অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব¡ গ্রহণের পরপরই অবৈধ অস্ত্র, গডফাদার, দুর্নীতিবাজ ও পলাতক দুর্ধর্ষ আসামিদের বিরুদ্ধে যৌথ বাহিনীর অভিযান পরিচালনার ইঙ্গিত দেওয়া হয়। অবশেষে গতকাল বুধবার সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, বিজিবিসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে অভিযান শুরু করা হয়। অভিযানের প্রথম রাতেই (মঙ্গলবার দিবাগত রাত) পুলিশের সাবেক দুই আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন এবং এ কে এম শহীদুল হককে গ্রেপ্তার করার কথা জানায় পুলিশ। একই দিন ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহিল কাফিকেও গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া যায়। পরে এই তিনজনকে রিমান্ডে পাঠায় আদালত। তাদের গ্রেপ্তার ও রিমান্ডের খবরে পুলিশে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এছাড়া কিছু কর্মকর্তার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। নিজেদের রক্ষা করতে বর্তমান নীতিনির্ধারক পর্যায়ে অনেকে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন।
জানা গেছে, যৌথ বাহিনীর অভিযানের প্রথম রাতেই বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে তার ইচ্ছায় সেনা হেফাজত থেকে নিজেদের হেফাজতে নেওয়া এবং এ কে এম শহীদুল হককে গ্রেপ্তারের খবর জানায় পুলিশ। পরদিন তাদের আদালতে নেওয়া হলে আব্দুল্লাহ আল মামুনকে আট দিন এবং শহীদুল হককে সাত দিনের রিমান্ডে পাঠান আদালত। এছাড়া হাজারীবাগ থানার একটি অপহরণ মামলায় ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহিল কাফিকে আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। এই ঘটনাগুলো পুলিশের অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভাবিয়ে তুলেছে। বিশেষ করে যারা এতদিন আওয়ামী লীগ সরকারপন্থি বলে নিজেদের পরিচয় দিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন মূলত সেই সব কর্মকর্তারা এখন যেকোনো সময় গ্রেপ্তার হতে পারেন বলে মনে করছেন। এতদিন যাদের দাপটে বাহিনীর অনেকেই ভয়ে থাকতেন তারাই এখন নিজেদের রক্ষায় নানা মহলে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। এদের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন, ঢাকার বিভিন্ন অপরাধ বিভাগের দায়িত্বে থাকার পাশপাশি জেলার পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পালন করেছেন এমন অনেক কর্মকর্তা রয়েছেন। এদের অনেকেই এখন রাতারাতি ভোল পাল্টে নিজেদের আওয়ামী লীগ বিদ্বেষী বলে পরিচিত হতে চাচ্ছেন। বর্তমানে প্রভাব বিস্তার করতে পারেন এমন অনেকের সঙ্গেই সু-সম্পর্ক তৈরিতে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কোনো কোনো কর্মকর্তা বলছেন, অভিযান শুরুর এক ঘণ্টার মধ্যে সাবেক দুই আইজিপিকে গ্রেপ্তারের ঘটনা আগে কখনো ঘটেছে বলে অনেকেরই জানা নেই। তাদের অপরাধ যদি থেকে থাকে আর যদি তা প্রমাণ করা যায় তাহলে সেটা হবে একটা উদাহরণ। কেউ অপরাধ করলে তাকে আইনের আওতায় আনা দোষের কিছু না। আবার অন্যদিকে কেউ কেউ বলছেন, পুলিশের এমন কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার পুলিশের মনোবল অনেকটাই ভেঙে দিতে পারে। ভবিষ্যতে এই ধরনের গ্রেপ্তার বাহিনীকে আরো সংকটে ঠেলে দিতে পারে। তবে এই গ্রেপ্তারে বাহিনীর অনেক সদস্যই এখন আরো সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবেন। চাইলেই যেকোনো কর্মকর্তা যে কাউকে যেকোনো ধরনের নির্দেশনা দেবেন না।
