- অধিবেশন চলার ফাঁকে কোনো দেশের শীর্ষ নেতার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক কিংবা সাক্ষাৎ প্রায় বিরল।
- গত তিন দশকে জাতিসংঘের অধিবেশনের ফাঁকে বাংলাদেশের কোনো শীর্ষ নেতার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের হয়নি।
- বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্ব এবং আন্তর্জাতিক অর্থায়ন সংস্থাগুলো যে জোরালোভাবে যুক্ত থাকবে, এই বৈঠক সেই বার্তাই দিচ্ছে, মত কূটনীতিক বিশ্লেষকদের
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশগ্রহণের জন্য আজ সোমবার নিউইয়র্কে যাচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ঘরে-বাইরের চলমান পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের এবারের অধিবেশনের ড. ইউনূসের যোগদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো-বাইডেনের সঙ্গে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক ঘিরে সর্বত্রই আলোচনা চলছে। কারণ গত তিন দশকে বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্টের এমন বৈঠক কখনো হয়নি। বাইডেনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের কারণে ২৪ সেপ্টেম্বরের পরিবর্তে একদিন আগে নিউইয়র্কের উদ্দেশে রওনা হচ্ছেন।
কূটনীতিক সূত্রগুলো বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সাধারণত জাতিসংঘ অধিবেশনে তার নির্ধারিত বক্তৃতার দিন সকালে নিউইয়র্কে পৌঁছান। তিনি সেদিন সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বক্তৃতা দেন। এরপর বিকেলে জাতিসংঘের অধিবেশনে আগত রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সম্মানে সংবর্ধনার আয়োজন করেন। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলার ফাঁকে কোনো দেশের শীর্ষ নেতার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক কিংবা সাক্ষাৎ প্রায় বিরল। গত তিন দশকে জাতিসংঘের অধিবেশনের ফাঁকে বাংলাদেশের কোনো শীর্ষ নেতার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের এ ধরনের কোনো বৈঠক হয়নি। বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সঙ্গে সব সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সংবর্ধনায় দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে।
কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক বলেছেন, গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ডোনাল্ড লু’র নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা সফর করে গেছেন। দুই সপ্তাহের মাথায় প্রেসিডেন্ট জো-বাইডেন বৈঠক করতে যাচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে। এটি তাৎপর্যপূর্ণ। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিভিন্ন খাতের সংস্কারসহ বাংলাদেশের সামনের দিনের অগ্রযাত্রায় যুক্তরাষ্ট্র যে সব ধরনের সহায়তা করবে, নিউইয়র্কের আসন্ন বৈঠক সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। একইসঙ্গে দেশের ভেতরে ও বাইরে বিরোধিতাকারীদের উদ্দেশ্যে বার্তা দেওয়া যে যুক্তরাষ্ট্র ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে রয়েছে। জো-বাইডেনের সঙ্গে বৈঠকের পাশাপাশি ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েনের সঙ্গে বৈঠক করবেন ড. ইউনূস। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করবেন। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্ব এবং আন্তর্জাতিক অর্থায়ন সংস্থাগুলো যে জোরালোভাবে যুক্ত থাকবে, এই বৈঠকগুলো সেই বার্তাই দিচ্ছে বলে মনে করেন তারা।
কূটনীতিকরা বলছেন, ভূ-রাজনীতির বেড়াজালে বাংলাদেশ। বিশ^ মোড়লদের বিরোধপূর্ণ সম্পর্কের প্রভাবও দেশটির ওপর পড়ছে। বিশ্বনেতৃত্বের বড় অংশ অন্তর্বর্তী সরকারকে স্বাগত জানিয়েছে এবং তারা সহযোগিতা দিতে নিজেদের প্রস্তুতির কথাও ব্যক্ত করেছেন। তবে এই মুহূর্তে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সঙ্গে কিছু বিষয়ে বাংলাদেশের টানাপড়েন চলছে। বিশ^নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পর্কের মাপকাঠি নির্ধারণের জটিল সমস্যায় পড়েছে বাংলাদেশ। বিশ^ নেতৃত্বের মধ্যকার সম্পর্ক পর্যালোচনা করে এগোতে হচ্ছে দেশটিকে। ভারত ও চীনের স্নায়ুযুদ্ধ দীর্ঘদিনের। চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক সব সময়ই সাংঘর্ষিক। প্রভাবশালী রাষ্ট্র চীন, রার্শিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র-প্রত্যেকই বাংলাদেশের ওপর প্রভূত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আবার প্রতিবেশি বড় রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের ওপর অন্য দেশের কর্তৃত্ব মেনে নিতে নারাজ ভারত। ফলে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন ও জোরালো করার ক্ষেত্রে চতুর্মুখী চাপে রয়েছে বাংলাদেশ। এমন প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের এবারের অধিবেশনে অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানের অংশগ্রহণ, বিশে^নেতাদের সঙ্গে বৈঠক এবং মজবুত সম্পর্ক নিশ্চিত করার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কার্যত ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান হওয়ায় কূটনীতিতে এর প্রভাব পড়ছে যা বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক বলে মনে করছেন কূটনীতিকরা। ড. ইউনূসের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্টের বৈঠকের মাধ্যমে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের পক্ষে তাদের শক্ত অবস্থান প্রতিপক্ষকে জানান দেওয়া বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অভ্যুত্থানের বীরত্বগাঁথা জাতিসংঘে তুলে ধরবেন ড. ইউনূস
