা পর্যন্ত বন্যার পরিস্থিতির সর্বশেষ এই তথ্য জানান। তিনি বলেন, বন্যার পানি নামতে শুরু করলেও ১১ জেলার ১২ লাখ ২৭ হাজার ৫৫৪টি পরিবার এখনো পানিবন্দি। আর ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৫৮ লাখ ২২ হাজার ৭৩৪ জন। গত কয়েকদিনে বন্যায় যে ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে তার মধ্যে কুমিল্লারই ১২ জন। এছাড়া নোয়াখালীতে ৬, চট্টগ্রামে ৫, কক্সবাজারে ৩, ফেনীতে ২ এবং খাগড়াছড়ি, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া ও লক্ষ্মীপুরে একজন করে মারা গেছেন। তিনি বলেন, পানিবন্দি ক্ষতিগ্রস্ত মানুসের জন্য দুর্গত এরাকায় ৪,০০৩টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে মোট ৫ লাখ ৪০ হাজার ৫১০ মানুষ এবং ৩৯ হাজার ৫৩১ গবাদিপশুর আশ্রয় হয়েছে। ১১ জেলার বানভাসিদের চিকিৎসা সেবা দিতে ৬১৯টি মেডিকেল টিম কাজ করছে বলে জানান তিনি।

উজানের তীব্র ঢল এবং অতি ভারি বৃষ্টির কারণে গত মঙ্গলবার থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। পরে দ্রুতই তা ছড়িয়ে যায় ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজারে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চলমান বন্যায় ৪ উপজেলার ৮৬০টি পুকুরের অন্তত ৭৫৬ টন মাছ পানিতে ভেসে গেছে। এতে সাড়ে ১৮ থেকে ১৯ কোটি টাকার বেশি লোকসান হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন আখাউড়া উপজেলার খামারিসহ মাছ ব্যবসায়ীরা। তবে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

আখাউড়া উপজেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় পুকুর, দিঘি ও খামারের সংখ্যা ২ হাজার ৩৪৮। এগুলোর মোট আয়তন ৬২১ হেক্টর। এসব জলাশয়ে প্রায় ৫০০ ব্যবসায়ী মাছ চাষ করেন। আর চাষির সংখ্যা ২ হাজার ১০৭। বন্যায় ১২১ দশমিক ৮৬ হেক্টর আয়তনের ৪৩০টি দিঘি, খামার ও পুকুরের সব মাছ পানিতে ভেসে গেছে। ৯ কোটি ১৩ লাখ টাকা মূল্যের মোট ৪৫৬ টন মাছ পানিতে ভেসে গেছে। আর ১ কোটি ১৫ লাখ পোনা পানিতে ভেসে গেছে; যার বাজারমূল্য ৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যবসায়ীর ১০ লাখ টাকার অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

আখাউড়ার মোগড়া ইউনিয়নের নিলাখাদ গ্রামের খামারি নাইম আহমেদ বলেন, বন্যায় যে ক্ষতি হয়েছে, তা সামলে ওঠা অনেক কঠিন হয়ে পড়বে। বন্যার পানিতে পাঁচ কোটি টাকার মাছ পানিতে ভেসে গেছে। এই ক্ষতি কীভাবে পূরণ করব, বুঝতে পারছি না। বন্যার পানিতে প্রায় দেড় কোটি টাকার মাছ ভেসে যাওয়ার দাবি করেছেন কর্নেল বাজারের বাসিন্দা বাছির মিয়া।

তিনি বলেন, পুকুরে মাছ মাত্র বড় হয়েছিল। কয়েক দিনের মধ্যেই বাজারে বিক্রি করতেন। কিন্তু বন্যার পানিতে সব মাছ ভেসে দেড় কোটি টাকার লোকসান হয়েছে।

মোগড়া গ্রামের বাসিন্দা দুলাল মিয়া বলেন, পানি কমলেও আমার পুকুরে আর মাছ নেই। যা মাছ ছিল সব পানিতে ভেসে গেছে। প্রায় এক কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে। এ বিষয়ে ক্ষয়ক্ষতি-সংক্রান্ত প্রাথমিক একটি তালিকা করেছে আখাউড়া উপজেলার মৎস্য কার্যালয়।

উপজেলার মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম বলেন, বড় ব্যবসায়ীরা অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ইউনিয়ন পর্যায়ে খামারিদের ক্ষতির তালিকা করা হচ্ছে। তবে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে। এদিকে কসবা উপজেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় বন্যার পানিতে ২০০ পুকুর, দিঘি ও খামারের মাছ ভেসে গেছে। এগুলোর আয়তন ৩৮ হেক্টর। ১ কোটি ৪০ লাখ টাকার বড় মাছ ও ১০ লাখ টাকার পোনা পানিতে ভেসে গেছে। বন্যার পানিতে মাছ ভেসে যাওয়ার পাশাপাশি অবকাঠামো ভেঙে মোট ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।

