-->
অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার বুধবার থেকে

এবার সাঁড়াশি অভিযানে নেমেছে যৌথ বাহিনী

গোলাম মুজতবা ধ্রুব
এবার সাঁড়াশি অভিযানে নেমেছে যৌথ বাহিনী
  • ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছরের ৫ আগস্ট পর্যন্ত বেসামরিক জনগণকে দেয়া অস্ত্রের লাইসেন্স স্থগিত
  • ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিজে বা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নিকটস্থ থানায় জমা দিতে হবে
  • অস্ত্র জমা না দিলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা
  • পতনের পর সারাদেশে পুলিশের থানা, ফাঁড়িতে হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে তৎপরতা অব্যাহত

অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে যৌথ অভিযান পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ছাত্র জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরপরই দুর্নীতিবাজ ও কালোটাকা উদ্ধারে যৌথ অভিযান খুব শীঘ্রই পরিচালিত হতে যাচ্ছে বলে বিভিন্ন মহলে আলোচনা ছিল। অবশেষে সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে রোববার সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা এলো আগামী বুধবার থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে যৌথ অভিযান পরিচালিত হতে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এরই মধ্যে অভিযানের কৌশল ও পরিকল্পনা প্রায় চূড়ান্ত করা হয়েছে।

জানা গেছে, গত ২৫ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ বছরের ৫ অগাষ্ট পর্যন্ত বেসামরিক জনগণকে দেয়া অস্ত্রের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। পাশপাশি পুলিশ জানিয়েছে, ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সেসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিজে বা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নিকটস্থ থানায় জমা দিতে হবে। যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কেউ অস্ত্র জমা না দেয় তাহলে পুলিশের পক্ষ থেকে আইন অনুযায়ি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বলা হয়েছে। অন্যদিকে সরকার পতনের পর সারাদেশে পুলিশের থানা, ফাঁড়িতে হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও অস্ত্র লুটের কথা বলা হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে সেইসব অস্ত্র উদ্ধারে তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের রাজনৈতিক শাখা থেকে জারি করা এক চিঠিতে অবৈধ অস্ত্রের উদ্ধারের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের কয়েকটি নির্দশনা প্রদান করা হয়েছে। এইসব নির্দেশনার আলোকেই যৌথ অভিযান পরিচালিত হবে বলে জানান দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। তারা জানান, বর্ণিত অস্ত্রের লাইসেন্স স্থগিত ও সংশ্লিষ্ট গোলাবারুদ থানায় জমা প্রদান এবং ৪ সেপ্টেম্বর হতে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান পরিচালনা ও অবৈধ অস্ত্র সংরক্ষণ বা হেফাজতকারীদের বিরুদ্ধে আইনে মামলা দায়েরসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি জেলা তথ্য অফিসের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে বলে নির্দেশনায় বলা হয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা ফয়সাল হাসান সাংবাদিদের জানান, আরেক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটগণ আগামী ২ সেপ্টেম্বর পুলিশ সুপার,সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিনিধি এবং গোয়েন্দা সংস্থাসহ অন্যান্য সদস্যদের সমন্বয়ে কোর কমিটির সভা করবেন। সভায় স্থগিত করা লাইসেন্সের তালিকা পর্যালোচনা করবেন। আগামী ৪ সেপ্টেম্বর হতে কার্যকর অস্ত্র উদ্ধার অভিযান পরিচালনার জন্য সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি, কোস্টগার্ড, পুলিশ, র‌্যাব, আনসার সমন্বয়ে যৌথ অপারেশন টিম গঠন করে অস্ত্র উদ্ধার অভিযান পরিচালনার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এছাড়াও মেট্রোপলিটন এলাকার পুলিশ কমিশনারদেরকে সংশ্লিষ্ট সকল বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় ৪ সেপ্টেম্বর থেকে যৌথ অভিযান পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করতে বলা হয়েছে। পাশপাশি জেলা ম্যাজিস্টেটদের প্রণীত স্থগিত লাইসেন্সধারীদের তালিকা এবং নির্ধারিত তারিখ পর্যন্ত জমা করা অস্ত্রের লাইসেন্সধারীদের তালিকা ৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের রাজনৈতিক শাখায় পাঠানোর কথা বলা হয়েছে।

তার আগে তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ‘আগামী ৪ সেপ্টেম্বর থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হবে বলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো.জাহাঙ্গীর আলম (অব.) জানিয়েছেন।’

