-->
ঢাবি ও জাবির দুই হত্যাকান্ড

জড়িতদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন শুরু

গোলাম মুজতবা ধ্রুব
জড়িতদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন শুরু

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে ‘চোর সন্দেহে’ তোফাজ্জল হোসেন নামের এক যুবককে আটক করে পিটিয়ে হত্যা এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লাকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে জিরো টলারেন্স নীতিতে রয়েছে পুলিশ। এরই মধ্যে পৃথক দুটি ঘটনায়ই শাহবাগ ও আশুলিয়া থানায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মামলা দায়ের করেছে। দুই ঘটনাতেই জড়িতদের একটি অংশকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চিহ্নিত করেছে থানায় সোপর্দ ও সাময়িকভাবে বহিষ্কারও করেছে। তবে দুইটি ঘটনা কেন ঘটেছে এবং এতে জড়িত প্রত্যেককেই আইনের আওতায় আনা হবে বলে আশ্বস্ত করছে পুলিশ।

জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে ‘চোর সন্দেহে’ তোফাজ্জল হোসেনকে (৩০) পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় এরই মধ্যে ছয় শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা বিভিন্ন তথ্য দিচ্ছে। আরও তথ্য পেতে শাহবাগ থানা পুলিশ তাদের রিমান্ড চাইবে।

শুক্রবার বিকেলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) শাহবাগ থানা অফিসার্স ইনচার্জ (ওসি) মো. খালিদ মনসুর বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চোর সন্দেহে যুবককে হত্যার ঘটনায় এরই মধ্যে ছয় জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা কিনা সেটা জিজ্ঞাসাবাদে জানার চেষ্টা করা হবে। এজন্য পুলিশ তাদের রিমান্ড চাইবে। এ ঘটনায় যারাই জড়ির তাদের সবার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গত বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত ওই যুবককে হত্যার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ছয় শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারা হলেন, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মো. জালাল মিয়া, মৃত্তিকা পানি ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী সুমন মিয়া, পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের মো. মোত্তাকিন সাকিন, গণিত বিভাগের আহসান উল্লাহ, জিওগ্রাফির আল হোসেন সাজ্জাদ এবং অপর শিক্ষার্থী ওয়াজিবুল আলম।

ডিএমপির জনসংযোগ ও গণমাধ্যম শাখা উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান, তোফাজ্জল হোসেন হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তারদের রিমান্ডের আবেদন করে আদালতে সোপর্দ করা হবে। এছাড়া ঘটনার কারণ অনুসন্ধান, জড়িতদের চিহ্নিতকরণ ও গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য থানা পুলিশের পাশাপাশি ডিবির একাধিক টিম কাজ করছে।

ওই ঘটনায় ডিএমপির শাহবাগ থানায় মামলা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট অফিসের সুপারভাইজার মোহাম্মদ আমানুল্লাহ।

মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, ১৮ সেপ্টেম্বর রাত পৌনে ৮টার সময় এক যুবক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের গেটে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করছিলেন। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র তাকে আটক করে প্রথমে ফজলুল হক মুসলিম হলের মূল ভবনের গেস্ট রুমে নিয়ে যান। মোবাইল চুরির অভিযোগে তারা ওই যুবককে এলোপাতাড়ি চড়-থাপ্পড় ও কিলঘুসি মারেন। জিজ্ঞাসাবাদে ওই যুবক তার নাম তোফাজ্জল বলে জানান। পরে তিনি মানসিক রোগী বুঝতে পেরে তাকে হলের ক্যান্টিনে নিয়ে খাবার খাওয়ান। এরপর তাকে হলের দক্ষিণ ভবনের গেস্ট রুমে নিয়ে জানালার সঙ্গে হাত বেঁধে স্টাম্প, হকিস্টিক ও লাঠি দিয়ে উচ্ছৃঙ্খল কিছু ছাত্র বেধড়ক মারধর করলে তিনি অচেতন হয়ে পড়েন।

সংবাদ পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন আবাসিক শিক্ষক তাকে ঢাক মেডিক্যাল কলেজ হাস জরুরি বিভাগে নিয়ে যান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকগণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওই ঘটনা শাহবাগ থানায় অবহিত করলে পুলিশ মৃতদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত করে। ময়নাতদন্ত শেষে নিহতের মরদেহ তার আত্মীয়-স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা করা হয়।

স্বজন সূত্রে জানা গেছে, তোফাজ্জলের পরিবারের কোনও সদস্য আর বেঁচে নেই। তার বাবা আবদুর রহমান মারা গেছেন ২০১১ সালে, মা বিউটি বেগম মারা যান ২০১৩ সালে এবং ভাই পুলিশের সাবেক সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) নাসির উদ্দিন মারা যান ২০২৩ সালে। পরিবারের কেউ না থাকায় কখন, কোথায় থাকেন তা কেউ খোঁজও রাখেন না।

তোফাজ্জল ২০০৯ সালে চরদুয়ানী মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ২০১১ সালে সৈয়দ ফজলুল হক ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি এবং পিরোজপুর সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে বাংলা বিভাগে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেন। বড় ভাই মারা যাওয়ার পর তাকে দেখাশোনা করার মতো কেউ ছিল না। স্বজনরা জানান, কয়েক বছর ধরে মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন তোফাজ্জল।

