-->

রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক, চাপ কমানোর চেষ্টা

নিখিল মানখিন
রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক, চাপ কমানোর চেষ্টা

দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং জোটের সঙ্গে সংলাপ অব্যাহত রেখেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. মোহাম্মদ ইউনূস। শনিবারও সাতটি ইসলামী দল, জাতীয় পার্টি(জাপা)সহ বেশ কয়েকটি দলের সঙ্গে সংলাপ হয়েছে। এর আগে সংলাপে অংশ নিয়েছে বিএনপি, জামায়াতসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন,বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার দাবির চাপে রয়েছে সরকার। আর সেই চাপ কমানোর কৌশল হিসেবেই সরকার হঠাৎ করে এই সংলাপের আয়োজন। অথচ সংলাপে নির্বাচনী রোডম্যাপের চেয়ে চলমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এবং নির্বাচন সংস্কারসহ দলগুলোর নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহ প্রাধান্য পেয়েছে।

গত সপ্তাহের প্রথম দিকে দলীয় কর্মসূচিগুলোয় অন্তর্বর্তী সরকারকে সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার তাগিদ দিয়ে আসছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের বিষয়েও জোর দিচ্ছিলেন তিনি। গত বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপির মহাসচিব নানা আশঙ্কার কথাও জানিয়েছিলেন। পরদিনই গত বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির বৈঠকটি হয়। এতে মির্জা ফখরুলসহ দলটির তিনজন নেতা অংশ নেন।

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৃহস্পতিবারের বৈঠকেও বিএনপির নেতারা দেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিচার বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দ্রুত সংস্কার করে আগামী জাতীয় নির্বাচনের ‘রোডম্যাপ’ ঘোষণার তাগিদ দিয়েছেন। এ জন্য বিষয়গুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করার পরামর্শ দিয়েছে বিএনপি। একই দিন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেন জামায়াতে ইসলামী, গণতন্ত্র মঞ্চ, কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)-সহ কয়েকটি দল ও জোট।

তারই ধারাবাহিকতায় রাজধানীর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় গতকাল শনিবার বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত জাতীয় পার্টি(জাপা), ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ, হেফাজতে ইসলামী, জমিয়তে উলামে ইসলামী, খেলাফত আন্দোলন এবং নেজামী ইসলাম, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, বাংলাদেশ জাসদ, ১২ দলীয় জোট ও গণফোরামের সঙ্গে সংলাপ করেন অন্তর্বর্তী প্রধান উপদেষ্টা।

গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ এবং দলটির ১৪ দলীয় জোটের শরিকরা আমন্ত্রণ পায়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া বাম গণতান্ত্রিক জোটও আমন্ত্রণ পায়নি।

গতকাল শনিবার বিকেল ৩টার আগে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ, হেফাজতে ইসলামী, জমিয়তে উলামে ইসলামী, খেলাফত আন্দোলন এবং নেজামী ইসলামের নেতারা প্রবেশ করেন।

বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশের নেতৃত্ব দেন দলটির আমির মাওলানা ইউসুফ আশরাফ। তার প্রতিনিধি দলে রয়েছেন মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক ও যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা জালাল উদ্দিন।

হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মহাসচিব মাওলানা সাজেদুর রহমান। তার সঙ্গে ছিলেন আজিজুল হক ইসলামাবাদী, কেন্দ্রীয় নেতা মুনীর হোসেন কাশেমী।

খেলাফত মজলিশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সংগঠনটির আমির মাওলানা আবদুল বাছিত আজাদ। প্রতিনিধি দলে ছিলেন দলটির মহাসচিব অধ্যাপক আহমেদ আবদুল কাদের, নায়েবে আমির মাওলানা সাখাওয়াত হোসেন, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব জাহাঙ্গীর হোসেন, যুগ্ম মহাসচিব মুনতাসীর আলী ও প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক কাজী মিনহাজুল ইসলাম মিলন।

জমিয়তে উলামে ইসলামের একাংশের নেতৃত্ব দেন সংগঠনের মহাসচিব মাওলানা মনজুরুল ইসলাম আফেন্দি। নেজামী ইসলামের নেতৃত্ব দেন নির্বাহী সভাপতি মাওলানা আশরাফুল হক। তার সঙ্গে ছিলেন মহাসচিব মাওলানা মোমিনুল ইসলাম।খেলাফত আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন নায়েবে আমির মাওলানা মজিবুর রহমান হামেদি।

ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন দেন চরমোনাই পীর মাওলানা রেজাউল করীম। তার সঙ্গে মুফতি ফয়জুল করীম, অধ্যক্ষ ইউনুস আহমেদ, মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, আশরাফুল আলম।

লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টিক (এলডিপি) নেতৃত্ব দেন অবসরপ্রাপ্ত কর্ণেল অলি আহমেদ। তার প্রতিনিধি দলে ছিলেন, ড. রেদোয়ান আহমেদ, নেয়ামূল বশির, নুরুল আলম তালুকদার ও আওরঙ্গজেব বেলাল।জাতীয় পার্টিরর নেতৃত্বে দেন জিএম কাদের। তার প্রতিনিধি দলে ছিলেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ চৌধুরী, মজিবুর রহমান চুন্নু, মাশরুর মওলা ও সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন।

