-->

উত্তরাঞ্চলে বন্যার পদধ্বনি

ভোরের আকাশ প্রতিবেদক
উত্তরাঞ্চলে বন্যার পদধ্বনি
  • টানা প্রবল বর্ষণে বেড়েছে পানি
  • তিস্তার ৪৪টি জলকপাট খোলা
  • গজলডোবা খুলেছে ভারত

কয়েক দিনের টানা প্রবল বর্ষণে বেড়েছে দেশের নদ-নদীর পানি। অতিরিক্ত পানির কারণে খুলে দেওয়া হয়েছে তিস্তা ব্যারেজের ৪৪টি জলকপাট। একই কারণে ভারতের গজলডোবা ব্যারেজও খুলে দিয়েছে ভারত। ফলে উত্তরাঞ্চলের নদ-নদীর পানি হু হু করে বাড়ছে। দ্রুতই নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও রংপুরের নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, কয়েক দিন ধরে তিস্তা নদীর পানি বাড়ছে। পানি আরও দ্রুত বাড়তে পারে। এতে নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও রংপুরের নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে। জানা গেছে, বাংলাদেশে গত কয়েকদিন ধরে ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ায় তিস্তা নদীর পানি এমনিতেই বাড়ছে। এর মাঝে শুক্রবার দুই দফায় গজলডোবা বাঁধ দিয়ে প্রায় ১১ হাজার কিউমেক পানি ছেড়েছে ভারত। এই বিপুল পরিমাণ পানি ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে আগে থেকে তাদের কিছুই জানায়নি দেশটি।

কিউমেক মানে হলো কোন নদী বা জলধারা থেকে প্রতি সেকেন্ডে কত ঘন মিটার পানি ছাড়া হয়েছে, তার হিসাবের একক। প্রতি সেকেন্ডে এক ঘনফুট পানি বা প্রায় ২৮.৩১ লিটার পানি ছাড়া হলে তাকে এক কিউসেক বলা হয়ে থাকে। আর ৩৫.৩১ কিউসেকে এক কিউমেক হয়।

তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ৩২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাটের সবগুলো খুলে দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। শুক্রবার বিকেলে তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে ৫১.৮৩ সেন্টিমিটার পানি প্রবাহ রেকর্ড করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এর আগে বৃহস্পতিবার বিকেলে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ৬৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। এদিকে তিস্তায় পানি বৃদ্ধিতে দেখা দিয়েছে নদ-নদীর ভাঙন।

দুই দিন ধরে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে উত্তরের জেলা লালমনিরহাটে। কখনও হালকা, কখনও মাঝারি আবার কখনো ভারি বৃষ্টি। এতে জনসাধারণের মাঝে যেমন স্বস্তি ফিরে এসেছে। তেমনি খেটে খাওয়া ছিন্নমূল মানুষ কাজে যেতে না পারায় পড়েছেন চরম বিপাকে। গত ২৪ ঘণ্টায় শুধু রংপুরে ১৩০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ভারি বর্ষণের কারণে নদ-নদীগুলোতে পানি বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি সমানতালে বৃদ্ধি পাচ্ছে। চর গড্ডিমারী এলাকার হোসেন আলী বলেন, পানি বৃদ্ধিতে আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ছি। কিছু এলাকায় পানি প্রবেশ করে রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে।

পাউবো ডালিয়া শাখার উপপ্রকৌশলী মোহাম্মদ রাশেদীন বলেন, তিস্তার পানি বিপৎসীমার নিচে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তা ব্যারেজের ৪৪টি গেট খুলে দেওয়া হয়েছে। অব্যাহত বৃষ্টিপাতের কারণে তিস্তা নদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে। হাতীবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) জিয়াউল হক জিয়া বলেন, দুই দিন ধরে টানা বর্ষণের তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ওইসব ইউনিয়নের কিছু কিছু এলাকার রাস্তাঘাটে পানি উঠে চলাচলে দুর্ভোগে পড়েছে মানুষ। এদিকে তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হাক্কানি বলেন, অসময়ের বন্যা ও ভাঙনে প্রতি বছর এক লাখ কোটি টাকার সম্পদ তিস্তার গর্ভে চলে যায়। এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য নদী খনন, সংরক্ষণ ও তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন করা ছাড়া বিকল্প নেই।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, উজানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও সিকিমে হঠাৎ ভারী বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলেও ভারী বৃষ্টি চলছে। এতে উত্তরাঞ্চলের প্রধান নদী তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার ও আত্রাইয়ের পানি দ্রুত বাড়তে শুরু করেছে। তবে এখনো এসব নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে রয়েছে। তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার কাছাকাছি বা অতিক্রমও করে যেতে পারে। এ ব্যাপারে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান বলেন, শনিবার থেকে তিস্তা অববাহিকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে। আগামী চার-পাঁচ দিন পর গঙ্গা অববাহিকায় পানি বাড়তে পারে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ডালিয়া অঞ্চলের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, লালমনিরহাটের দোয়ানীতে অবস্থিত তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে বুধবার তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ১০৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বৃহস্পতিবার কিছুটা বেড়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল বিপৎসীমার ৬৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে। গত শুক্রবার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৩২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।

