-->
শিরোনাম

দুদকের জালে ‘বড় কর্তারা’

গোলাম মুজতবা ধ্রুব
দুদকের জালে ‘বড় কর্তারা’

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর, অধিদপ্তরের শীর্ষ পদে বসে তারাই ছড়ি ঘুরাতেন। ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে সার্বক্ষণিক ঘিরে রাখতেন তারা। সারাক্ষণ ‘বন্দনাগীতি’ করে শেখ হাসিনাকে আচ্ছন্ন করে রাখতেন। মন্ত্রী-এমপিদের চেয়ে শেখ হাসিনার কাছে তাদের গুরুত্ব ছিল বহুগুণ বেশি। তাদের পরামর্শ মতো কাজ করতেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। সুপ্রিম পাওয়ার পেয়ে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা বনে যান তারা। অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করা এই আমলারা হয়ে ওঠেন রাষ্ট্রযন্ত্রের বড় নিয়ামক। তাদের ইশারায় হতো সবকিছু। মন্ত্রী-এমপিরাও এক রকম অসহায় ছিলেন তাদের কাছে। তাদের সিদ্ধান্তই ছিল শেষ কথা। এ সুযোগে প্রকল্প থেকে বড় অংকের কমিশন, নিয়োগ-পদোন্নতি বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। দেশ-বিদেশে গড়ে তুলেছেন বাড়ি আর বাড়ি। বিদেশে পাচার করেছেন শত শত কোটি টাকা। আবার সিন্ডিকেট করে কেউ কেউ চাকরির মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়েছেন। আবার অবসরের পর কেউ কেউ এমপিও হয়েছেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্বগ্রহণের পরপরই ড. ইউনূস রাষ্ট্র সংস্কারের পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেন। আর এতেই ঘুম হারাম হয়ে গেছে দুর্নীতিবাজ সাবেক এসব আমলাদের। অনিয়ম, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারে জড়িয়ে বিপুল অর্থ বিত্তের মালিক বনে যাওয়া প্রায় শতাধিক ‘দুর্নীতিবাজ’ কর্মকর্তার সম্পদের খোঁজে মাঠে নামছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, নিজেকে আওয়ামী লীগপন্থি বলে পরিচয় দেওয়া আলোচিত ওইসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রাপ্ত থেকে অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগ জমা পড়ছে। তাদের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগগুলো এরই মধ্যে অনুন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবদের সম্পদের তথ্য তলবের মধ্য দিয়ে শুরু হবে এই প্রক্রিয়া। এরপর তদন্তের আওতায় আসবেন সাবেক জনপ্রশাসন সচিব ও জ্বালানি সচিবসহ অন্যরা। পাশপাশি আওয়ামী লীগের আমলে সুবিধাভোগী বেশ কয়েকজন আমলার বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ জমা পড়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, বিগত ১৫ বছরে নিজেদের সরকারপন্থি পরিচয় দিয়ে ক্ষমতার দাপট দেখিয়েছেন বেশ কয়েকজন আমলা। বিভিন্ন সময়ে তাদের অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পায় দুদক। তবে ‘বিভিন্ন মহলের’ চাপে এতদিন সে সব অভিযোগ আলোচনায় ছিল না। হঠাৎ ক্ষমতার পালাবদলের পর সেসব অভিযোগগুলোর বিষয়ে অনুসন্ধান করার সিদ্ধান্ত নেয় সংস্থাটি। কর্মকর্তারা বলছেন অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করা গেলে দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় আনতে তারা সব ধরনের প্রচেষ্টা চালাবেন।

একাধিক দুদক কর্মকর্তা জানান, গত সরকারের কয়েক ডজন প্রভাবশালী আমলার বিরুদ্ধে নজিরবিহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে দুদকের কাছে। এর মধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে বিপুল সম্পদ অর্জনের তথ্য রয়েছে। চাকরি জীবনে ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ, উন্নয়ন প্রকল্প থেকে কমিশন নেওয়াসহ বিভিন্ন অনিয়মে জড়িয়ে মালিক হয়েছেন শত শত কোটি টাকার। এসব অবৈধ অর্থে তারা দেশে-বিদেশে বিপুল সম্পদ গড়েছেন। বিভিন্ন ব্যাংকে নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার এফডিআর রয়েছে। কারও কারও রয়েছে বিভিন্ন কোম্পানির বিপুল পরিমাণ শেয়ার। দেশের বিভিন্ন জায়গায় জমি আছে অনেকের। এসব সম্পদের বেশিরভাগই স্ত্রী, সন্তান কিংবা আত্মীয়স্বজনদের নামে। অনেকেই চাকরি শেষে নাম লিখিয়েছেন রাজনীতিতে। কেউ কেউ গড়েছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। কয়েকজন আবার দেশ ছেড়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে বিদেশে স্থায়ী হয়েছেন। কারও কারও বিরুদ্ধে অর্থ পাচারেরও অভিযোগ রয়েছে। কেউ কেউ আবার নতুন সরকারের লোক সেজে নতুন করে পদ বাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টায়ও রয়েছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে দুদকে ফাইলবন্দি ছিল। সরকারে ওপর মহলের চাপে তাদের বিষয়ে কোনো কাজ করা যায়নি। ক্ষমতার পালাবদলে সেসব ফাইল নিয়ে সরব হয়ে উঠেছে দুদক। এরই মধ্যে সরকারের বিভিন্ন প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সব অভিযোগ নিয়ে কাজ করা হবে।

