- বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়োগ-পদোন্নতি
- বদলি বাণিজ্য ও কেনাকাটার অনিয়ম
- অন্যের নামে ঋণ ইস্যু করে অর্থ পকেটস্থ
- শাখার পিয়নের নামে প্রবাসী ঋণ
- ফেরত আসছে না ঋণের অর্থ
দুর্নীতিগ্রস্ত সাত কর্মকর্তার হাতে জিম্মি রাষ্ট্রমালিকানাধীন প্রবাসীদের জন্য বিশেষায়িত ব্যাংক প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক। ব্যাংকে ‘স্বাধীনতা ব্যাংকার্স পরিষদ’ নামধারী একটি সংগঠন আছে তাদের। এই সংগঠনটি বিধিবহির্ভূতভাবে পদোন্নতি, ব্যাংক থেকে বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ, বদলি বাণিজ্য ও কেনাকাটার অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। পাশাপাশি এদের প্রায় সবাই অবৈধভাবে নিয়োগ পেয়েছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ একটি প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। অভিযুক্ত কর্মকর্তারা হলেন কামাল হোসেন, আসমা হক, ফরহাদ হোসেন, হাসনা হেনা, মো. সাইফুল ইসলাম, মাসুদুর রহমান ও সৈয়দ ইমরান।
ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষ্ঠাকালে ব্যাংকটির দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অস্থায়ী ও দৈনিকভিত্তিতে কয়েকজন ইন্টার্ন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয় প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের নিজস্ব সার্ভিস রুল তৈরি করতে। সার্ভিস রুল তৈরি না হওয়া পর্যন্ত কর্মসংস্থান ব্যাংকের সার্ভিস রুল অনুসরণ করতে বলা হয়। কিন্তু ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ওই নির্দেশনা মানেনি, নিয়োগ দিয়েছে পছন্দের ব্যক্তিদের। সরকারি চাকরিবিধির চেয়ে বেশি বয়স হওয়া সত্ত্বেও এবং শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত পূরণ না করেও অনেকে নিয়োগ পান। এসব কর্মকর্তার সম্মিলিত চক্রই এখন ব্যাংকের কলকাঠি নাড়ছে। অনিয়মের মাধ্যমে চাকরি পাওয়া ওই কর্মকর্তাদের অনেকে এখন আর্থিক অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছেন।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, একজন শাখা ব্যবস্থাপক, যিনি ঋণ ইস্যু করে নিজেই অর্থ তুলে নিয়েছেন। এছাড়া ওই শাখার পিয়নের নামে ইস্যু করেছেন প্রবাসী কর্মীর ঋণ। এভাবে নামে-বেনামে ঋণ তৈরি করায় তা ফেরত আসছে না। খেলাপি ঋণের উচ্চহারের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
জানা গেছে, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের প্রথম পর্যায়ে সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া একজন হচ্ছেন হাসনা হেনা পারভীন, যার জন্ম-তারিখ ১৯৭৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর। ২০১১ সালের ১৩ এপ্রিল তিনি ওই ব্যাংকে যোগ দেন। শিক্ষাগত জীবনে চারটিতেই দ্বিতীয় শ্রেণি। নিয়োগের বয়সসীমা সর্বোচ্চ ৩০ বছর হলেও তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ৩৭ বছর বয়সে। পারভীনের সঙ্গে আরও যেসব কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদের বেশির ভাগ কর্মীর বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা বা চাকরি লাভের শর্ত মানা হয়নি।
সূত্র জানায়, এসব কর্মকর্তাকে প্রথম পর্যায়ে দৈনিক হাজিরার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তখনো প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক আইন পাস হয়নি। ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠাকালে তাদের অস্থায়ীভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু স্থায়ী নিয়োগ দেওয়ার সময়ে তাদের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ব্যাংকের অডিটের সময়ে এটিসহ কয়েকটি বিষয় বেরিয়ে আসে। এর মধ্যে ব্যাংকটির বরিশাল শাখায় সৈয়দ মেহেদী হাসানকে কখনো দৈনিক এবং কখনো অফিসার ও এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে বেতন-ভাতা দেওয়া হয়েছে। আবার এক মাসের ব্যবধানে তাকে সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে বেতন দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে সাতজনের বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে। তারা পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি ব্যতীত, জেলা কোটা, মেধা কোটা ও অন্যান্য কোটা পরিপালন ছাড়াই প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকে নিয়োগ পেয়েছেন। এরমধ্যে কামাল হোসেন চাকরির বয়স না থাকা ও কম্পিউটার অপারেটর হয়েও ব্যাংকটিতে প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। তিনি ২০১১ সালে সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ। তিনি বছরের পর বছর ব্যাংকের ক্রয় বিভাগে কর্মরত আছেন। ক্রয় বিভাগের সকল অবৈধ কাজের সঙ্গে জড়িত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এবছর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাকে শুদ্ধাচার পুরস্কারে ভূষিত করেছে। এতে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাদের পরীক্ষণকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। স্বাধীনতা ব্যাংকার্স পরিষদের কমিটিতে তিনি শেখ কামাল পাশা নামে পরিচিত। কমিটিতে তিনি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে রয়েছেন। তার নাম ঠিক আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন নাম ঠিক আছে। কিন্তু তিনি কমিটিতে নেই বলে অস্বীকার করেন।
