-->
শিরোনাম
ড. ইউনূসের ভাষণের প্রতিক্রিয়া

সতর্ক বিএনপির তাগিদ নির্বাচনের সময় দিতে অনাপত্তি জামায়াতের

এম. সাইফুল ইসলাম
সতর্ক বিএনপির তাগিদ নির্বাচনের
সময় দিতে অনাপত্তি জামায়াতের

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে গত বুধবার রাতে দেওয়া ভাষণে রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখাসহ নানা বিষয়ে একগাদা প্রস্তাবনা ও কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরেছেন। প্রধান উপদেষ্টার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণ নিয়ে সর্বত্রই আলোচনা ও চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা ড. ইউনূসের ভাষণ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানানো থেকে এখনও বিরত রয়েছেন।

বিএনপির পক্ষ থেকে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিএনপির দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াত ইসলামী ভিন্ন সুরে কথা বলছেন। বিএনপির সঙ্গে তাদের দূরত্ব প্রকাশ্যে এসেছে। মির্জা ফখরুল যৌক্তিক সময়ে সংস্কার শেষে নির্বাচন আয়োজনের কথা বললেও জামায়াত আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেয়নি। জামায়াত ইসলামীর দুজন নেতার কাছে ভোরের আকাশের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তারা বলেছেন, প্রকৃত সংস্কার ছাড়া শুধুমাত্র নির্বাচন নয়, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনও সম্ভব নয়। তাই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের কাজ শুরু করেছে। ৬ কমিশন গঠন তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তা চায় বর্তমান সরকার সংস্কার কাজ করে একটি অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আয়োজন করবে।

অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত সংস্কারগুলো শেষ করে নির্বাচনের দিকে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আগামী ১৪ ও ১৫ সেপ্টেম্বরের কর্মসূচি নিয়ে অঙ্গসংগঠনের সঙ্গে যৌথ সভা শেষে এক ব্রিফিংয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে যেসব সংস্কারের কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা, তা যেন খুব তাড়াতাড়ি সম্পন্ন হয়। যাদের দায়িত্ব দিয়েছেন সংস্কারগুলো করার তা-ও যেন অতি দ্রুত হয়। তিনি আশা প্রকাশ করেন, অন্তর্বর্তী সরকার যত দ্রুত সম্ভব তাদের কাজগুলো শেষ করে নির্বাচনের দিকে যাবে।

মির্জা ফখরুল বলেন, সময়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গতকাল প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে বক্তব্য দিয়েছেন। সেখানে তিনি কতগুলো বিষয়ে সংস্কারের কথা বলেছেন। তিনি মোটাদাগে তার সরকারের ভিশন তুলে ধরেছেন।

বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘আমরা সবাই সংস্কারের কথা বলছি এবং সংস্কার যে প্রয়োজন, সেটা বলেছি। সে ক্ষেত্রে অতি দ্রুত যেন এই সংস্কারগুলো করা হয়। মূল যে বিষয়টা, গণতন্ত্রের জন্য জনগণের প্রতিনিধিদের যে শাসন, জনগণের নির্বাচিত সংসদ দিয়ে দেশ পরিচালনা, সে বিষয় যেন দ্রুততার সঙ্গে হয়, সেটি আমাদের প্রত্যাশা থাকবে।’

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের কাজ করছে। তাদের সময় ও সুযোগ দেওয়ার জন্য আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আশা করি, তারা যথাশিগগির তাদের কাজগুলো শেষ করে নির্বাচনের দিকে যাবে।’

অন্তর্বর্তী সরকারের সফলতা কামনা করে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘কারণ, এই সরকার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এসেছে। তবে এখানে একটি কথা খুব স্পষ্টভাবে বলা দরকার, গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। গণতন্ত্র হচ্ছে একমাত্র ব্যবস্থা, যা জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন গড়তে পারে। সে জন্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তৈরি করা হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কিন্তু সেই কাজটায় জনগণের অংশীদারত্ব থাকতে হবে। জনগণ কী চায়, সে বিষয়টা থাকতে হবে। আশা করি, সরকার উপলব্ধি করবে এবং যাদের সংস্কারের দায়িত্বে দেওয়া আছে, তারা অত্যন্ত সুচারুরূপে পালন করবেন।’

জনপ্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরে না আসা-সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘প্রাথমিক পর্যায়ে এ ধরনের কিছু সমস্যা থাকতেই পারে। কারণ, এ সরকার তো একটি সম্পূর্ণ নতুন সরকার। প্রশাসনে আওয়ামী লীগ যেটা করেছে, সম্পূর্ণ রাজনৈতিকীকরণ করতে গিয়ে সব লোক তাদেরই নিয়োগ দিয়েছে, পদায়ন করেছে, তাদেরই পদোন্নতি দিয়েছে। ফলে এটা একটু সময় লাগবে। সুতরাং নতুন করে অফিসার নিয়োগ দিয়ে তো কাজ করা সম্ভব নয়। ফলে যা আছে, তা নিয়ে আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে।’