দুদকের এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, অনুসন্ধান তালিকায় প্রথমদিকে রয়েছেন বিগত সরকারের আমলের মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবরা। এসব শীর্ষ আমলা বিগত সরকারের আমলে অনেক প্রভাবশালী ছিল। তারা তাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি খাটিয়ে বিভিন্ন অনিয়মে জড়িয়ে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। বিষয়টি নিয়ে অভ্যন্তরীণ আলোচনা হয়েছে। খুব শিগগিরই সাবেক এই আমলাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করা হবে। আরেক কর্মকর্তা জানান, গত সরকারের মন্ত্রী, এমপিদের পিএস ও এপিএসের দায়িত্বে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে অনেকেই বিপুল অর্থ বিত্তের মালিক। তাদের অনেকের বিরুদ্ধেও দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। দুদক পর্যায়ক্রমে সেগুলোও তদন্ত করবে।

সূত্র বলছে, দুদকের অনুসন্ধানের তালিকায় আছেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ার, খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, মোহাম্মদ শফিউল আলম, মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইয়া এবং এম আবদুল আজিজ। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবদের মধ্যে তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, ড. আহমদ কায়কাউস, মো. নজিবুর রহমান, ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, মো. আবুল কালাম আজাদ, আবদুস সোবাহান সিকদার এবং এম আব্দুল আজিজের সম্পদের খোঁজে নামবে দুদক। এছাড়াও প্রতিমন্ত্রী মর্যাদায় বেসরকারিকরণ কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানের নামসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর, অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নামও তালিকায় রয়েছে বলে জোর আলোচনা আছে।

এদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ কবির বিন আনোয়ারের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। দুদক বলছে, সাবেক এই আমলার ক্ষমতার অপব্যবহার, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে নিজ ও পরিবারের নামে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ জমা পড়েছে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এসব অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় প্রকাশ্যে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

কবির বিন আনোয়ারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে একাধিকবার অভিযোগ জমা পড়েছে। এসব অভিযোগে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মহাপরিচালক (প্রশাসন) পদে দায়িত্ব পালনকালে তিনি কমিশন নিয়ে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দিতে সুপারিশ করতেন। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব থাকাকালে তিনি ১০ শতাংশ হারে কমিশন নিয়ে পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দিতেন। নিজস্ব সিন্ডিকেট তৈরি করে বন্যা নিয়ন্ত্রণ, তীর সংরক্ষণ, ভূমি পুনরুদ্ধার, নদী ড্রেজিং, পুনর্বাসন, যন্ত্রপাতি ক্রয়, ছোট নদী, খাল, জলাশয় পুনর্খনন, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন দপ্তরে বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম করে বিপুল পরিমাণে অর্থ হাতিয়েছেন। সাধারণ প্রকল্পকে বিশেষ জরুরি আখ্যা দিয়ে টেন্ডার না করেই মৌখিকভাবে কাজ বণ্টন করেছেন। আবার দফায় দফায় সে সব কাজের বরাদ্দ এবং সময় বৃদ্ধি করেছেন। এভাবে অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে কবির বিন আনোয়ারের সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে।

দুদকে জমা পড়া অভিযোগে বলা হয়েছে, প্রচণ্ড প্রভাবশালী এই আমলার ভয়ে তটস্থ থাকতেন অধস্তনরা। প্রধানমন্ত্রীর আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ায় তিনি কাউকে পরোয়া করতেন না। তার সম্পদের মধ্যে রয়েছে ঢাকা, গাজীপুর, সিরাজগঞ্জ, সেন্টমার্টিনের সোনাদিয়া, কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ সম্পদ। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে দেশের বাইরে অর্থ পাচারেরও অভিযোগ রয়েছে। কানাডার বেগমপাড়ায় তিনটি বাড়িসহ বিপুল পরিমাণে অর্থ রয়েছে। কবির বিন আনোয়ার তার ৫ বোন ও বোনের স্বামীদের নামে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ কিনেছেন।

প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউসের বিরুদ্ধেও দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ জমা পড়েছে। তার বিরুদ্ধে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে নজিরবিহীন দুর্নীতি আর অনিয়মে জড়ানোর অভিযোগ রয়েছে। বিদ্যুতের বিভিন্ন প্রকল্প থেকে শত শত কোটি টাকা হাতান তিনি। এ ছাড়া মুখ্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি বদলি-পদায়ন ও পছন্দের ঠিকাদারদের বিভিন্ন কাজ পাইয়ে দিতে তদবির বাণিজ্য করেন। এ ছাড়া সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের বিরুদ্ধেও দুর্নীতি আর অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এই সচিবের সময়ে পদ্মা সেতুসহ দেশে বেশ কিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। এসব প্রকল্পে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণে অবৈধ অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সচিব খোরশেদা ইয়াসমিন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দুর্নীতিবাজ যে-ই হোক না কেন যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন আইনের তফশিলভুক্ত অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে, তাদের সবার বিরুদ্ধেই যথাযথ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। অনুসন্ধানে অভিযোগ প্রমাণিত হলে চার্জশিট দেওয়া হচ্ছে, কোর্টে মামলা দাখিল করা হচ্ছে। দুর্নীতিবাজ যে-ই হোক না কেন, কাউকেই ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই।

 

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version