ওই গ্রুপের আরেক সদস্য আসমা হক। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাতি বৌ হিসেবে পরিচয় দিতেন। তিনি অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত এবং এজিএম হিসেবে সদ্য পদোন্নতিপ্রাপ্ত হয়েছেন, যা গত জুন মাসের আফিস আদেশে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি ২০১১ সালে সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। বিভিন্ন অপকর্ম থেকে বাঁচাতে প্রধান কার্যালয় থেকে গত ৮ আগস্ট কেরানীগঞ্জ শাখায় শাখা ব্যবস্থাপক হিসেবে বদলি করা হয় তাকে।
স্বাধীনতা ব্যাংকার্স পরিষদের সভাপতি ফরহাদ হোসেন। তিনিও ওই সাতজনের একজন। বাড়ি ফরিদপুর। ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগসাজশ করে অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়ার পরও তিনি ব্যাংকটিতে সদ্য পদোন্নতিপ্রাপ্ত এজিএম। স্বাধীনতা ব্যাংকার্স পরিষদের সদস্য হাসনা হেনা। সদ্য পদোন্নতিপ্রাপ্ত এজিএম। ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগসাজশ করে অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়ার পরও দীর্ঘদিন ধরে প্রধান শাখার শাখা ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। আরেক সদস্য স্বাধীনতা ব্যাংকার্স পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক মো. সাইফুল ইসলাম। তিনি প্রিন্সিপাল অফিসার। বাড়ি ফরিদপুর। তিনি প্রায় এক যুগ ধরে প্রধান কার্যালয়ের মানবসম্পদ বিভাগে কর্মরত ছিলেন। সম্প্রতি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাকে বাঁচানোর জন্য ব্যাংকের কাকরাইল শাখায় বদলি করেছে। স্বাধীনতা ব্যাংকার্স পরিষদের দপ্তর সম্পাদক সৈয়দ ইমরান। তিনিও সদ্য পদোন্নতিপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল অফিসার। বাড়ি ফরিদপুর। ব্যাংকটিতে যোগদানের পর থেকেই ব্যবস্থাপনা পরিচালকের একান্ত সচিব হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মূলত তার মাধ্যমেই স্বাধীনতা ব্যাংকার্স পরিষদ ব্যাংকের প্রধান কর্মকর্তার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে সকল ধরনের অনৈতিক সুবিধা আদায় করতেন। ব্যাংকে সকল অবৈধ কর্মকাণ্ডের মূলহোতা হিসেবে সুপরিচিত। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাকে বাঁচানোর জন্য সম্প্রতি প্রধান শাখার দ্বিতীয় কর্মকর্তা হিসেবে বদলি করা হয়েছে।
স্বাধীনতা ব্যাংকার্স পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক মাসুদুর রহমান। ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তার ছিল বিশেষ সখ্য। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা জানান, স্বাধীনতা ব্যাংকার্স পরিষদ সমর্থিত এই গ্রুপটি বিধি-বহির্ভূতভাবে পদোন্নতি নিয়েছে। এমনকি এক বছরে দুবার পদোন্নতি ও ইনক্রিমেন্ট নিয়েছে। ব্যাংক থেকে বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ, বদলি বাণিজ্য, গ্রুপিং তৈরি করা, পছন্দের প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যাংকের কেনাকাটা করার সঙ্গে জড়িত ছিল।
অভিযোগ রয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১৮০ কোটি টাকার কেনাকাটা হয়েছে। ওই ক্রয়ে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে বলে একটি নিরপেক্ষ অডিট ফার্ম দিয়ে নিরীক্ষার দাবি তোলা হয়েছে। অভিযোগে আরও বলা হয়, ব্যাংকের বিভিন্ন পদে ১১৮ জন অবৈধ নিয়োগের বিষয়ে বাণিজ্যিক অডিটের আপত্তির বিষয়ে ব্যাংক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বরং বর্তমান ম্যানেজমেন্ট বিভিন্নভাবে তাদের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের আদেশ মোতাবেক, ব্যাংকের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য লোকবল নিয়োগের ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান ব্যাংকের চাকরি প্রবিধানমালা অনুসরণের নির্দেশনা প্রদান করা হলেও উল্লিখিত ১১৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্র তা করা হয়নি। এই অবৈধভাবে নিয়োগকৃতরাই এখন ব্যাংকের হর্তাকর্তা। আরও অভিযোগ আছে প্রবাস গমনেচ্ছুদের নামে ঋণ ইস্যু করে নিজেই সেই ঋণের অর্থ তুলে নিয়েছেন ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক। ব্যাংকের পিয়নের নামেও ইস্যু করা হয়েছে বিদেশগামীদের ঋণ। নিয়োগ ও বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মজিবর রহমান ব্যস্ততার কথা জানিয়ে কথা বলতে চাননি।
উল্লেখ্য, বিদেশগামী ও প্রবাসীদের সুবিধার জন্য ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় ব্যাংকটি। বিশেষ উদ্দেশ্য পূরণে গঠিত এ ব্যাংকটি সামপ্রতিক সময়ে তফসিলি ব্যাংক হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানার এ ব্যাংকটি তফসিলভুক্ত হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকেও অভিযোগ জমা হয়েছে ব্যাংকটির কর্মকর্তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া ও নিয়োগপ্রাপ্তদের যোগ্যতা নিয়ে।
ভোরের আকাশ/ সু
মন্তব্য