-->
জাতিসংঘে ড. ইউনূসের বাজিমাত

নতুন বাংলাদেশের পাশে থাকার জোড়ালো বার্তা

নিজস্ব প্রতিবেদক
নতুন বাংলাদেশের পাশে
থাকার জোড়ালো বার্তা

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং বাংলাদেশের সমর্থনে জোড়ালো বার্তা এসেছে বিশ্বনেতাদের কাছ থেকে। বিশেষ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো-বাইডেনের সঙ্গে ড. ইউনূসের ঐতিহাসিক বৈঠকের ওপর নজর ছিল গোটা বিশ্বের। ওই বৈঠক থেকে জো-বাইডেন যেকোনো প্রয়োজনে বাংলাদেশের পাশে থাকার কথা জানিয়েছেন। মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো-বাইডেনের বৈঠক নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে হোয়াইট হাউস। এতে বলা হয়, বৈঠকে বাইডেন বলেছেন, বাংলাদেশের নতুন সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে মার্কিন সমর্থন অব্যাহত থাকবে। এছাড়া রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশে তাদের আশ্রয়দানকারী স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য নতুন করে প্রায় বিশ কোটি ডলারের আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফসহ বেশ কয়েকজন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে প্রধান উপদেষ্টার। তারা প্রত্যেকেই ড. ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন বাংলাদেশের পাশে থাকার জোড়ালো বার্তা দিয়েছেন। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বাংলাদেশকে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আগামীকাল শুক্রবার ড. ইউনূসের জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার কথা রয়েছে।

ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভের মঞ্চেও বক্তব্য দিয়েছেন ড. ইউনূস। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন নিজেও এ সময় উপস্থিত ছিলেন। জাতিসংঘে মি. ইউনূসের বাংলাদেশের সরকার প্রধান হিসেবে উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে প্রেসিডেন্ট জো-বাইডেন ও বিল ক্লিনটনের উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিমার ছবিতে সয়লাব হয়ে গেছে বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার আগেই বিশ্বে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যক্তিত্ব, মেধা ও সৃজনশীলতা বিশ্বে পরিচিত। গত কয়েক যুগ ধরে তার পাশে শক্ত অবস্থান নিয়েছে বিশ্বমোড়ল জোট। বিগত সময়ে বিশ্বনেতাদের তার পাশে দাঁড়ানোর ঘটনা তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ড. ইউনূসের বিচার প্রক্রিয়া স্থগিত চেয়ে ২০২৩ সালের গত সেপ্টেম্বরেও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনসহ ১৬০ জন বিশ্বনেতা বিবৃতি প্রদান করেন। এর আগে একই বছরের মে মাসে বিশ্বের ৪০ জন রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক, ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একই ধরনের খোলা চিঠি দিয়েছিলেন। একই বছরের মার্চ মাসে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে বিচারের নামে হয়রানি বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চকক্ষ সিনেটের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা (মেজরিটি হুইপ) ডিক ডারবিন। শুধু তাই নয়, ইউনূসের ওপর প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধে সরকার ব্যর্থ হলে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় অংশীদারত্বে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের সিনেটর এই ডেমোক্র্যাট নেতা। সরকার প্রধান হিসেবে ড. ইউনূসের জাতিসংঘে উপস্থিতির পর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো যে উচ্ছ্বসিত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তা থেকে বাংলাদেশ সহযোগিতার বার্তা পেয়েছে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক বার্তা পেয়েছে।

গত কয়েক বছর ধরে গণতন্ত্র ও নির্বাচন ইস্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের টানাপড়েন দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল। এই টানাপড়েনের দৃশ্যমান সূচনা হয়েছিল ২০২১ সালের ডিসেম্বরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে এলিট ফোর্স র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে। পরে ২০২৩ সালের পঁচিশে মে যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন সামনে রেখে ভিসা নীতি ঘোষণা করে, যা তখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারকে নজিরবিহীন চাপে ফেলে দিয়েছিল। ওই সময় শেখ হাসিনা নিজে ও তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র সমালোচনা করেছেন। বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ বা ওই এলাকায় সামরিক ঘাঁটি করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র, এমন বক্তব্যও তারা দিয়েছেন, যা যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই অস্বীকার করে আসছে।

