-->
শিরোনাম

তিস্তার বুকে বেক্সিমকোর নখের আঁচড়

আশীষ কুমার দে
তিস্তার বুকে বেক্সিমকোর নখের আঁচড়
  • সমীক্ষা ছাড়াই নদীর চরে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প
  • পাউবোর আপত্তির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন
  • নেওয়া হয়নি পানি বিশেষজ্ঞদের মতামত
  • তীব্র ভাঙনের কবলে নদীতীর ও সমতল ভূমি

পানি বিশেষজ্ঞদের মতামত না নিয়ে এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের আপত্তির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে তিস্তাতীরে নির্মাণ করা হয়েছে ‘তিস্তা সোলার পাওয়ার লিমিটেড’। রংপুরের পীরগাছা উপজেলার তিস্তার চরের লাঠশালায় অপরিণামদর্শী এ সৌরবিদ্যুৎ প্ল্যান্ট নির্মাণ করেছেন বহুল আলোচিত-সমালোচিত শিল্পগোষ্ঠী বেক্সিমকো গ্রুপ; যার মালিক সদ্যসাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিল্প-বাণিজ্য ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা, বহুল বিতর্কিত ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি সালমান ফজলুর রহমান, যিনি দেশে-বিদেশে সালমান এফ রহমান নামে পরিচিত।

প্রচলিত বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করে, এ সংক্রান্ত কোনো ধরনের সমীক্ষা ছাড়া এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হলেও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং বিদ্যুৎ, জ¦ালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের উচ্চ মহল থেকে কোনো বাধা দেওয়া হয়নি। বরং পরিবেশবিনাশী এ কাজের জন্য প্রতিষ্ঠানটির অনুকূলে ৬৫০ একর সরকারি জমি ইজারা এবং প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ দেওয়া হয়েছে। অপরিণামদর্শী এই সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ফলে তিস্তার ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে, সেই সঙ্গে সমতল ভূমিও পড়েছে ভাঙনের কবলে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বেক্সিমকো ২০১৭ সালে বিশাল এই সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ কাজ শুরু করে। তিস্তার চর ও তৎসংলগ্ন সমতল ভূমি মিলিয়ে ১ হাজার ৬০০ একর জমি নিয়ে শুরু হয় এই নির্মাণকাজ। এর মধ্যে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে ক্রয়কৃত জমির পরিমাণ ৯৫০ একর এবং বাকি ৬৫০ একর জমি সরকারের কাছ থেকে ইজারা নেওয়া। অভিযোগ রয়েছে, এলাকার দরিদ্র পরিবারগুলোকে নানা রকম ভয়ভীতি দেখিয়ে এবং অনেককে বিদ্যুৎকেন্দ্রে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে পানির দরে তাদের জমি কেনা হয়।

সালমান এফ রহমানের ক্ষমতার দাপট শুধু এখানেই নয়। তিস্তা সোলার পাওয়ার লিমিটেডে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তির জমির ওপর দিয়ে রংপুর শহর পর্যন্ত হাইভোল্টেজের ২৯ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করে প্রতিষ্ঠানটি। কোম্পানির পক্ষ থেকে তখন বলা হয়েছিল, যাদের জমির ওপর দিয়ে সঞ্চালন লাইন স্থাপন হবে, তাদেরকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত কোনো জমির মালিককে টাকা দেওয়া হয়নি। আর যেসব মালিক আর্থিক ক্ষতিপূরণের বিনিময় জমির ওপর ওপর দিয়ে সঞ্চালন লাইন নির্মাণে আপত্তি তুলেছিলেন, তাদেরকে পুলিশের ভয়ভীতি দেখিয়ে নিশ্চুপ থাকতে বাধ্য করা হয়।

অনুুসন্ধানে জানা গেছে, কাগজপত্রে তিস্তা সোলার পাওয়ার লিমিটেডকে ‘সরকারি ঋণসহায়তায় পীরগাছা ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী চর লাটশালায় তিস্তা নদী অববাহিকার পরিত্যক্ত ও অকৃষি সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে নির্মিত নবায়নযোগ্য একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান’ বলা হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে সালমান এফ রহমান ও বেক্সিমকো গ্রুপের কোনো সংশ্লিষ্টাতা নেই বলেও দাবি করা হয়েছিল। তবে তিস্তা সোলার পাওয়ার লিমিটেডের চেয়ারম্যান হিসাবে নাম রয়েছে সায়ন ফজলুর রমানের; যিনি বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধর সালমান এফ রহমানের ছেলে। এতেই প্রতীয়মান হয় যে, প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত মালিক সালমান এফ রহমান ও বেক্সিমকো। এছাড়া গত ২৮ মার্চ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বাণিজ্যবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান রংপুরে ১৪ দলের মহাসমাবেশে এসে ভার্চুয়ালি বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধন এবং হেলিকপ্টারে ওই এলাকা পরিদর্শন করেন। এতে সালমান এফ রহমানের মালিকানার বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে যায়।

নদী অববাহিকায় বড় কোনো অবকাঠামো বা প্রকল্প স্থাপন করতে হলে স্বাভাবিকভাবেই পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিদ ও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের কারিগরি দলের সমীক্ষা প্রতিবেদন নেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু তা নেওয়া হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে। এর ফলে রংপুরের ভাটিতে তিস্তার ভাঙন প্রবল হয়েছে। নদীর গতিপথ পরিবর্তন হওয়ায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তিস্তার ভাঙনের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় উলিপুর ও রাজারহাট উপজেলার তিস্তার অববাহিকায় সমতল ভূমি, আবাদি জমি, বাড়িঘরসহ বিভিন্ন অবকাঠামো ভাঙনের মুখে পড়েছে। ক্রমাগত ভাঙন বাড়ছে।

তিস্তা সোলার পাওয়ার লিমিটেড নির্মাণের আগে পানি উন্নয়ন বোর্ড কিংবা সংশ্লিষ্ট অন্য কোনো পক্ষের মতামত নেওয়া হয়েছিল কিনা, জানতে চাইলে উত্তরাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান জানান, পাউবোর কোনো অনাপত্তিপত্র নেওয়া হয়নি। তাদের আপত্তি সত্ত্বেও বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়েছে। এ কারণে ওই প্রকল্পের বিস্তারিত তথ্য পাউবোর কাছে নেই।

জানতে চাইলে বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ও পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, তিস্তা নদীর বুকে তিস্তা সোলার পাওয়ার লিমিটেড স্থাপন করা হয়েছে, যা তিস্তার জীবন্ত সত্তাকে ধ্বংস করার শামিল। অপরিণামদর্শী এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে তিস্তার গতিপ্রকৃতি পরিবর্তিত হয়েছে। ফলে উলিপুর ও রাজারহাট এলাকায় তিস্তার ভাঙন প্রবল আকার ধারণ করেছে বলে মন্তব্য করেন এই পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ।

ভোরের আকাশ/ সু

মন্তব্য

Beta version