-->
শিরোনাম

বিদ্যুতের যাওয়া-আসা

হেলাল সাজওয়াল
বিদ্যুতের যাওয়া-আসা

কয়েক দিন ধরেই দেশে লোডশেডিং ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বিদ্যুতের যাওয়া-আসায় মানুষের ভোগান্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। খোদ রাজধানীতে সিডিউল করে লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে। ঢাকার বাইরে অনেক এলাকায় ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ থাকছে না। পরিস্থিতি সামাল দিতে ঢাকার বিদ্যুৎ গ্রামে সরবরাহ করা হচ্ছে। গরম আর লোডশেডিং-দুই মিলিয়ে অস্থির হয়ে উঠেছে জনজীবন। এদিকে লোডশেডিংয়ের কারণে কারাখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে লোকশানের আশঙ্কায় রয়েছেন শিল্পমালিকরা। সংকটের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ¦ালানি সংকটকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। দৈনিক গড়ে সাড়ে ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা থাকলেও উৎপাদন কম হচ্ছে সাড়ে ৪ হাজার মেগাওয়াট।

অথচ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৭ হাজার মেগাওয়াট। খুব শিগগিরই এ অবস্থা থেকে উত্তরণের কোন সম্ভাবনা নেই। তবে বিদ্যুৎ, জ¦ালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, ২১ দিনের মধ্যে সংকট কেটে যাবে। তবে তার এই কথায় ভরসা করতে পারছেন না গ্রাহকরা। গতকাল বুধবার সচিবালয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাংবাদিকদের বলেন, আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তিনি বলেন, বড়পুকুরিয়ায় কারিগরি সমস্যা হয়েছে; যা দ্রুত মেরামত করা হচ্ছে। রামপাল পুনরায় চালু হয়েছে। আদানির সাথে যোগাযোগ করা হচ্ছে। দ্রুত গ্যাস আমদানির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে বিদ্যুতের বর্তমান অবস্থার উন্নতি হবে।

জানা গেছে, দেশে দৈনিক গড়ে সাড়ে ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে। এর বিপরীতে উৎপাদন সক্ষমতা ২৭ হাজার মেগাওয়াট। গত দুমাস আগেও লোডশেডিং এতটা প্রকট ছিল না। রাজধানী ঢাকায় ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিং হচ্ছে। গত মাসের শেষদিক থেকে রাজধানীতে অল্পস্বল্প লোডশেডিং শুরু হলেও এখন তীব্র আকার ধারণ করেছে। গ্রামাঞ্চলের অবস্থা আরও ভয়াবহ। গতকাল দেশে ১৫ হাজার ৯০০ মেগাওয়াটের চাহিদার বিপরীতে লোডশেডিং হয়েছে ২৮৬ মেগাওয়াট। পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশ পিএলসির দাপ্তরিক পরিসংখ্যান অনুসারে, ওই সময় দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ১৫ হাজার ৬১৪ মেগাওয়াট।

পিডিবির দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গতকাল সারা দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ধরা হয়েছিল ১৫ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে সরবরাহ করা হয়েছে ১৫ হাজার ৬১৪ মেগাওয়াট। লোডশেডিং করা হয়েছে ২৮৬ মেগাওয়াট। মঙ্গলবার এই চাহিদা ছিল ১৬ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে সরবরাহ করা হয়েছে ১৪ হাজার ৮৮১ মেগাওয়াট। লোড শেডিং করা হয়েছে ১৫১৯ মেগাওয়াট। সেমবার এই চাহিদা ছিল ১৬ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে সরবরাহ করা হয়েছে ১৫ হাজার ৪৮২ মেগাওয়াট। লোডশেডিং হয়েছে ৭১৪ মেগাওয়াট। সোমবার বিভাগভিত্তিক সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং করা হয়েছে ময়মনসিংহে ২৫৭ মেগাওয়াট। এ ছাড়া ঢাকায় ২২৫ মেগাওয়াট, রাজশাহীতে ১৪৭ মেগাওয়াট, কুমিল্লায় ২১৭ মেগাওয়াট, সিলেটে ১০৫ মেগাওয়াট এবং রংপুরে ১২৫ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হয়েছে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কর্মকর্তারা বলছেন, গ্যাসের অভাবে কেন্দ্র চালানো যাচ্ছে না। এ ছাড়া তেলভিত্তিক অনেক কেন্দ্র বাতিল করা হয়েছে। এ কারণে লোডশেডিং ক্রমে বাড়ছে। জ্বালানি (গ্যাস ও তেল) সংকটের কারণে চার হাজার ১৬৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না বলেও জানান তারা।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক (জনসংযোগ) মো. শামীম হাসান, ভোরের আকাশকে জানান, বিগত সরকারের একপেশে নীতির কারণে বর্তমানের এ হাল হয়েছে; বিদ্যুত খাত এখন ঋণগ্রস্ত। বিদ্যুৎ উৎপাদনে জাতীয় কোম্পানিগুলোকে উৎপাদনমুখী না করে তারা নিজেদের পছন্দের বিদেশি এবং দেশিয় কোম্পানির সাথে চুক্তি করেছেন। তিনি বলেন, বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের তিনটি ইউনিটে উৎপাদন ক্ষমতা ৩২৫ মেগাওয়াট।

