- নাসারুল্লাহ হত্যার পর হিজবুল্লাহর হামলা জোরদার
- লেবাননে স্থল অভিযানে মরিয়া ইসরায়েল
- গোপন আস্তায় আয়াতুল্লাহ খামেনি
- আক্রমণ চালাচ্ছে হুতি
- গাঁজায়ও চলছে হামলা
লেবাননে ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ নেতা সৈয়দ হাসান নাসরাল্লাহর হত্যাকাণ্ডের পর পুরো মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। নেতা হত্যার প্রতিশোধ নিতে ইসরায়েলে হামলা জোরদার করেছে হিজবুল্লাহ। অপরদিকে চিরশত্রু হিজবুল্লাহকে বিনাশ করতে স্থল অভিযানে মরিয়া হয়ে ওঠেছে ইসরায়েল। যেকোনো সময় তারা এই হামলা চালাতে পারে। এরই মধ্যে ইসরায়েল সীমান্তে ব্যাপক সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছে। গতকাল রোববার আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম এই খবর দিয়েছে। এদিকে হিজবুল্লাহকে সমর্থন জানাতে ইয়েমেন থেকে ইরায়েলে রকেট হামলা চালিয়ে যাচ্ছে হুতি বিদ্রোহীরা। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আল খামেনি মুসলিম বিশ^কে ইসরায়েলে হামলার আহ্বান জানিয়েছেন। এরপরই তার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। একই সঙ্গে তাকে গোপন আস্তানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লেবাননের রাজধানী বৈরুত এবং উপশহর এলাকায় গতকাল রোববারও মুহুর্মুহু বোমা হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। এ ঘটনায় দেশটির লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে। তবে হতাহতের সংখ্যা জানানো হয়নি। তবে ইসরায়েল বলছে, তারা অন্তত হিজবুল্লাহর ২০ নেতাকে হত্যা করেছে। এদিকে হিজবুল্লাহ বলছে, তারা ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে দুটি স্থানকে লক্ষ্য করে ব্যাপক হামলা চালিয়েছে। তারা সাফাদ এবং এর পাশের এলাকায় ব্যাপক রকেট হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। লেবাননের শহর, গ্রাম ও বসতিতে হামলার প্রতিবাদে তারা এই হামলা চালিয়ে যাচ্ছেন। ইসরায়েলি হামলায় তাদের ১৪ চিকিৎসাকর্মী নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন তারা।
হিজবুল্লাহ অনুপ্রবেশ : ইসরায়েলি অনুপ্রবেশ ঠেকানোর বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে হিজবুল্লাহ। এই অনুপ্রবেশই চিরশত্রু ইসরায়েলকে তাদের অস্ত্র গুদাম ধ্বংস করে দিতে, যোগাযোগ যন্ত্রপাতিতে বিস্ফোরণ ঘটাতে ও অভিজ্ঞ নেতাদের হত্যা করার সুযোগ করে দিয়েছে। অথচ বছরের পর বছর ধরে এসব তথ্য অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে গোপন রাখা হয়েছিল। গত শুক্রবার হিজবুল্লাহর কমান্ড সদরদপ্তরে ব্যাপক বোমা হামলা চালিয়ে নাসরাল্লাহকে হত্যা করে ইসরায়েল। তারা এর মাত্র এক সপ্তাহ আগে হিজবুল্লাহর সদস্যদের ব্যবহার করা শত শত পেজার ও ওয়াকিটকিতে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে গোষ্ঠীটির অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপর্যয় ঘটানোর পাশাপাশি বহু জনকে হত্যা ও বহু যোদ্ধাকে আহত করে সাময়িকভাবে অক্ষম করে দিতে সক্ষম হয়। এই অনুপ্রবেশ সক্ষমতার ওপর ভর করেই ইসরায়েল হিজবুল্লাহর নেতৃত্বদানকারী পরিষদের অর্ধেক সদস্যকে হত্যা ও তাদের শীর্ষ সামরিক কমান্ডকে ধ্বংস করে দেয়।