যদিও নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার কথা বলেছে যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু তাতেও আস্থা কিংবা উষ্ণতার ঘাটতি অনেকের কাছে দৃশ্যমান ছিল।

এমন পরিস্থিতিতে জুলাইতে সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়, যা পরে সরকার বিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয় যা শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। তার পদত্যাগের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নিলে পশ্চিমারা তাকে স্বাগত জানায়।

বিশ্লেষকরা বলছেন, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার প্রধান হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের এবারের সফরে বাংলাদেশ তার সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও গণতন্ত্রের উত্তরণের জন্য বৈশ্বিক সমর্থনের বার্তা পেয়েছে। তারা মনে করেন এ কারণে বৈশ্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সব সংস্থা এখন বাংলাদেশের দিকে তাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন সাংবাদিকদের বলেন, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অধ্যাপক ইউনূসের যে গ্রহণযোগ্যতা তাতে এ ধরনের অভ্যর্থনাই তার জন্য স্বাভাবিক। প্রভাবশালী রাষ্ট্র নেতারা যেভাবে তাকে গ্রহণ করেছেন তাতে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও বেড়েছে বলে জানান অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন।

তিনি আরও বলেন, ওনার (ড. ইউনূস) আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার কারণেই সবাই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের সংস্কারের ক্ষেত্রে পশ্চিমারা সঙ্গে থাকার শক্তিশালী বার্তা দিয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য খুবই দরকার ছিল।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলছেন, বাংলাদেশে যে একটি নতুন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বা দেশটি যে নতুন দিকে যাচ্ছে সেই বার্তাই মুহাম্মদ ইউনূসের মাধ্যমে বাইরের পৃথিবীতে গেল। তাকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রে যা হয়েছে তাতে বাংলাদেশ নিয়ে ইতিবাচক বার্তা বিশ্ব পেয়েছে। এখন বাংলাদেশ যে প্রক্রিয়ায় এগুতে চাইছে তা নিয়ে বিশ্ব বুঝতে চেষ্টা করবে। আবার বাংলাদেশও এটি জেনেছে যে সংস্কার কার্যক্রম বৈশ্বিক সমর্থন পাবে বলে জানান হুমায়ুন কবির।

কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার আগেই বিশে^ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যক্তিত্ব, মেধা ও সৃজনশীলতা ছড়িয়ে পড়েছিল। যা এখন বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভিত্তি মজবুতকরণ এবং দেশ সংস্কারে কাজে লাগানো যাবে। বিশ্বে গরিবের ব্যাংকার হিসেবে পরিচিত ক্ষুদ্রঋণের জনক অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও তার তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংককে ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়। গ্রামীণ ব্যাংক ছাড়াও গত কয়েক দশকে মুহাম্মদ ইউনূস দরিদ্র বাংলাদেশিদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং ফোন পরিষেবা প্রদানসহ কয়েক ডজন সামাজিক কাজ করে আসছেন। গত কয়েক দশকে ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক, গ্রামীণ টেলিকম, গ্রামীণ কল্যাণ, গ্রামীণ ফাউন্ডেশন, গ্রামীণ ফান্ড, গ্রামীণ মৎস্য ফাউন্ডেশন, গ্রামীণ উদ্যোগ, গ্রামীণ সামগ্রী, গ্রামীণ শক্তিসহ ৫০টির বেশি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। এখন পর্যন্ত দারিদ্র্য দূরীকরণে ক্ষুদ্রঋণ বা সামাজিক ব্যবসার এই মডেল পৃথিবীর ৪০টির বেশি দেশে ১৩০টির বেশি প্রতিষ্ঠান ধারণ করে চলেছে। বিশ্বের ৮০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে তার নামে ‘ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে তার চিন্তা, কাজ, ভবিষ্যৎ লক্ষ্য ও তার জীবনাদর্শ নিয়ে গবেষণা হয়।

অধ্যাপক ইউনূসের অর্জিত অন্যান্য আন্তর্জাতিক পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে র‌্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার, বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার, সিডনি শান্তি পুরস্কার। আর বাংলাদেশে তিনি পেয়েছেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কার (১৯৭৮), কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুরস্কার (১৯৮৫) এবং সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৮৭)। ইউনুস পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি ও অনেক পুরস্কারে ভুষিত হয়েছেন। কানাডা ও জাপানের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে ড. ইউনূসের জীবনী অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

 

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version