-->

ঢাকায় ভূগর্ভস্থ পানি ৮৬ মিটার নীচে, বিপর্যয়ের আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের

আশীষ কুমার দে
ঢাকায় ভূগর্ভস্থ পানি ৮৬ মিটার নীচে, বিপর্যয়ের আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের

বাসযোগ্য আধুনিক শহরের জন্য মোট আয়তনের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ জলাভূমি থাকা প্রয়োজন হলেও রাজধানী ঢাকায় জলাভূমির আয়তন ৩ শতাংশেরও কম। নানা কারণে মহানগরীর জলাভূমিগুলো আস্তে আস্তে নিশ্চিহ্ন হচ্ছে। নগরবাসীর চাহিদা মেটাতে প্রতিনিয়ত উত্তোলন করা হচ্ছে মাত্রারিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি। ফলে ভূগর্ভের পানির স্তর আশঙ্কাজনকহারে নীচে নেমে যাচ্ছে। এতে রাজধানী ঢাকা নিকট ভবিষ্যতে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।

পরিবেশবিদসহ সামাজিক আন্দোলনের কর্মীরা বলছেন, ঢাকায় প্রাকৃতিক জলাভূমির সিংহভাগ বিলুপ্ত হওয়া ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগত নিম্নমুখী হওয়ার পেছনে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কারণ রয়েছে। সেগুলো হচ্ছেÑ জ্যামিতিক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়ন, পরিবেশ রক্ষার বিষয়টিকে প্রাধান্য না দিয়ে অপরিণামদর্শী উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, জলাধার রক্ষা আইন ও পরিবেশ সুরক্ষা আইন লঙ্ঘন। এছাড়া ঢাকা ওয়াসার দুর্বল স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা এবং নগরবাসীর চাহিদা মেটাতে ভূ-পৃষ্ঠের ও নদীর পানির পরিবর্তে বিপুলসংখ্যক গভীর নলকূপ বসিয়ে দেদার ভূ-গর্ভের পানি উত্তোলন।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য অনুযায়ী, গত ২৮ বছরে ঢাকায় পানির স্তর ভূ-গর্ভের ৬১ মিটার নীচে নেমেছে। এই পানির স্তর ১৯৯৬ সালে ছিল ২৫ মিটার গভীরে; যা ২০০৫ সালে ৪৫ মিটারে, ২০১০ সালে ৬০ মিটারে এবং ২০২৪ সালে ৮৬ মিটারে নেমে এসেছে। এই হিসেবে, রাজধানীর ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছর গড়ে দুই মিটারেরও বেশি নীচে নেমে যাচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পাউবোর এক কর্মকর্তা জানান, দিন দিন পানির চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু পানির পরিমাণ বাড়ছে না। বরং ব্যবহারযোগ্য পানির পরিমাণ কমে আসছে।

পাউবোর ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, ৫০ বছর আগে ঢাকায় যেখানে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ছিল দুই থেকে তিন মিটারের মধ্যে, এ বছর সেখানে ৮৬ মিটারে নেমে গেছে। এটা আমাদের জন্য খুবই অ্যালার্মিং (কড়া সতর্কতা)। এছাড়া দেশের কিছু কিছু এলাকায় বোরো মৌসুমে সেচযন্ত্রের সাহায্যে ব্যাপক পানি উত্তোলনের কারণে পানির স্তর নিচে নামে। যদিও বর্ষা মৌসুমে আবারও আগের অবস্থানে ফিরে আসে। তবে ঢাকাসহ অনেক স্থানে পানির স্তর শুধু নামছেই; যা কখনো আর ওপরে উঠছে না। ঢাকার বাইরে পানির স্তর সেন্টিমিটার হারে নামলেও ঢাকায় নামে বছরে দুই মিটার হারে।

রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) এক গবেষণায় ঢাকা মহানগরীর পুকুরের চিত্র উঠে এসেছে। গবেষণা বলছে, বর্তমানে ঢাকায় মাত্র ২৪১টি পুকুর এবং ৮৬টি বিল ও লেক রয়েছে; যা নগরীর মোট জলাভূমির ২২ শতাংশ। এছাড়া বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয় ও প্রাতিষ্ঠানিক পুকুর রয়েছে ৪৩টি। পুকুর, বিল ও লেক মিলিয়ে জলাভূমির সংখ্যা ৩২৭।

ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডব্লিউএম) সমীক্ষা অনুযায়ী, ১৯৮৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত ঢাকা মহানগরী থেকে ১০ হাজার হেক্টরের বেশি জলাভূমি, খাল ও নিম্নাঞ্চল বিলীন হয়ে গেছে। জলাশয় ভরাটের এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০৩১ সাল নাগাদ ঢাকায় জলাভূমি ও নিম্নাঞ্চলের আয়তন আরো কমে আসবে বলে সমীক্ষায় আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।

ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) ২০২৩ সালে ল্যান্ডসেট স্যাটেলাইট বিশ্লেষণী গবেষণা অনুযায়ী, গত ২৮ বছরে শুধু ঢাকা থেকেই ৮৫ শতাংশ জলাভূমি হারিয়ে গেছে। পাশাপাশি এ সময়কালে নির্মাণ এলাকা বা স্থাপনা বেড়েছে ৭৫ শতাংশ। অর্থাৎ সবুজ গাছপালা এবং জলাশয় ধ্বংস করে কংক্রিটের স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। দখলের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব ছিল ২৬ শতাংশ, ইট-বালু ব্যবসায়ীদের দ্বারা ভরাট হয়েছে ৫ শতাংশ,ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দ্বারা ভরাট হয়েছে ৩২ শতাংশ, ভূমিহীনদের দ্বারা ভরাট হয়েছে ৩২ শতাংশ। এ ধরনের উন্নয়নকে অপরিণামদর্শী ও অপরিকল্পিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ঢাকার এ অবস্থা রাতারাতি বা স্বল্প সময়ে হয়নি। মূলত, স্বাধীনতাপরবর্তী সময় থেকেই জলাভূমি দখল ও ভরাটের প্রবণতা শুরু হয়েছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি ও বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, একটি বাসযোগ্য শহরের জন্য ১০ থেকে ১৫ শতাংশ জলাভূমি থাকা দরকার। কিন্তু ঢাকায় জলাভূমির আয়তন ৩ শতাংশেরও কম। জলাশয়সহ যেকোনো ধরনের জলাভূমি ভরাটকারীদের শাস্তির মুখোমুখি করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ও পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, পুকুর, জলাশয়, লেকসহ প্রাকৃতিক জলাভূমি ভরাট করে চলছে স্থাপনা নির্মাণের কাজ। দখল ও ভরাট করা জলাভূমিতে নির্মাণ করা হয়েছে বহুতল ভবন, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিপণি বিতান, শিল্পকারখানাসহ নানা ধরনের স্থাপনা। এই প্রবণতা এখনো অব্যাহত আছে।

তিনি বলেন, এ ধরনের অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়নের ক্ষেত্রে পরিবেশ রক্ষার বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে না। অপরিণামদর্শী উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, জলাধার রক্ষা আইন ও পরিবেশ সুরক্ষা আইনÑ কিছুই মানা হচ্ছে না। ফলে জলাভূমি দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে।

পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক আরো বলেন, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কারণে ঢাকায় পানির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। অন্যদিকে ঢাকা ওয়াসার স্যুয়ারেজ ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত দুর্বল। এছাড়া ঢাকা ওয়াসার কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নেই বললেই চলে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে এবং চুক্তির মেয়াদ আট দফা বাড়িয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের এক ব্যক্তিকে দীর্ঘ ১৫ বছর সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) পদে বহাল রাখা হয়েছে। এতে সংস্থাটির কার্যক্রমের ওপর যেমন অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি জেঁকে বসেছে, তেমনি অদূরদর্শী অনেক পরিকল্পনাও ভর করেছে এই সেবা সংস্থাটির কাঁধে। এর ফলে বিপুলসংখ্যক নগরবাসীর চাহিদা মেটাতে ভূ-পৃষ্ঠের ও নদীর পানির পরিবর্তে বিপুলসংখ্যক গভীর নলকূপ বসিয়ে দেদার ভূগর্ভের পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। এসব কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছর কমতে কমতে আশঙ্কাজনক পর্যায়ে চলে এসেছে। এভাবে চলতে থাকলে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন এই পরিবেশবিদ।

ভোরের আকাশ/ সু

মন্তব্য

Beta version