নাসরাল্লাহর হত্যাকাণ্ডের আগের দিনগুলোতে ও এর পরের কয়েক ঘণ্টায় রয়টার্স লেবানন, ইসরায়েল, ইরান ও সিরিয়ার বহু কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে। তারা লেবাননের শক্তিশালী আধাসামরিক শিয়া গোষ্ঠীটির সাপ্লাই চেইন ও কমান্ড গঠনসহ অন্য ক্ষেত্রগুলোতে যে ক্ষতি ইসরায়েল করেছে তার বিশদ বিবরণ দিয়েছেন। এই স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলার সময় সবাই তাদের নাম প্রকাশ না করার শর্ত দিয়েছেন।
ইসরায়েলের চিন্তাভাবনার সঙ্গে পরিচিত এক কর্মকর্তা নাসরাল্লাহর ওপর আঘাত হানার ২৪ ঘণ্টারও কম সময় আগে রয়টার্সকে জানান, হিজবুল্লাহর বিষয়ে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করতে ইসরায়েল ২০ বছর ব্যয় করেছে। তাই যখনই তারা চাইবে গোষ্ঠীটির সদরদপ্তরসহ নাসরাল্লাহর ওপর আঘাত হানতে পারবে। গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের এই ব্যবস্থাকে ‘ব্রিলিয়ান্ট’ হিসেবে অভিহিত করেন তিনি; কিন্তু আর বিস্তারিত কিছু জানাননি। দুই ইসরায়েলি কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানান, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তার ঘনিষ্ঠ মন্ত্রীদের চক্র বুধবার নাসরাল্লাহর ওপর হামলার অনুমোদন দেন। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার জন্য নেতানিয়াহু যখন নিউইয়র্কে তখন হামলাটি চালানো হয়।
২০০৬ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে হিজবুল্লাহর মাসব্যাপী যুদ্ধের পর থেকে নাসরাল্লাহ আর জনসম্মুখে আসেননি। অনেকদিন ধরেই তিনি সতর্ক জীবনযাপন করছিলেন, তার গতিবিধি সীমিত ছিল এবং যেসব লোকজনের সঙ্গে তার দেখা হত তাদের সংখ্যা খুব কম ছিল বলে নাসরাল্লাহর নিরাপত্তা ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত এক কর্মকর্তার ভাষ্য। তিনি বলেন, নাসরাল্লাহর হত্যাকাণ্ড থেকে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে এই অল্প লোকজনের মধ্যেও ইসরায়েলি চরদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
সম্প্রতি নিহত হিজবুল্লাহর এক শীর্ষ কমান্ডারের জানাজায় নাসরাল্লাহর অংশ না নেওয়া ও এরপর আগে থেকে রেকর্ড করা তার ভাষণ প্রচারের কথা উল্লেখ করে হিজবুল্লাহর এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানান, ১৭ সেপ্টেম্বরের পেজার বিস্ফোরণের পর থেকে নাসরাল্লাহ আরও সতর্ক হয়ে গিয়েছিলেন, ইসরায়েল তাকে হত্যার চেষ্টা করতে পারে এমন আশঙ্কা করছিলেন তিনি। রয়টার্স জানিয়েছে, এই বিষয়ে মন্তব্যের অনুরোধে হিজবুল্লাহর গণমাধ্যম দপ্তর সাড়া দেয়নি।
নাসারুল্লাহ হত্যাকে ন্যায় বলছেন বাইডেন : শনিবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নাসারুল্লাহর হত্যাকাণ্ডকে ‘ন্যায়বিচারের একটি পরিমাপ’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, নাসারুল্লাহর নির্দেশে বহু মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। ইরান সমর্থিত লেবাননি গোষ্ঠীটির বিরুদ্ধে ইসরায়েলের নিজেদের রক্ষা করার অধিকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পুরোপুরি সমর্থন আছে বলে জানিয়েছেন তিনি। ইসরায়েল জানিয়েছে, নাসারুাল্লাহর ওপর আঘাত হানতে তারা দক্ষিণ বৈরুতের একটি আবাসিক ভবনের নিচে ভূগর্ভস্থ সদরদপ্তরে বোমা ফেলেছিল।
