সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ২৭ দিনের মাথায় পদত্যাগ করলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। গতকাল সোমবার তিনি রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন।
গণআন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। ফলে আওয়ামী লীগের টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। পরদিন সংসদ ভেঙে দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। ফলে ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সংসদ সদস্য পদ চলে যায়। এমন অবস্থায় গতকাল তিনি স্পিকার পদ থেকে পদত্যাগ করলেন। তবে তার এই পদত্যাগের পর প্রশ্ন উঠেছে স্পিকার পদে তিনি বহাল থাকবেন নাকি স্পিকার পদটি শূন্য হয়ে গেল?
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী পদত্যাগ করলেও সংবিধানের ৭৪ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পরবর্তী স্পিকার নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত তিনিই এ পদে বহাল থাকবেন। অর্থাৎ ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচিত স্পিকার দায়িত্ব না নেওয়া পর্যন্ত শিরীন শারমিনই স্পিকার হিসেবে গণ্য হবেন। তিনিই নতুন সংসদের সদস্যদের শপথ পড়াবেন।
কিন্তু দেশে এখন অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে সরকার পদত্যাগ করে পালিয়েছে। জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। স্পিকার শিরীন শারমিন গা ঢাকা দিয়ে আছেন। তার বিরুদ্ধে রংপুরে একটি হত্যা মামলা হয়েছে। তাকে আর দেশে পাওয়া যাবে কি না কিংবা তাকে যদি গ্রেফতার করা হয় তবে তাকেও কারাবন্দি হতে হবে। আর ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকুকে ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি এখন কারাবন্দি।
এমন অবস্থায় আগামী জাতীয় সংসদ তথা ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর যদি তাদের কাউকে না পাওয়া যায় তবে দেশে একটি সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি হবে। একটা অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হবে। কারণ স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকারের অনুপস্থিতিতে নতুন সংসদের সদস্যদের কে শপথ পড়াবেন তা বাংলাদেশের সংবিধানে উল্লেখ নেই। এ অবস্থায় কারাবন্দি ব্যক্তিদের প্যারোলে মুক্তি দিয়ে তার বা তাদের মাধ্যমে নতুন সংসদ সদস্যদের শপথ পাঠ করানো যাবে কি না, তা-ও বাংলাদেশের সংবিধানে বলা নেই। ফলে এ দুটি বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দিক নির্দেশনা তথা রেফারেন্সের প্রয়োজন পড়তে পারে। যেমনটি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টেও রেফারেন্সের প্রয়োজন পড়েছিল। এক্ষেত্রেও তেমন রেফারেন্স প্রয়োজন পড়তে পারে বলে অভিমত আইনজ্ঞদের।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, পরবর্তী সংসদ না আসা পর্যন্ত স্পিকার তার পদে বহাল থাকেন। এখন যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, স্পিকার পদত্যাগ করেছেন, ডেপুটি স্পিকার বন্দি। তাতে সংবিধান মেনে চলা হলে দেখা যায়, এতে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ভোরের আকাশকে বলেন, ড. শিরীন শারমিন পদত্যাগ করলেও আমাদের সংবিধানের ৭৪ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নতুন সংসদ গঠিত না হওয়া পর্যন্ত তিনিই স্পিকার। কিন্তু দেশে এখন একটা অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। ডেপুটি স্পিকার কারাবন্দি। আর স্পিকারের খবর নেই। তাকে যদি না পাওয়া যায় কিংবা তাকে যদি গ্রেফতার করা হয় তখন একটা সাংবিধানিক জটিলতা সৃষ্টি হবে। সেক্ষেত্রে এই জটিলতা নিরসনে উচ্চ আদালতের রেফারেন্স প্রয়োজন পড়বে। যেমনটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে রেফারেন্স নিতে হয়েছে। তিনি বলেন, যে বিষয়টি সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই বা বলা নেই সে বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের মতামত নিতে হবে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনার প্রয়োজন হবে।
সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী অ্যাডভোকেট শিশির মোহাম্মদ মনির ভোরের আকাশকে বলেন, বর্তমান সংবিধানের অধীনে কোনো জটিলতা দেখা দিলে রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ১০৬ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের কাছে রেফারেন্স পাঠিয়ে সে বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেবেন। স্পিকারের পদ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হলে একই পথে হাটতে হবে রাষ্ট্রপতিকে।