জাতীয়বাদী সমমনা জোটের নেতৃত্বে দেন এনপিপির চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ। তার প্রতিনিধি দলে ছিলেন জাগপার খন্দকার লুৎফর রহমান, গণদলের এটিএম গোলাম মওলা চৌধুরী, এনডিপির আবু তাহের, বাংলাদেশ ন্যাপের শাওন সাদেকি, সাম্যবাদী দলের সৈয়দ নুরুল ইসলাম।

১২ দলীয় জোটের নেতৃত্বে দেন জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার। তার প্রতিনিধি দলে ছিলেন জাতীয় দলের সৈয়দ এহসানুল হুদা, বিএলডিপির শাহাদাত হোসেন সেলিম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহিউদ্দিন ইকরাম, লেবার পার্টির একাংশের ফারুক রহমান, জাগপা একাংশের তাসমিয়া প্রধান, কল্যাণ পার্টির শামসুদ্দিন পারভেজ ও বিকল্পধারা বাংলাদেশের শাহ আহমেদ বাদল।

বাংলাদেশ জাসদের নেতৃত্ব দেন শরীফ নুরুল আম্বিয়া। তার প্রতিনিধি ছিলেন নাজমুল হক প্রধান, মুশতাক হোসেন, আবদুল কাদের হাওলাদার, কাজী সদরুল হক।

সাত ইসলামী দলের সঙ্গে সংলাপ:

বৈঠকে বেশকিছু সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে ৭টি ইসলামি দল ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ, হেফাজতে ইসলামী, জমিয়তে উলামে ইসলামী, খেলাফত আন্দোলন এবং নেজামী ইসলাম,। তার মধ্যে অন্যতম দাবি হলো- ‘দুবারের অধিক যেন কেউ প্রধানমন্ত্রী না হয়’। পাশাপাশি একটা যৌক্তিক সময় নিয়ে সংস্কারগুলো করে জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করতে বলেছেন ইসলামী দলের নেতারা।

প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় বৈঠক শেষে এ কথা জানান বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক।

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে আমরা বেশকিছু সংস্কার প্রস্তাব উপস্থাপন করেছি উল্লেখ করে মামুনুল হক সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কার আনার দাবি জানিয়েছি। সংবিধানে আল্লাহর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে এবং ইসলামবিরোধী কোনো আইন যেন না আসে। সবশেষ দুবারের অধিক যেন কেউ প্রধানমন্ত্রী না হয়।

আন্দোলনের সব হত্যাকাণ্ডের প্রয়োজনে ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচার করতে হবে দাবি জানিয়ে মাওলানা আরও বলেন, কালবিলম্ব না করে আন্দোলনের সব হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার করার দাবি করি এবং হেফাজত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সব মামলা এক মাসের মধ্যে প্রত্যাহার করার দাবি জানান।

আগামী দিনে অন্তর্র্বতী সরকারকে সহযোগিতার ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টা যে আহ্বান জানিয়েছেন সে বিষয়ে মামুনুল হক বলেন, সহযোগিতার বিষয়ে আমরা সাড়া দিয়েছি। প্রয়োজনীয় সংস্কার করে যেন নির্বাচন দেওয়া হয়। কালবিলম্ব যেন না করা হয় সে দাবিও জানিয়েছি। তবে প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো সময় বেঁধে দেওয়া হয়নি বলে জানান ইসলামী দলগুলোর নেতারা।

এলডিপির ৮৩ সুপারিশ:

প্রধান উপদেষ্টার সাথে বৈঠক করেছে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)। বৈঠক শেষে দলটির প্রধান ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ বলেছেন, এলডিপির পক্ষ থেকে আমরা ৮৩টি সুপারিশ করেছি। এগুলো দলীয় কোনো উপকারের জন্য না, রাজনৈতিক ফায়দার জন্য না। আমাদের ব্যক্তিগত কোনো সুবিধার জন্য না।

শনিবার বিকেলে প্রধান উপদেষ্টার সাথে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন। নির্বাচন বিষয়ে তিরি বলেন, সংস্কারের পূর্বে কোনো অবস্থাতেই নির্বাচন নয়। তবে অবশ্যই অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের জন্য দ্রুত ভালো। সেটি ৬ মাস হোক ৯ মাস পরে হোক।

তিনি বলেন, পাঠ্যপুস্তকে যতগুলো ধর্মবিরোধী লেখা-গল্প আছে সেগুলো সব বাদ দিতে হবে। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলকে অনুরোধ করব, নিজের স্বার্থ ভুলে যান, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা ভুলে যান। দেশের মানুষের কথা চিন্তা করেন, সে পরিকল্পনা করেন।তিনি আরো বলেন, আমাদের মূল লক্ষ্য একটি পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশ, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ। এখনো আমরা বাংলাদেশকে চাঁদাবাজ মুক্ত করতে পারিনি। স্বৈরাচারমুক্ত হয়েছে দেশ, চাঁদাবাজ মুক্ত হয় নাই। এখনো কোর্ট কাচারিতে ন্যায় বিচার হচ্ছে না। মানুষ ন্যায়বিচার না পেলে এ স্বাধীনতার কোনো দাম নেই।

যৌক্তিক সময়েই নির্বাচন: প্রধান উপদেষ্টা

যৌক্তিক সময়েই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস। শনিবার প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধির সঙ্গে আলাপকালে এ কথা বলেন তিনি। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে অযৌক্তিক সময় নষ্ট করবে না অন্তর্বর্তীালীন সরকার। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে আসন্ন দুর্গা পূজায় কেউ যাতে নৈরাজ্য করতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে ইসলামি দলগুলোর প্রতি এসময় আহ্বান জানান তিনি।

 

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version