সর্বশেষ পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাঠানো এক বার্তায় জানানো হয়েছে, ১ লা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ হতে বিভিন্ন ধরনের ৩ হাজার ৮৮০টি অস্ত্র, ২ লক্ষ ৮৬ হাজার ৩৫৩ রাউন্ড গুলি, ২২ হাজার ২০১টি টিয়ার গ্যাস সেল এবং ২ হাজার ১৩৯টি সাউন্ড গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়েছে। র‌্যাবের পক্ষ থেকে রোববার জানানো হয়েছে, তারা লুট হওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদের মধ্যে এই পর্যন্ত ২৫১টি অস্ত্র, ১৪ হাজার ৭৯২ রাউন্ড গোলাবারুদ ও ১০৪টি ম্যাগাজিন উদ্ধার করেছে। যেসব অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি সেগুলো উদ্ধারে তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।

দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মীর নামে মামলা হয়েছে। বহু সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, কেন্দ্রীয় নেতা বিদেশে যেতে না পারায় নিরাপত্তাহীনতায় দেশেই আত্নগোপনে রয়েছেন। যৌথ অভিযানে তাদের গ্রেপ্তার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পাশপাশি অস্ত্র জমা দেওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে সেই সময়ের মধ্যে অনেক আওয়ামী লীগ নেতা অস্ত্র জমা দিতে পারছেন না। তাই স্বাভাবিকভাবেই তাদের অনেকেই গ্রেপ্তার করা হতে পারে। পাশাপাশি পুলিশের থানা, ফাঁড়ি থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করে যারা ফেরত দেবেন না তারাও গ্রেপ্তারের আওতায় আসছেন বলে ওই দায়িত্বশীল সূত্রটি নিশ্চিত করেছে।

আওয়ামী লীগের নাম প্রকাশ না করার শর্তে তৃণমূল পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, প্রতিপক্ষের হামলায় প্রাণহানির ভয়ে তারা অনেকেই এলাকা ছেড়ে বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নিয়েছেন। যৌথ অভিযান তাদের আতঙ্ক আরো বাড়িয়েছে পাশাপাশি হয়রানির শঙ্কাও তৈরি করেছে। তবে তারা মনে করছেন এই যৌথ অভিযান আগামী রাজনীতির অনেক বার্তা রাজনীতিবিদদের কাছে পৌছে দেবে। তাই তারা আসলেই দেখতে চান যৌথ অভিযানে আসলে কাদের আইনের আওতায় আনা হবে। এই অভিযান তাদের আগামী পদচলার পরীক্ষায় গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখবে।

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ১-১১ এর সেনা সমর্থিত ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালায়। তখন আতঙ্কে দুর্নীতিবাজদের অনেকেই রাস্তায় গাড়ি ও টাকার ব্যাগ ফেলে পালিয়ে যাওয়ার নজির আছে। এর আগে ১৯৯৬ সালে বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সারা দেশে অভিযানে নেমেছিল যৌথবাহিনী। তখন ভয়ে অনেক রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী নেতা দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলেন। আবার অনেকেই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। কিন্তু এবারও অভিযানে একদিকে যেমন অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হবে তেমনি চিহ্নিত দুর্নীতিবাজরাও আইনের আওতায় আসবেন।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আলাপকালে জানান, যৌথ অভিযানের ছক চূড়ান্ত করা হয়েছে। ১-১১ এর সরকারের আদলে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে যৌথ বাহিনীর একাধিক কার্যালয় করা হতে পারে। এ কাজে সেনাবাহিনী, প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সবাই সহযোগিতা করবেন। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রক্ষা পাওয়ার কোন সুযোগ কেউ পাবেন না। এই অভিযান বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

কর্মকর্তারা বলছেন, ১৯৯৬ ও ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন আর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রেক্ষাপট এক নয়। এবার ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে খোদ সাবেক সরকার প্রধান শেখ হাসিনা জীবন বাঁচাতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ‘গণভবন’ দখলে নিয়ে ভাঙচুর, লুটপাট চালায়, সংসদে প্রবেশ করে। থানা-পুলিশও হামলার শিকার হন, অস্ত্র লুটের ঘটনাও ঘটে। দেশজুড়ে সৃষ্টি হয় চরম নৈরাজ্য। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ চলে অনেক সাবেক মন্ত্রী-এমপির বাড়িতেও। পুলিশের ঊর্ধ্বতন অনেক কর্মকর্তা এখনো আতঙ্কে রয়েছেন। এরকম এক পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশকে সবদিক থেকে স্বাভাবিক ও গ্রহনযোগ্য করতে কাজ করে যাচ্ছে। তাই অংশ হিসেবে এই যৌথ অভিযান বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে।

পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো.ময়নুল ইসলাম সম্প্রতি ভোরের আকাশকে এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, যারা বিভিন্ন মামলার আসামি তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। তাদের পালিয়ে থাকার কোন সুযোগ নেই।

ভোরের আকাশ/ সু

মন্তব্য

Beta version