চীনের হারভিন কর্পোরেশন এটি পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে। বড়পুকুরিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ আমরা। কারন চীনা এই কোম্পানিকে অনেকদিন থেকে তাদের পাওনা টাকা না দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছিল বিগত সরকার। করোনার সময় যখন সারা বিশে^ বিপর্যয় শুরু হয় তখন বড়পুকুরিয়ায় কর্মরত বেশির ভাগ দক্ষ শ্রমিক কর্মকর্তা চীনে ফিরে যায়। তখন থেকেই ধুকে ধুকে চলছিল বড়পুকুরিয়া। বারবার কথা দিয়ে তাদের পাওনা পরিশোধ না করায় পরবর্তীতে তারা আর গুরুত্ব সহকারে রক্ষনা-বেক্ষণ করেনি। তিনি বলেন, কয়েক দফা তাদেরকে দিয়ে স্পেয়ার্স পার্টস আনিয়ে টাকা পরিশোধ করা হয়নি। এখন আমরা চেষ্টা করছি তাদের সাথে একটা সমঝোতা করে যত দ্রুত সম্ভব; প্রয়োজনীয় স্পেয়ার পার্টস নিয়ে এসে বড়পুকুরিয়ার দুটি ইউনিট চালু করতে।

জানা গেছে, এতদিন কয়লা সংকটের কারণে বিদ্যুত উৎপাদন বন্ধ থাকতো। এখন যথেষ্ট পরিমাণ কয়লা স্টকে থাকলেও যন্ত্রাংশের অভাবে বন্ধ রয়েছে বিদ্যুত উৎপাদন। এদিকে ঘূর্ণিঝড় রিমাল আঘাত হানার পর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ২৫টি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ আছে।

ঘূর্ণিঝড়ে দেশের দুটি ভাসমান স্টোরেজ এবং রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিটের (এফএসআরইউ) মধ্যে একটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়; যা এলএনজি রিগ্যাসিফিকেশন (পুনরায় গ্যাসে পরিণত করা) ক্ষমতা ১১০০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফডি) থেকে প্রতিদিন ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুটে নামিয়ে এনেছে। এফআরএসইউ সিস্টেমে সমস্যার কারণে সামিটগ্রুপের রি-গ্যাসিফিকেশন (গ্যাস সংকট দূর করতে আমদানী করা লিকুইড গ্যাসে রূপান্তর) কার্যক্রম বন্ধ আছে। ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এটি চালু হতে পারে। এটি চালু হলে গ্যাস সরবরাহ কিছুটা বাড়লে বিদ্যুত উৎপাদনও কিছুটা বাড়বে।

প্রচণ্ড গরমের মধ্যে ঢাকার অনেক এলাকার বাসিন্দাদের কয়েক দফা বিদ্যুৎ বিভ্রাটের সম্মুখীন হতে হয়েছে। রাজধানীর ডেমরা, যাত্রাবাড়ি, লালবাগ, ওয়ারি, গুলশান, বনানীসহ বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের কাছ থেকেও একই ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। পিডিবি সূত্রে জানা গেছে, চলমান সংকট মোকাবেলায় ঢাকা থেকে বিদ্যুত দিতে হচ্ছে গ্রামে। যার ফলে ঢাকার দুটি কোম্পানি ডিপিডিসি ৭০০ মেগাওয়াটের স্থলে ৬০০ ও ডেসকো ১০০০ মেগাওয়াটের স্থলে ৯০০ মেগাওয়াট দেওয়া হচ্ছে।

গ্রামাঞ্চলের পরিস্থিতি বেশ খারাপ। হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ের পল্লী বিদ্যুৎ অফিস জানায়, বানিয়াচং উপজেলায় বিদ্যুতের চাহিদা ১৮ মেগাওয়াট। আর পাওয়া যাচ্ছে ৯ থেকে ১০ মেগাওয়াট। রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে ঘন ঘন বিদ্যুৎ যাওয়ায় গ্রাহকদের মাঝে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। উত্তরের ১৬ জেলায় পল্লী বিদ্যুৎ ও নেসকো মিলে বিদ্যুতের চাহিদা ২ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। কিন্তু দুদিন ধরে সরবরাহ মিলছে ১ হাজার ৭০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। রাজশাহী বিভাগে ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে পাওয়া যাচ্ছে ৮০০ থেকে ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। সরবরাহ কম থাকায় ঘন ঘন লোডশেডিং দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