সদর ও উপজেলা মৎস্য কার্যালয় জানিয়েছে, সদর উপজেলায় ৬০ হেক্টর আয়তনের ১৪৫টি পুকুর, দিঘি ও খামারের মাছ ভেসে গেছে। ১৫ লাখ টাকা মূল্যের ১২ লাখ পোনা ও ৩ কোটি ২৫ লাখ টাকার বড় মাছ পানিতে ভেসে গেছে। অবকাঠামো ভেঙে যাওয়াসহ বন্যার পানিতে মাছ ভেসে যাওয়ায় মোট ৩ কোটি ৭০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। বিজয়নগর উপজেলায় ১১ হেক্টর আয়তনের ৮৫টি পুকুর, দিঘি ও খামারের মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। ১৩ লাখ টাকা মূল্যের ১ লাখ পোনা ও ৪০ লাখ টাকার বড় মাছ পানিতে ভেসে গেছে। বন্যার পানিতে মাছ ভেসে যাওয়ার পাশাপাশি অবকাঠামো ভেঙে যাওয়ায় মোট ৫৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।

এ বিষয়ে জেলার মৎস্য কর্মকর্তা মো. আলমগীর কবির বলেন, বন্যার পানিতে ৮৬০টি পুকুর প্লাবিত হয়ে সাড়ে ১৮ থেকে ১৯ কোটি টাকার লোকসান হয়েছে। খামারি ও ব্যবসায়ী মিলিয়ে ৮৬০ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

২০ আগস্ট রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া ইমিগ্রেশন-সংলগ্ন খাল দিয়ে ভারতে থেকে পাহাড়ি ঢলের পানি আসতে শুরু করে। এরপর আখাউড়া উপজেলাসহ পর্যায়ক্রমে কসবা উপজেলায় বন্যা দেখা দেয়।

ফেনী প্রতিনিধি জানান, ফেনী জেলায় ভয়াবহ বন্যায় ৬টি উপজেলা পানিতে তলিয়ে ৬৪ হাজার ১৬১টি গবাদিপশু ও ২৩ লাখ চার হাজার ৪১০টি হাঁস-মুরগির মৃত্যু হয়েছে। এতে প্রাণিসম্পদ খাতে প্রায় ৩৯১ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বন্যার ফলে আয় ও পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছেন দুই হাজারেরও বেশি খামারী। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বন্যা-পরবর্তী সময়ে তাদেরকে বিশেষ প্রণোদনা না দিলে এ খাতটি যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনি মানবেতর জীবনযাপন করতে হবে হাজার হাজার শ্রমিককে।

সাম্প্রতিক বন্যায় ফেনী জেলা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে। জেলার ছাগলনাইয়া, পরশুরাম, ফুলগাজী, সোনাগাজী, ফেনী সদর, দাগনভূঞা উপজেলা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। বেশিরভাগ বাড়িঘর, দোকানপাট ডুবে গেছে। এমনকি একতলা পর্যন্ত পাকা বাড়ি তলিয়ে গেছে পানির নিচে। স্রোতের তোড়ে শত শত মুরগির খামার পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অনেক দীর্ঘ সময় লাগবে খামারীদের।

ফেনী জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ফেনীর ৬টি উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত ৩৫টি ইউনিয়নে ৩৮ হাজার ৭৩১টি গরু, ১২৯টি মহিষ, ১৫ হাজার ৬০৪টি ছাগল ও ৩৫৬টি ভেড়া মারা গেছে। এছাড়াও ১৭ লাখ ৩১ হাজার ৮১০টি মুরগি ও এক লাখ ৯৬ হাজার ৪৭২টি হাঁস মারা গেছে। সবমিলিয়ে মৃত পশুপাখির মোট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৩০২ কোটি ৬৭ লাখ ৯২ হাজার টাকা।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ২৯ লাখ ১৩ হাজার ৩১৩টি গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। এছাড়াও এক হাজার ৯৯২টি গবাদিপশুর খামারের ১৩ কোটি ১৭ লাখ টাকার এবং এক হাজার ৬২৩টি হাঁস-মুরগির খামারের ১০ কোটি ৯৭ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এছাড়াও তিন হাজার ৯৫০ টন পশুপাখির খাবার বিনষ্ট হয়েছে যার বাজারমূল্য ২৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা। তাছাড়া দুই হাজার ৫৫০ টন খড়, এক লাখ ৮৪ হাজার ২১০ টন ঘাস বিনষ্ট হয়েছে। প্লাবিত হয়েছে ২৮৫ একর চারণভূমি।

জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার ডা. মো. মোজাম্মেল হক স্বাক্ষরিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জেলায় প্রাণিসম্পদ খাতে মোট ক্ষতি হয়েছে ৩৯১ কোটি ১১ লাখ ৫৬ হাজার ৫৩০ টাকা। বন্যায় সদরের অ্যাকাডেমি রোডে অবস্থিত জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসও ডুবে গেছে। ফেনী সদর উপজেলার কার্যালয় ৩-৪ ফুট পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। এতে মেশিনারিজ ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

ফেনী সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার ডা. মো. শহিদুল ইসলাম খোকন বলেন, ফেনীতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রাণিসম্পদ খাতে। যা পুষিয়ে উঠতে অনেক সময় লাগবে। শুধু মাংস নয়; দুধ, ডিম ইত্যাদি থেকে ফেনীবাসীকে বঞ্চিত হতে হবে। বর্তমানে গো-খাদ্যের চরম সংকট চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, অনেক পশু খাবারের অভাবেও মারা যাচ্ছে। আমরা অফিসারদের সঙ্গে আলোচনা করে এ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করেছি। ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।

ভোরের আকাশ/ সু

মন্তব্য

Beta version