সংবিধানের ৭৪ অনুচ্ছেদে স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকারের পদ কীভাবে শূন্য হবে, সে বিধান বলা আছে। সেখানে সংসদ সদস্য পদ না থাকা, পদত্যাগ করাসহ পাঁচটি কারণে স্পিকারের পদ শূন্য হবে বলে বলা আছে। এই পাঁচটি কারণ হলো- যদি তিনি সংসদ সদস্য পদে না থাকেন, মন্ত্রী হন, অপসারণের প্রস্তাব সংসদে গৃহীত হয়, পদত্যাগ করেন অথবা কোনো সাধারণ নির্বাচনের পর অন্য কোনো সদস্য তার কার্যভার গ্রহণ করেন। তবে একই অনুচ্ছেদে বলা আছে, এসব বিধান সত্ত্বেও ক্ষেত্রমতে স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকার তার উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল রয়েছেন বলে গণ্য হবে।
সংবিধানের এই নিয়ম অনুযায়ী সংসদ ভেঙে দেওয়া হলেও স্পিকারের পদ তাৎক্ষণিভাবে শূন্য হয় না। পরবর্তী স্পিকারের শপথ পর্যন্ত তিনি দায়িত্বে থেকে যান। তবে সেই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা না করে পদত্যাগ করছেন শিরীন শারমিন চৌধুরী। তিনি পদত্যাগ করায় স্পিকার পদে শূন্যতা তৈরি হলো কি না, সে প্রশ্ন উঠেছে। সেই সঙ্গে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের পর নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ পাঠ কে করাবেন, তা নিয়েও প্রশ্ন এসেছে।
একইভাবে সংবিধানের ৭৪ অনুচ্ছেদে সংসদে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচনের বিষয়ে বলা আছে। সংবিধান অনুযায়ী, কোনো সাধারণ নির্বাচনের পর সংসদের প্রথম বৈঠকে সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে সংসদ একজন স্পিকার ও একজন ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন করবে।
বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্রের তৃতীয় সর্বোচ্চ পদ জাতীয় সংসদের স্পিকার। সংবিধানে বলা আছে, রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে ক্ষেত্রমতো রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত কিংবা রাষ্ট্রপতি পুনরায় স্বীয় কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। অপরদিকে সংবিধানের ৫০ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘স্পিকারের উদ্দেশ্যে স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে রাষ্ট্রপতি স্বীয় পদ ত্যাগ করিতে পারিবেন’।
২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে স্পিকার নির্বাচিত হন আবদুল হামিদ। পরে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে ২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল স্পিকার নির্বাচিত হন শিরীন শারমিন চৌধুরী। এর পর থেকে তিনিই এ দায়িত্বে রয়েছেন। ৭ জানুয়ারি বিএনপিবিহীন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠনের পর শিরীন শারমিন চৌধুরীকে আবার স্পিকার নির্বাচিত করা হয়। দেশে ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট ও সরকার পতনের পরে সহিংসতায় ৭৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি চলাকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে ছাত্র-জনতা নিহত হওয়ার ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে। রংপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে স্বর্ণশ্রমিক মুসলিম উদ্দিন (৩৮) নিহত হওয়ার ঘটনায় ২৭ আগস্ট শিরীন শারমিন চৌধুরী, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা হয়।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদে ডেপুটি স্পিকার শামসুল হককে (টুকু) ১৫ আগস্ট গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাই আত্মগোপনে চলে যান। সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের কেউ কেউ গ্রেপ্তার হন। তবে শিরীন শারমিন চৌধুরী আর প্রকাশ্যে আসেননি। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ অনুষ্ঠানেও তিনি যাননি। ২০০৯ সালে সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য হিসাবে জাতীয় সংসদে বসেন ড. শিরীন শারমিন। তাকে দেওয়া হয় মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব। নবম সংসদের শেষ দিকে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর তখনকার স্পিকার আবদুল হামিদকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়। এরপর ২০১৩ সালে ৩০ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রথম নারী স্পিকার নির্বাচিত হন শিরীন শারমিন। তারপর থেকে তিন মেয়াদে তিনিই টানা স্পিকারের চেয়ারে ছিলেন।
ভোরের আকাশ/ সু
মন্তব্য