রাজধানীর ডেমরা কোনাপাড়ার বাসিন্দা শান্তা মেটাল ইন্ডাষ্ট্রিজ’র স্বত্বাধিকারী আলহাজ চান মিয়া জানান, দিনে তিন-চার বার এক ঘণ্টার লোডশেডিংয়ে বিপর্যস্ত তার কারখানা। তিনি বলেন, আমার কারখানায় প্রায় ৬০জন শ্রমিক কর্মরত। এদের কেউ মাসিক বেতনে কাজ করে আবার কেউ প্রডাকশনে কাজ করে। তিনি বলেন বিদ্যুৎ না থাকলেও শ্রমিকদের বেতন কিন্তু বন্ধ করা যায় না। তিনি বলেন, দিনে যদি চার বার বিদ্যুৎ যায় তাহলে আমার চার ঘণ্টা প্রোডাকশন বন্ধ থাকে। ফলে প্রোডাকশনে কাজ করা শ্রমিকেরা তাদের লক্ষ্য পূরণ করতে পারে না। তাদের আয় কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে বেতনের শ্রমিকদের বেতন আমাকে শোধ করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, একাধারে আমরা যারা মালিক আছি আমাদের মত শ্রমিকরাও ভোগান্তির শিকার হচ্ছে।

এ ধরনের আরও ছোট ও মাঝারি কারখানার মালিকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বিদ্যুৎ সংকটের কারণে কারখানার উৎপাদন কমে গেছে। জেনারেটরের উপর ভরসা করতে গিয়ে খরচ বেড়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। অনেকে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। রাজধানীর মাতুয়াইল এলাকার কয়েল কারখানার মালিক সোহেল জানান, আমরা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ধার-দেনা করে কারখানা চালাই। যদি দিনে চার পাঁচ ঘন্টা লোডশেডিং থাকে তাহলে প্রডাকশন বন্ধ। প্রডাকশন বন্ধ থাকলেও কারখানার খরচ কিন্তু একই থাকে। এভাবে চলতে থাকলে কারখানা বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকবে না। কারণ যে পরিমাণ প্রোডাকশন হয়; তাতে শ্রমিকের বেতন দেওয়া সম্ভব হবে না।

মহাখালি এলাকার বাসিন্দা মাহবুবুর রহমান বলেন, বিদ্যুৎ না থাকায় পানির সংকট দেখা দিয়েছে।

একই এলাকার বাসিন্দা মতিউর জানান, সকালে লোডশেডিংয়ের কারণে গরমে ঘুম ভেঙ্গে যায়। ছেলে মেয়েরা গরমে যন্ত্রনায় অস্থিও হয়ে পড়ছে। লেখাপড়ায় বিঘ্ন হচ্ছে ওদের। পিডিবির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছেন না। পিডিবির তথ্য অনুসারে, বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ না থাকায় চার হাজার ১৬৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না।

রাজধানীসহ সারা দেশে লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, গ্যাসের অভাবে এখন ১২শ থেকে ১৫শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছি না। বিশেষ করে সামিটের এলএনজি টার্মিনালটি চালু না হওয়ায় সংকট প্রকট হয়েছে। এছাড়া ভারত থেকে আমদানীকৃত বিদ্যুতের দাম পরিশোধ করতে না পারায়ও কিছু সংকট দেখা দিয়েছে। একই সাথে রামপাল এবং বড়পুকুরিয়া বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্রে হঠাৎ কওে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে লোডশেডিং বেড়েছে। গরমের কারণে গ্রাহকদের কষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন, তার পরও আমরা চেষ্টা করছি সর্বোচ্চ চাহিদার সময় উৎপাদন বাড়াতে। বড়পুকুরিয়া বিদ্যুত কেন্দ্রের নষ্ট হয়ে যাওয়া ইলেক্ট্রো-হাইড্রোলিক অয়েল পাম্প চীন থেকে হয়তো রোববার বা সোমবার চলে আসবে। আমরা বিশেষ ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ আনার ব্যবস্থা করেছি। যন্ত্রাংশ এসে পৌঁছালে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বড়পুকুরিয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে। তিনি বলেন, আশাকরি আগামী সপ্তাহের মধ্যেই লোডশেডিং দূর করতে পারবো।

 

ভোরের  আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version