সুইডিশ প্রতিরক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিজবুল্লাহ বিশেষজ্ঞ মান্নেস রান্সস্তূর্প বলেন, হিজবুল্লাহর জন্য এটি একটি বিশাল ধাক্কা ও বিরাট গোয়েন্দা ব্যর্থতা। ইসরায়েলিরা জানত তিনি বৈঠক করছেন। তিনি অন্যান্য নেতাদের নিয়ে বৈঠক করছেন। আর সেই সময়ই তারা তার ওপর হামলা চালায়।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, নাসরাল্লাহসহ হিজবুল্লাহর নয়জন সর্বজ্যেষ্ঠ কমান্ডারের মধ্যে আটজনকে তারা হত্যা করেছে। এদের অধিকাংশকে গত সপ্তাহে হত্যা করা হয়েছে। এই কমান্ডাররা হিজবুল্লাহর রকেট ডিভিশন থেকে অভিজাত রাদওয়ান বাহিনীসহ বিভিন্ন ইউনিটকে পরিচালনা করতেন। ১৭ ও ১৮ সেপ্টেম্বর পেজার ও ওয়াকিটকি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হিজবুল্লাহর প্রায় ১৫০০ যোদ্ধাকে আগেই পুঙ্গ করে দেওয়া হয়েছিল। শনিবার ইসরায়েলের সামরিক মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল নাদাভ শোশানি সংবাদ ব্রিফিংয়ে জানান, নাসারুল্লাহ ও অন্যান্য নেতা যে বৈঠক করছেন এর ‘সত্যিকার সময়’ নিয়ে ইসরায়েলের পরিষ্কার ধারণা ছিল। হিজবুল্লাহর নেতারা ইসরায়েলে হামলার পরিকল্পনা করতে বৈঠক করছিলেন। কিন্তু কীভাবে তারা এসব তথ্য জানতে পেরেছেন তা নিয়ে কিছু বলেননি শোশানি।
নাসারুল্লাহ মরদেহ উদ্ধার : লেবাননের হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে বলে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। গতকাল রোববার রাজধানী বৈরুতের শহরতলিতে বিমান হামলার স্থান থেকে মরদেহ উদ্ধার করা হয়। হাসপাতাল সূত্র এবং নিরাপত্তা সূত্রের বরাতে রয়টার্স জানিয়েছে, নাসরুল্লাহর শরীরে সরাসরি ক্ষত ছিল না। গত শনিবার হাসান নাসারুল্লাহর নিহতের তথ্য নিশ্চিত করে হিজবুল্লাহ। এর আগে এক এক্স বার্তায় ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে লেবাননভিত্তিক শিয়া ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল ও সশস্ত্র সংগঠনের নেতা হাসান নাসারুল্লাহ নিহত হয়েছেন বলে দাবি করা হয়েছিল।
রাজধানী বৈরুতসহ লেবাননের বিভিন্ন জায়গায় শুক্রবার রাতভর বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। জানা যায়, ইরান-সমর্থিত হিজবুল্লাহর কমান্ড সেন্টারে সংগঠনের নেতা হাসান নাসরুল্লাহ ও অন্য নেতাদের লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে। এরপরই হাসান নাসরুল্লাহ নিহত হওয়ার খবর জানানো হয়। তবে হামলায় হাসান নাসরুল্লাহর ভাগ্যে কী ঘটেছে, তাৎক্ষণিকভাবে হিজবুল্লাহ আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি, কোনো বিবৃতি দেয়নি। হাসান নাসরুল্লাহর (৬৪) জন্ম ১৯৬০ সালে। বেড়ে উঠেছেন বৈরুতের পূর্বাঞ্চলীয় উপকণ্ঠের বুর্জ হামুদ এলাকায়। বাবা আবদুল করিম ছিলেন একজন সাধারণ সবজি বিক্রেতা। তার ৯ সন্তানের মধ্যে নাসরুল্লাহ ছিলেন সবার বড়। ১৯৭৫ সালে লেবানন গৃহযুদ্ধের মুখে পড়লে হাসান নাসরুল্লাহ শিয়া মুভমেন্ট ‘আমাল’-এ যোগ দেন। পরে ১৯৮২ সালে আরও কয়েকজনের সঙ্গে দলটি থেকে বেরিয়ে যান তিনি। ১৯৮৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠার কথা জানায় হিজবুল্লাহ। তাতে যোগ দেন হাসান নাসরুল্লাহ। হিজবুল্লাহ শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে চিহ্নিত করে ‘ইসলামের প্রধান দুই শত্রু’ হিসেবে। সেই সঙ্গে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলকে ধ্বংস করার ডাক দেয় তারা। দেশটিকে আখ্যায়িত করে মুসলিমদের ভূমি দখলকারী হিসেবে।