অন্যদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লাকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় আশুলিয়া থানায় মামলা হয়েছে। হত্যা মামলাটিতে আটজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় ২০-২৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একজনকে আটক করেছ আশুলিয়া থানা-পুলিশ। গত বৃহস্পতিবার রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা শাখার ডেপুটি রেজিস্ট্রার সুদীপ্ত শাহীন বাদী হয়ে মামলাটি করেন।

মামলায় বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার বিভাগের ৪৯তম ব্যাচের আহসান লাবিব, সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের রাজু আহাম্মদ, ইংরেজি বিভাগের ৫০তম ব্যাচের মাহমুদুল হাসান রায়হান, ইতিহাস বিভাগের ৪৪তম ব্যাচের জুবায়ের আহমেদ, ইংরেজি বিভাগের ৪৯তম ব্যাচের হামিদুল্লাহ সালমান, ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের ৪৯তম ব্যাচের মো. আতিকুজ্জামান, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের সোহাগ মিয়া, সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ রাজন মিয়ার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। শামীম হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়ায় ওই আট শিক্ষার্থীকে বৃহস্পতিবারই সাময়িক বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

এ ছাড়া জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হাবীবুন নবী নামের এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়। প্রাথমিকভাবে তাঁর বিস্তারিত পরিচয় পাওয়া যায়নি।

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, গত বুধবার বিকেল ৫টা ৫০ মিনিটের দিকে শামীম মোল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তিক ফটকে এলে কয়েকজন ব্যক্তি তাঁকে মারধর করেন। খবর পেয় প্রক্টরিয়াল টিম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে আহত অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করে প্রক্টরের কার্যালয়ে নিয়ে যান। আহত শামীমকে প্রক্টর কার্যালয়ের একটি কক্ষে রেখে প্রক্টর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আশুলিয়া থানা-পুলিশকে বিষয়টি অবহিত করেন। এর মধ্যে কতিপয় ব্যক্তি প্রক্টরিয়াল টিমকে না জানিয়ে জোর করে শামীম মোল্লাকে প্রক্টর কার্যালয়ের পাশে নিরাপত্তা কার্যালয়ে নিয়ে যান। প্রক্টর বিষয়টি জানতে পেরে বিক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের সেখান থেকে সরিয়ে দিয়ে নিরাপত্তা কার্যালয়ের কলাপসিবল গেটে তালা লাগিয়ে দেন। পরে সেখানে নিরাপত্তাকর্মীদের পাহারায় রেখে প্রক্টরের কার্যালয়ে ফিরে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এর মধ্যে পুনরায় কয়েকজন উত্তেজিত হয়ে নিরাপত্তা কার্যালয়ের কলাপসিবল গেটের তালা ভেঙে শামীম মোল্লাকে আবারও মারধর করেন।

এজাহারে বলা হয়, পরে প্রক্টরিয়াল টিম ও নিরাপত্তা শাখার কর্মকর্তারা শামীম মোল্লার সামনে দাঁড়িয়ে বিক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের থামান। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে পুলিশ সদস্যরা এসে জানান, শামীমের নামে একাধিক মামলা আছে। রাত আটটার দিকে শামীমকে পুলিশের গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়। আশুলিয়া থানায় নিয়ে যাওয়ার পথে শামীমের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে রাত নয়টার দিকে তাঁকে মৃত ঘোষণা করে কর্তব্যরত চিকিৎসক। উল্লিখিত ঘটনায় আহসান লাবিব, রাজু আহাম্মদ, মাহমুদুল হাসান রায়হান, জুবায়ের আহমেদ, হামিদুল্লাহ সালমান, মো. আতিকুজ্জামান, সোহাগ মিয়া, মোহাম্মদ রাজন মিয়াসহ অজ্ঞাতপরিচয় ২০-২৫ জনের সম্পৃক্ত ছিলেন।

মামলা ও এক ব্যক্তিকে আটকের বিষয়গুলো নিশ্চিত করেছেন আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবু বকর সিদ্দিক। তিনি জানান, এ ঘটনায় একজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বৃহস্পতিবার রাত তিনটার দিকে ধামরাই পৌরসভা এলাকা থেকে থানায় আনা হয়েছে।

পুলিশ সদর দফতরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের এআইজি ইনামুল হক সাগর ভোরের আকাশকে বলেন, আইন যারাই নিজের হাতে তুলে নেবে পুলিশ তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেবে। কেউ অপরাধ করে থাকলে তাকে নিকটস্থ থানায় হস্তান্তর করার জন্য আমরা আহ্বান জানাচ্ছি। পাশাপাশি কোন অপরাধ সংক্রান্ত খবর জানাতে প্রয়োজনে ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চাইলেও আমাদের পাওয়া যাবে। তাই বারবার আমরা সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছি কেউ যেন আইন নিজের হাতে তুলে না নেন।

তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) দুইটি ঘটনাই পুলিশ অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে। অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার বিষয়ে পুলিশ জিরো টলারেন্স নীতিতে রয়েছে। এরই মধ্যে কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। দুইটি ঘটনায় যারাই জড়িত থাকুক না কেন প্রত্যেককেই আইনের আওতায় আনা হবে, কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।

ভোরের আকাশ/ সু

মন্তব্য

Beta version