-->

জাতীয় সংগীত ইস্যুতে নিন্দা প্রতিবাদের ঝড়

ভোরের আকাশ প্রতিবেদক
জাতীয় সংগীত ইস্যুতে নিন্দা প্রতিবাদের ঝড়

জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবির নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠেছে। এরই মধ্যে মাঠে নেমেছেন সংস্কৃতিকর্মীরা। গতকাল শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে বিপুল সংস্কৃতিকর্মী জাতীয় সংগীত পরিবেশন করে প্রতিবাদ জানায়। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও চলছে নিন্দার ঝড়।

তারা বলছেন, শুধুমাত্র সুর এবং গানের কথার চেয়ে জাতীয় সংগীত অনেক বেশি কিছু বহন করে। এটি জাতির ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধের প্রতীক।

শুক্রবার সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের বিপরীত পাশের সড়কে একসঙ্গে জাতীয় সংগীত কণ্ঠে তুলে কর্মসূচিতে অংশ নেয় উদীচী, জাতীয় খেলাঘর আসরসহ বিভিন্ন সংগঠন। ব্যক্তিগতভাবেও কেউ কেউ অংশ নেন এই আয়োজনে। এদিন দেশের সব জেলা ও বিদেশে উদীচীর শাখা সংসদের শিল্পী-কর্মীসহ সাধারণ মানুষ একসঙ্গে এই জাতীয় সংগীত কর্মসূচি পালন করেছে বলেও জানায় সংগঠনটি।

উদীচীর সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান বলেন, আমরা দায়বদ্ধ মানুষের প্রতি। আমাদের অর্জন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যখনই কোনো আঘাত আসবে, আমরা তার প্রতিবাদ করব। আমাদের জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা কারো দানে পাওয়া নয়। লাখো শহীদের রক্তে পাওয়া এ আমাদের অর্জন। এই অর্জনকে কোনোভাবেই কলঙ্কিত করা যাবে না। যখনই কেউ মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় পতাকা এবং জাতীয় সংগীতে আঘাত করবে। আমরা তার প্রতিবাদ করবই।

জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে উদীচীর পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জেলায় মানববন্ধনসহ নানা প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন। এ সব কর্মসূচিতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন সাংস্কৃতিকর্মীরা।

গত মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী সংবিধান নতুন করে লেখা এবং জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি জানান। এরপরই এই প্রসঙ্গটি জোরালো হয়ে উঠে। তিনি জামায়াতের সাবেক আমির ও যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের ছেলে। তার ওই বক্তব্যের পর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে নিন্দার ঝড় ওঠে। নেটিজেনরা বলছেন, রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ চলছে। এখানে সবারই পরামর্শ-দাবি বিবেচনা করা যেতে পারে। আবদুল্লাহিল আমান আযমী একটি প্রস্তাবনা দিয়েছেন এটি গ্রহণ করা না করার বিষয়ে সরকার আলোচনা করতে পারে। আরেকটি পক্ষ বলছে, জাতীয় সংগীত আমাদের আবেগের জায়গা। এটি পরিবর্তন করার দাবি কীসের ভিত্তিতে তিনি তুলবেন।

জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের উদ্যোগ আগেও নেওয়া হয় : জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর খন্দকার মোশতাক আহমেদ ক্ষমতায় আসেন। তিনি জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের লক্ষ্যে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. দ্বীন মুহাম্মদকে ওই কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়। কমিটিকে বলা হয় এক মাসের মধ্যে নতুন কোনো সংগীতকে ‘জাতীয় সংগীত’ হিসেবে প্রস্তাব করতে।

রাজনীতি বিশ্লেষক ও ঐতিহাসিকরা বলছেন, দ্বীন মুহাম্মদ কমিটি এ বিষয়ে তিনটি বৈঠক করে। সে কমিটি দুটো গানের একটিকে জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব করে প্রতিবেদন জমা দেয়। গান দুটো হলো জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’ এবং ফররুখ আহমেদের ‘পাঞ্জেরী’ কবিতা। কিন্তু ক্যু পাল্টা ক্যুতে ওই প্রস্তাবের হালে আর পানি পায়নি। জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দ্বিতীয় উদ্যোগ নেওয়া হয় ১৯৭৯ সালের ৩০ এপ্রিলে। সে সময় ‘আমার সোনার বাংলাকে বাদ দিয়ে ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’ গানটিকে জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব করা হয়।

সে সময় ক্ষমতায় ছিলেন জিয়াউর রহমান। ওই সময়ের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান এক গোপন চিঠিতে লেখেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি গান ভারতীয় জাতীয় সংগীত। তিনি বাংলাদেশের নাগরিক নন। আমার সোনার বাংলা গানটি আমাদের সংস্কৃতির চেতনার পরিপন্থী বিধায় জাতীয় সংগীত পরিবর্তন আবশ্যক। ওই চিঠিতে ‘আমার সোনার বাংলা’র পরিবর্তে ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’কে জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব করেন শাহ আজিজুর রহমান। প্রধানমন্ত্রীর ওই চিঠি পেয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ রেডিও, টেলিভিশন এবং সব সরকারি অনুষ্ঠানে প্রথম বাংলাদেশ গানটি প্রচারের নির্দেশনাও জারি করে।

এ সময় রাষ্ট্রপতির অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীতের পাশাপাশি প্রথম বাংলাদেশ গাওয়া শুরু হয়। কিন্তু ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর সেই উদ্যোগ থেমে যায়। পাথরে চাপা পড়ে সেই নিদের্শনা। জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের তৃতীয় দফার উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে। ২০০২ সালের ১৯ মার্চ তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী এবং সমাজকল্যাণমন্ত্রী আলী আহসান মুজাহিদ জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের লক্ষ্যে একটি যৌথ সুপারিশপত্র প্রধামন্ত্রীর কাছে জমা দেন। স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে আমাদের ইসলামি মূল্যবোধ ও চেতনার আলোকে জাতীয় সংগীত সংশোধিত হওয়া প্রয়োজন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এই অনুরোধপত্রটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠান। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী খুরশীদ জাহান হক বিষয়টি অতি গুরুত্বপূর্ণ বলে সচিবের কাছে প্রেরণ করেন। সচিব জাতীয় সংগীত পরিবর্তন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার বহির্ভূত বিষয় বলে তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রেরণ করে। একই বছরের ১৯ আগস্ট প্রস্তাবটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু সেই সরকারের আমলেই প্রস্তাবটি গৃহীত হয়নি। এরপর এ সম্পর্কে আর কোনো তৎপরতা নথিতে পাওয়া যায়নি।

প্রসঙ্গত, জাতীয় সংগীত অপরিবর্তনীয় বলে কোনো আইন নেই। বিভিন্ন দেশে জাতীয় সংগীত বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে পরিবর্তিত হওয়ার উদাহরণও রয়েছে।

ভোরের আকাশ/ সু

মন্তব্য

Beta version