১৯৯২ সালে মাত্র ৩২ বছর বয়সে হিজবুল্লাহর প্রধান হন নাসরুল্লাহ। এর আগে ইসরায়েলের এক হেলিকপ্টার হামলায় নিহত হন তার পূর্বসূরি আব্বাস আল-মুসাবি। হিজবুল্লাহপ্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর মুসাবি হত্যার প্রতিশোধ নেওয়া ছিল হাসান নাসরুল্লাহর প্রথম কাজ। সে অনুযায়ী ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে রকেট হামলার নির্দেশ দেন তিনি। নাসরুল্লাহ লেবাননের দক্ষিণে ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গেও তার যোদ্ধাদের লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেন। একপর্যায়ে ২০০০ সালে সেখান থেকে পিছু হটে দেশে ফিরে যান ইসরায়েলি সেনারা। তবে নাসরুল্লাহর ব্যক্তিগত ক্ষতিও কম হয়নি। ইসরায়েলি সেনাদের সঙ্গে লড়াইয়ে প্রাণ দিতে হয় তার বড় ছেলে হাদিকে। নাসরুল্লাহর নেতৃত্বে হিজবুল্লাহ ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের যোদ্ধাদের পাশাপাশি ইরাক ও ইয়েমেনের মিলিশিয়াদের প্রশিক্ষণগত সহায়তা দিয়েছে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবহারের লক্ষ্যে ইরানের কাছ থেকে সংগ্রহ করা ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেটের এক সমৃদ্ধ ভান্ডার রয়েছে হিজবুল্লাহর।
দখলকৃত লেবাননি ভূখণ্ড থেকে ইসরায়েলি সেনাদের তাড়াতে প্রথমে একটি মিলিশিয়া দল হিসেবে গড়ে উঠেছিল হিজবুল্লাহ। পরে এ দলকেই লেবাননের সেনাবাহিনীর চেয়ে শক্তিশালী এক বাহিনীতে রূপ দেন নাসরুল্লাহ। সংগঠনটি এখন দেশের রাজনীতিতেও উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তারকারী একটি শক্তি। সর্বশেষ হিজবুল্লাহ-ইসরায়েল উত্তেজনা বেড়ে যায় গত বছরের ৮ অক্টোবর থেকে। ওই দিন ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে হামাসের রকেট হামলার জের ধরে গাজায় নজিরবিহীন তাণ্ডব শুরু করে দেশটি। ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি প্রদর্শনের অংশ হিসেবে মাঝেমধ্যেই ইসরায়েলের অভ্যন্তর ও দখলকৃত গোলান মালভূমি এলাকায় রকেট হামলা চালাচ্ছে হিজবুল্লাহ।
হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহর পর এবার সংগঠনটির আরেক নেতাকে হত্যার দাবি করেছে ইসরায়েল। ওই নেতার নাম নাবিল কাওউক। শনিবার এক বিবৃতিতে এ দাবি করে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী। ইসরায়েলি বাহিনীর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নাবিল কাওউক হিজবুল্লাহর নিরাপত্তা কাউন্সিলের প্রধান ছিলেন। এ ছাড়া সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন তিনি। গতকাল যুদ্ধবিমানের মাধ্যমে হামলা চালিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, হিজবুল্লাহর শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের ঘনিষ্ঠ ছিলেন নাবিল কাওউক। ইসরায়েল ও দেশটির নাগরিকদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী পরিকল্পনা এগিয়ে নেওয়ার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন তিনি। তবে নাবিলের হত্যা নিয়ে ইসরায়েলের দাবির বিষয়ে এখনো মুখ খোলেনি হিজবুল্লাহ। এর আগে গত শুক্রবার রাতভর লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক হামলা চালায় ইসরায়েল। এতে নিহত হন হাসান নাসরুল্লাহ। ইসরায়েলের হাতজেরিম বিমান ঘাঁটির কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমিচাই লেভিন সাংবাদিকদের বলেছেন, লক্ষ্যস্থলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ডজন ডজন বোমা ছোড়া হয়।