শিল্পকারখানায় অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য পরিকল্পিতভাবে চক্রান্ত হচ্ছে বলে জানান মির্জা ফখরুল ইসলাম। তিনি বলেন, অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে নস্যাৎ করার জন্য একটা চক্র কাজ করছে। পতিত ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনা ভারতে বসে সেখান থেকে অপপ্রচার চালাচ্ছেন বাংলাদেশ সম্পর্কে, দেশের মানুষের সম্পর্কে। এই অপপ্রচারগুলো কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগষ্ট গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন নতুন সরকার। ওই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর নোবেলবিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুস জাতির উদ্দেশে বেশ কয়েকবার ভাষণ দিয়েছেন। সেখানে তিনি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান সংস্কারের গুরুত্বারোপ করেছেন। বর্তমান এ সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি দ্রুত সমেয় সংস্কারের পর একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের তাগিদ দিয়ে আসছে। দলটির নেতারা সব সময় বলছেন, সংস্কার অবশ্যই দরকার। তবে, সেই সংস্কারের নামে কেউ যেন সময়ক্ষেপণ না করে সে ব্যাপারে সতর্ক দলটি।

সব শেষ বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়া প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ওই ভাষণে তিনি, রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে নির্বাচন কমিশন, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, জনপ্রশাসন ও সংবিধান সংস্কার কমিশনসহ ছয়টি কমিশন গঠনের কথা জানিয়ে তার যারা থাকছেন তাদের নামও ঘোষণা করেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ড. বদিউল আলম মজুমদার, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান সরফরাজ চৌধুরী, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী ও সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক।

তার এ ভাষণ নিয়ে বিএনপি-জামায়াত নেতারা কী ভাবছেন বা তাদের প্রতিক্রিয়া কী ভোরের আকাশ তা জানার চেষ্টা করেছে। বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যান ড. আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, তিনি বলেন, প্রত্যেক শুরু একটা বিষয় থাকে। আমরা বুধধার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার ছয় কমিশন গঠনের মাধ্যমে বুঝতে পেরেছি তারা অন্তত সংস্কার কাজ শুরু করেছেন। আমরা মনে করছি, দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে এসব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছেন। তাই সংস্কার অবশ্যই জরুরি। চাইলে আজ শুরু করলে কালকেই কেউ কার্যকর সংস্কার করতে পারবে এমনটা আমি মনে করি না। আগামী মাসের শুরুর দিন থেকেই এই কমিশন কাজ শুরু করবে বলে আমরা জানতে পেরেছি। তারা কাজ শুরু করলেই আমরা বুঝতে পারবে কেমন গতিতে তারা কাজ করছেন। তবে, সংস্কারের নামে কেউ যেন অতিরিক্ত সময় না নেয় সে ব্যাপারে আমাদের দল সতর্ক রয়েছে।

বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ভোরের আকাশকে বলেন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সংস্কার অবশ্যই দরকার। তবে, সেটি যৌক্তিক সময়ে হতে হবে। কারণ, নির্বাচিত ছাড়া কখনো জবাবদিহিতামূলক সরকার গঠন করা সম্ভব নয়। তাই আমরা দ্রুত সংস্কারের পর একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাই।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মাওলানা আজীজুর রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, বুধবার সাংগঠনিক ৬ প্রতিষ্ঠান সংস্কারে কমিশন গঠনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সংস্কার কাজ শুরু করেছে বলে আমি মনে করছি। দীর্ঘ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠান বাজে অবস্থার সৃষ্টি করেছে। প্রকৃত অর্থে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হলে কার্যকর সংস্কার ছাড়া সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি।

জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম ভোরের আকাশকে বলেন, আমরা সব সময় বলে আসছি প্রকৃত সংস্কার ছাড়া শুধুমাত্র নির্বাচন নয়, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনও সম্ভব নয়। তাই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের কাজ শুরু করেছে। ৬ কমিশন গঠন তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তা চায় বর্তমান সরকার সংস্কার কাজ করে একটি অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আয়োজন করবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্তমান সরকার সংস্কারের নামে সময়ক্ষেপণ করবে এটা আমরা কেন মনে করছি। সে রকম কোনো কাজ বা ঘটনা আমরা দেখছি না। এছাড়া দেশবাসী সবাই এখন সতর্ক বলেও মনে করেন তিনি।

 

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version