পাউবো ডালিয়া অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্বে রয়েছেন নীলফামারী অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আতিকুর রহমান। তিনি বলেন, তিস্তা নদীর পানি কয়েক দিনের তুলনায় কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১৩৯ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার তেঁতুলিয়ায় দেশের সর্বোচ্চ ২২৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। রংপুর বিভাগের বেশির ভাগ জেলায় এদিন ১০০ থেকে ১৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। দেশের মধ্যাঞ্চলের এলাকা রাজধানীসহ ঢাকা বিভাগেও ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হয়েছে। রাজধানীতে বেলা তিনটা পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে ৭০ মিলিমিটার। বৃষ্টির পাশাপাশি দেশের বেশির ভাগ এলাকার বাতাসের আর্দ্রতা অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। ফলে একদিকে বৃষ্টি ঝরছে, অন্যদিকে ভ্যাপসা গরমের অনুভূতি থাকছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ কাজী জেবুন্নেছা বলেন, বর্ষার এখন শেষ সময়। এ সময়ে সাধারণত বৃষ্টি বেড়ে যায়। আগামী মাসের শুরু থেকে আবারও বৃষ্টি চলতে পারে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত : পদ্মা ও মহানন্দা নদীর পানি বেড়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর ও শিবগঞ্জ উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় দুই হাজার হেক্টর জমির ফসল। পানিবন্দী হয়েছে প্রায় ৮৫০ পরিবার।

শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আবতাবুজ্জামান-আল-ইমরান বলেন, পদ্মা নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় পাকা ও দুর্লভপুর ইউনিয়নের প্রায় ৮০০ পরিবার ও মনাকষা ইউনিয়নের কিছু পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। পানিবন্দী এসব মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

গজলডোবা বাঁধ খোলার কারণ : তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। এই নদী হিমালয় থেকে উৎপন্ন হয়ে ভারতের সিকিম, দার্জিলিং ও জলপাইগুঁড়ির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এই নদীর বাংলাদেশ ও ভারত, উভয়ের অংশেই ব্যারেজ বা বাঁধ আছে। বাংলাদেশ অংশের তিস্তা নদীর বাঁধ রংপুর বিভাগের নীলফামারী জেলায়; নাম তিস্তা ব্যারেজ। ভারতে তিস্তা নদীর ওপর একাধিক বাঁধ আছে। তার মাঝে একটি হল জলপাইগুঁড়ির গজলডোবা বাঁধ। গজলডোবা’র তিস্তা বাঁধ নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গত শুক্রবার ভারতীয় সময় রাত আটটায় প্রায় ছয় হাজার ও তারপরে রাত সাড়ে ১২টায় আরও একবার চার হাজার ৭০০ কিউমেকেরও বেশি পানি ছাড়া হয়েছে। এরপরে আর নতুন করে পানি ছাড়ার কোন খবর পাওয়া যায়নি। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ্য, তিস্তা নদীর বাঁধের কিছু কিছু গেট বা দ্বার বছরের একটা বড় সময় জুড়ে খোলাই থাকে। তবে যখন কোন কারণে পানির পরিমাণ বাঁধের ধারণক্ষমতাকে ছাড়িয়ে যায়, তখন সেই বাড়তি পানি ছেড়ে দেওয়ার জন্য বাঁধের আরও গেট একযোগে খুলে দেওয়া হয়।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সরদার উদয় রায়হান গতকাল জানান, ২৪ ঘণ্টা তিস্তার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। তাই তিস্তা অববাহিকায় সাধারণ বন্যা দেখা দিতে পারে। তবে খুব ভয়াবহ কিছু হবে না। তবে নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কিন্তু সেটা মারাত্মক কিছু না। তিস্তা নদীর অববাহিকা, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, রংপুর, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট; এই পাঁচ জেলার নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকি আছে।

ভোরের আকাশ/ সু

মন্তব্য

Beta version