খামেনি নিরাপদ স্থানে : ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে দেশের ভেতরে একটি নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যা করা হয়েছে এমন খবর জানার পরই এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তেহরানের সর্বশেষ খবর সম্পর্কে অবগত দুজন আঞ্চলিক কর্মকর্তা রয়টার্সকে এ তথ্য জানিয়েছেন। সূত্রগুলো জানিয়েছে, ইসরায়েলের হাতে হিজবুল্লাহর প্রধান নিহত হয়েছেন- এমন খবর জানার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণ করতে ইরান হিজবুল্লাহ ও ওই অঞ্চলটিতে সক্রিয় অন্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর (ইরানের সহায়তাপুষ্ট) সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখছে। গত শুক্রবার দক্ষিণ বৈরুতে এক বিমান হামলায় হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যা করার দাবি করে ইসরায়েল। শনিবার এক এক্স বার্তায় ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে এ দাবি করা হয়। এতে বলা হয়, হাসান নাসরুল্লাহ আর বিশ্বে সন্ত্রাসবাদ পরিচালনা করতে পারবেন না। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ আলী খামেনি বলেছেন, হেজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসারুল্লাহর মৃত্যু ‘প্রতিশোধহীন’ যাবে না। একই সাথে তিনি পাঁচ দিনের শোক ঘোষণা করেছেন। ইরান একই সাথে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সভা জরুরি ভিত্তিতে ডাকার আহবান জানিয়েছে। অন্যদিকে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নাসারুল্লাহর মৃত্যুকে ‘ঐতিহাসিক মোড় ঘুরানো ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই হত্যাকাণ্ডকে ‘ন্যায়বিচারমূলক পদক্ষেপ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে ইসরায়েল ও হেজবুল্লাহর মধ্যে আন্ত:সীমান্ত লড়াই অব্যাহত আছে। হেজবুল্লাহর দীর্ঘকালের নেতা হাসান নাসারুল্লাহর ইসরায়েলের হামলায় নিহত হবার ঘটনা মূলত লেবাননের এই সশস্ত্র গোষ্ঠীটির সাথে ইসরায়েলের যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে একটি বড় অগ্রগতি।এটা সম্ভবত ওই অঞ্চলকে আরও বিস্তৃত ও বিপজ্জনক সংঘাতের আরেক ধাপ কাছে নিয়ে গেছে, যা যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান উভয়কেই টেনে আনতে পারে।
হিজবুল্লাহ এখন কী করবে : একের পর এক আঘাতে জর্জরিত হেজবুল্লাহ। এক ডজনেরও বেশী শীর্ষ পর্যায়ের কমান্ডারের হত্যাকাণ্ডে এর কমান্ড কাঠামো বিপর্যস্ত। পেজার ও ওয়াকিটকি বিস্ফোরণের অন্তর্ঘাতমূলক ঘটনায় এর যোগাযোগ কাঠামো এবং বিমান হামলায় এর অস্ত্র ধ্বংস হয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মধ্যপ্রাচ্য নিরাপত্তা বিশ্লেষক মোহাম্মেদ আল-বাশা বলেছেন, হাসান নাসারুল্লাহকে হারানোর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়বে, গোষ্ঠীটি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ার