সাবেক দুই আইজিপিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেও গ্রেপ্তারের বিষয়ে পুলিশ বলছে, কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় ছাত্র-জনতার মিছিলে নির্বিচার গুলিবর্ষণে ঢাকার মোহাম্মদপুরে মুদি দোকানি আবু সায়েদ হত্যা মামলায় সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল মামুনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল বুধবার সকালে তাকে সিএমএম আদালতে হাজির করার পর আটদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। রিমান্ডের আবেদনে বলা হয়েছে, গত ১৯ জুলাই বিকাল চারটায় মোহাম্মদপুরে আন্দোলন চলাকালীন সময় রাস্তা পার হয়ে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার সময় পুলিশের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। তার মাথার এক পাশ দিয়ে গুলি ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। পুলিশের গুলিতে গরিব মুদি দোকানদার আবু সায়েদের মৃত্যু হয়। পরে এ ঘটনায় মামলা করা হয়। এতে বলা হয়েছে, কোনো প্রকার উস্কানি ছাড়া আসামিদের নির্দেশে অজ্ঞাতনামা পুলিশ সদস্যরা গুলি করে আবু সায়েদকে হত্যা করেছে। এ মামলায় অন্যান্য আসামির মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান, গোয়েন্দা পুলিশের সাবেক প্রধান হারুন অর রশিদ, পুলিশ কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার এবং সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আরো অনেকে।
চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর আইজিপি হিসেবে যোগ দেন। শেখ হাসিনার সরকার পতনের পরে তাকে অবসরে পাঠানো হয়। অন্যদিকে ঢাকার নিউমার্কেট এলাকায় ব্যবসায়ী আব্দুল ওয়াদুদকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে করা মামলায় সাবেক আইজিপি শহীদুল হককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সকালে তাকে আদালতে হাজির করলে আদালত সাতদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ড আবেদনে বলা হয়েছে, গত ১৯ জুলাই বিকাল পাঁচটায় আন্দোলন চলাকালে নিউমার্কেটের এক নম্বর গেটের সামনে শান্তিপূর্ণ মিছিলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণে হত্যার উদ্দেশ্যে নিরপরাধ মানুষের উপর শত শত সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার শেল রাবার বুলেট ও গুলি করা হয়। ঘটনাস্থলে অনেকে আহত হয়। এদের মধ্যে আব্দুল ওয়াদুদ আসামিদের এলোপাতাড়ি গুলিতে মাথার পিছনে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে মারা যান।
মঙ্গলবার দিবাগত রাতে পৌনে একটায় উত্তরা ১৮ নম্বর সেক্টর থেকে অভিযান চালিয়ে শহীদুল হককে আটক করা হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে রিমান্ড আবেদনে। এতে বলা হয়েছে, প্রাথমিকভাবে তদন্তে আসামির এ মামলার ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার তথ্য প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। শহীদুল হক ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আইজিপি হিসেবে নিয়োগ পান। ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন তিনি। দায়িত্ব পালনের সময় তিনি নানা ধরনের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
পুলিশের সাবেক দুই শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলাসহ একাধিক মামলা রয়েছে। এই প্রথম পুলিশের মহাপরিদর্শক পদমর্যাদার কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদিকে ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহিল কাফিকে হাজারীবাগ থানার অপহরণ মামলায় আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। বুধবার সকালে পৌনে সাতটায় সাবেক দুই আইজিপির সঙ্গে কাফিকেও আদালতে হাজির করা হয়। পুলিশ ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করে। শুনানি নিয়ে আট দিন মঞ্জুর করেছে আদালত।
রিমান্ড আবেদনে বলা হয়েছে, ধানমণ্ডি জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার পদে নিয়োজিত থাকা অবস্থায় ২০১৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে বিকাল আড়াইটা থেকে চারটা থেকে ১০ আগস্ট রাত দুইটা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে পপুলার ও আনোয়ারা হাসপাতালের মাঝে ধানমণ্ডি দুই নম্বর রোড থেকে বাদীকে অপহরণ করে। এরপর হাজারীবাগ থানাধীন অজ্ঞাত স্থানে আটকে মুক্তিপণ স্বরূপ বিপুল পরিমাণ অর্থ পরিবার থেকে আদায় করে বলে বাদী দরখাস্তে উল্লেখ করেছেন। এই মামলার পলাতক অন্য আসামিদের মধ্যে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, পুলিশ কর্মকর্তা মারুফ হোসেন সরদার, ইকরাম আলী মিয়াও রয়েছেন। এছাড়া অন্যান্য আসামিও রয়েছে।
ভোরের আকাশ/ সু
মন্তব্য