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে ভাষণ দেবেন। এতে তিনি দেশে জুলাই-আগস্টে সংঘটিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপট এবং ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের বীরত্বগাঁথা তুলে ধরবেন। একই সঙ্গে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্র মেরামতের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া সংস্কার কার্যক্রম বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করবেন প্রধান উপদেষ্টা। এই তথ্যটি সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেন, এবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টা যে বক্তব্য দেবেন, সেখানে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের বীরত্বগাঁথা তুলে ধরা হবে। ছাত্ররা প্রাণের বিনিময়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে কীভাবে সফল অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন এবং মানুষের মধ্যে নতুন স্বপ্নের বীজ বপন করেছে, প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে তার প্রতিফলন থাকবে।
এ ছাড়া বাংলাদেশের দ্বিতীয় বিজয়ের নতুন যাত্রায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সুশাসন এবং অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন ব্যবস্থাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে যেসব সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, ড. ইউনূসের বক্তব্যে সেসব তুলে ধরা হবে বলে জানান শফিকুল আলম।
শেখ হাসিনার একনায়কতান্ত্রিক শাসনের অবসানের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের দর্শন বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করবেন ড. ইউনূস। নিজেদের গর্বিত ও মর্যাদাশীল জনগণ হিসেবে বিশ্ব পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ কীভাবে নিজেদের তুলে ধরবে, সেটিই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জানাবেন তিনি।
শফিকুল আলম আরও বলেন, ভবিষ্যতের বাংলাদেশ নিয়ে দেশের ছাত্র-জনতার আশা-আকাক্সক্ষার কথা উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা ভূরাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হতে উদাত্ত আহ্বান জানাবেন।
প্রধান উপদেষ্টার ৫৭ জনের বহর
গত শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন জানান, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশগ্রহণের জন্য এই সফরে প্রধান উপদেষ্টা ছাড়াও তার সঙ্গে ৫৭ জনের একটি বহর যাবে, যার মধ্যে রয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী, গণমাধ্যমকর্মী এবং অন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকার ব্যয় সংকোচনের নীতিতে বিশ্বাসী। তবে কিছু ক্ষেত্র আছে যেখানে ব্যয় সংকোচন করা সম্ভব নয়। নিরাপত্তা সবার আগে। সে প্রয়োজনীয়তাকে সামনে রেখে ৫৭ জনের এ দলটি যাচ্ছে।
তৌহিদ হোসেন আরও বলেন, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে জাতিসংঘ অধিবেশনে অংশ নিতে যে বড় বহর নিয়ে যাওয়া হতো, তা ব্যাখ্যা করতে তিনি অপারগ।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা আরও বলেন, আমাদের এবারের দলটি শুধু প্রয়োজনীয় ব্যক্তিদের নিয়েই গঠিত, যার মধ্যে একটি বড় অংশ নিরাপত্তা ও প্রেসের সদস্য। এ সফর সরকারের ব্যয় সংকোচনের নীতির প্রতিফলন।
সার্ক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা-সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করতে আগ্রহী। সে কারণে সার্ক নেতাদের সঙ্গে একটি বৈঠক ও ফটো সেশন করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরে সার্কের কোনো সামিট হয় না। সে কারণে জাতিসংঘ অধিবেশনেই সার্ক নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের সুযোগ কাজে লাগাতে আগ্রহী প্রধান উপদেষ্টা। আর এটি সম্ভব হলে নতুন চমক তৈরি হবে।
কূটনীতিকরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস আসন্ন জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দেবেন। সেখানে বাংলাদেশের জনগণের নতুন স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষার কথাও তুলে ধরবেন। জাতিসংঘ অধিবেশন ঘিরে বেশ কিছু নতুন চমক দেখাতে পারেন প্রধান উপদেষ্টা। এ বছরের অধিবেশন বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এ বছরই জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রাপ্তির ৫০ বছরপূর্তি হচ্ছে। এ উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিতিতে ২৪ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সদরদপ্তরে একটি উচ্চ পর্যায়ের সংবর্ধনার আয়োজন করছে বাংলাদেশ। এতে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি দলের প্রধানদের পাশাপাশি জাতিসংঘের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা, সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান, বিভিন্ন সংস্থার প্রধানরা অংশগ্রহণ করবেন বলে আমরা আশা করা হচ্ছে। অনেক বিশ্বখ্যাত সংবাদ সংস্থা প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানিয়েছে। এ ছাড়া তার বিভিন্ন পর্যায়ে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক ও সভায় অংশগ্রহণ করার জন্যও অনুরোধ এসেছে।
ভোরের আকাশ/ সু
মন্তব্য