সম্ভাবনার পাশাপাশি স্বল্প মেয়াদে এর রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশলকে পরিবর্তন করবে। তবে ইসরায়েল বিরোধী এই সংগঠনটি হুট করে ক্ষান্ত দেবে এমন প্রত্যাশা কিংবা ইসরায়েলের চাওয়া অনুযায়ী শান্তির পথে আসবে তা সম্ভবত হবে না। হিজবুল্লাহ ইতোমধ্যেই লড়াই অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে। দলটির এখনো হাজার হাজার যোদ্ধা আছে। এদের অনেকেরই সিরিয়া যুদ্ধে অংশ নেয়ার অভিজ্ঞতা আছে এবং তারা প্রতিশোধ নেয়ার দাবি করেছে।
সংগঠনটির এখনো যথেষ্ট পরিমাণ ক্ষেপণাস্ত্র আছে, যার অনেকগুলোই দূরপাল্লার। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে হামলার মতো অস্ত্র আছে, যা তেল আবিব ও অন্য শহরগুলোতে পৌঁছাতে পারে। নিজেরা আরও ধ্বংসের লক্ষ্যে পরিণত হওয়া বা নিশ্চিহ্ন হওয়ার আগে সেগুলো ব্যবহারের জন্য গোষ্ঠীটির ভেতরে চাপ বাড়ছে। কিন্তু ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ভেদ করে তারা সেটি যদি করে এবং তাতে বেসামরিক নাগরিক হতাহত হলে ইসরায়েলের জবাব হতে পারে আরও ভয়াবহ। তাতে লেবাননের অবকাঠামো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে পারে এবং এমনকি সেটি বিস্তৃত হতে পারে ইরান পর্যন্ত।
ইরান কী করবে : সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড হিজবুল্লাহর মতো ইরানের জন্যও একটি বড় ধাক্কা। দেশটি ইতোমধ্যেই পাঁচ দিনের শোক ঘোষণা করেছে।
এছাড়া দেশটি তাদের নেতা আয়াতোল্লাহ আলী খামেনিকেও সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে গোপন জায়গায় সরিয়ে নিয়েছে। তেহরানের গেস্ট হাউজে ইসমাইল হানিয়ার অপমানজনক হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ ইরান এখনো নিতে পারেনি। পুরো মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ইরানের বেশ কিছু সশস্ত্র সহযোগী গোষ্ঠী আছে। যেটি তথাকথিত ‘প্রতিরোধের অক্ষ’। হিজবুল্লাহর মতো ইয়েমেনে এর আছে হুতি এবং ইরাক আর সিরিয়ায় আছে কয়েকটি গোষ্ঠী। ইরান এসব গোষ্ঠীকে ইসরায়েলে এবং ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানে হামলা করতে বলতে পারে। কিন্তু যেই পদক্ষেপই ইরান নিক না কেন সেটি হবে যুদ্ধের জন্য বন্দুকে চাপ দেয়ার মতো, যাতে তারা জয়ের খুব একটা আশা করতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রসহ ১২টি রাষ্ট্র একুশ দিনের যে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছে সে অনুযায়ী সামরিক অভিযান বন্ধ করার কোন লক্ষ্য পরিষ্কারভাবেই ইসরায়েলের নেই। তাদের সামরিক বাহিনী মনে করে হেজবুল্লাহ এখন ব্যাকফুটে। সুতরাং ক্ষেপণাস্ত্রের হুমকি পুরোপুরি না যাওয়া পর্যন্ত তারা আরও আক্রমণ চালাতে চায়।
হিজবুল্লাহর আত্মসমর্পণের সম্ভাবনা কম। এটা দেখা খুব একটা সহজ হবে না যে কীভাবে ইসরায়েল স্থল অভিযানে সৈন্য না পাঠিয়ে হেজবুল্লাহর আক্রমণের হুমকি দূর করে তাদের যুদ্ধের লক্ষ্য অর্জন করে। ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স অবশ্য সীমান্তের কাছে তাদের পদাতিক বাহিনীর প্রশিক্ষণের ফুটেজ প্রকাশ করেছে। তবে সবশেষ যুদ্ধের পর হেজবুল্লাহ আঠার বছর সময় ব্যয় করে পরবর্তী যুদ্ধের পর প্রশিক্ষণ নিয়েছে।
ভোরের আকাশ/ সু
মন্তব্য