-->
আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল

অস্থিরতার শেষ কোথায়

শফিকুল ইসলাম, গাজীপুর ও কামরুল হাসান, সাভার
অস্থিরতার শেষ কোথায়
  • আশুলিয়ায় সংঘর্ষে নিহত ১
  • গুলিবিদ্ধসহ আহত ৫০
  • গাজীপুরে সড়ক অবরোধ

শিল্পাঞ্চল গাজীপুর ও সাভারের আশুলিয়ায় চলছে চরম অস্থিরতা। বিভিন্ন দাবিতে প্রতিদিনই কোন না কোন কারাখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ করছেন। সেই অসন্তোষের আগুনে ঘি পড়েছে গতকাল সোমবার। আশুলিয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষের পোশাক শ্রমিকদের সংঘর্ষ হয়েছে। এতে একজন নিহত হয়েছেন। দুইজন গুলিবিদ্ধসহ অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছেন। এদিকে, গাজীপুর সদর উপজেলার ভবানীপুরে শ্রমিকরা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন। এতে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকরা।

নিহত ওই শ্রমিকের নাম কাউসার হোসেন খাঁন। তিনি টঙ্গাবাড়ি এলাকার ম্যাংগো টেক্স লিমিটেডের সুইং অপারেটর ছিলেন। কাউসারের মরদেহ সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রয়েছে। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক এনামুল হক মিয়া বলেন, একজন শ্রমিককে বেলা ১২টা ৫৫ মিনিটে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছে। তার পেটের বাম পাশে গুলি লেগেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ছাড়া গুলিবিদ্ধ আরও দুইজন চিকিৎসাধীন। তারা হলেন- টঙ্গাবাড়ি জিরাবো এলার ন্যাচারাল গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিক রাসেল মিয়া ও নয়ন। আহতদের মধ্যে দুইজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন- আশুলিয়ার ন্যাচারাল ডেনিমসের শ্রমিক হাবীব ও ন্যাচারাল ইন্ডিগো কারখানার শ্রমিক নাজমুল হাসান। বাকিদের পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।

প্রত্যক্ষদর্শী শ্রমিকরা জানান, সকালে মণ্ডল গ্রুপের শ্রমিকদের সঙ্গে মালিকপক্ষ, শ্রমিক প্রতিনিধি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বৈঠক চলছিল। সমঝোতা না হওয়ায় শ্রমিকরা কারখানার বাইরে অবস্থান নেন। পরে অন্যান্য কারখানার শ্রমিকরা সেখানে জড়ো হতে থাকেন। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও শ্রমিকরা মুখোমুখি অবস্থান নেয়। তখন উত্তেজিত ও বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা র‌্যাব ও পুলিশের কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে।

একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা লাঠিপেটা শুরু করলে অর্ধশত শ্রমিক আহত হয়। পরে শ্রমিকরা আরও উত্তেজিত হন। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গুলি চালায়। এ সময় দুইজন গুলিবিদ্ধ হয়। ন্যাচারাল ডেনিমসের শ্রমিক মো. সুমন মিয়া বলেন, সকালে আমাদের কারখানায় সবাই কাজ করছিলেন। কোনো ধরনের আন্দোলন হয়নি। তবে মণ্ডল গ্রুপের শ্রমিকরা কারখানার সামনে আন্দোলন শুরু করলে আমাদের শ্রমিকরা ‘সংহতি জানিয়ে’ সামনে যায়। সেখানে আরও কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা যোগ দেয়। এ সময় শ্রমিকদের লাঠিচার্জ শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এক পর্যায়ে গুলি ছুড়লে দুইজনের পায়ে গুলি লাগে। পরে আমি তাদের দুইজনকে হাসপাতালে নিয়ে আসি। এ ছাড়া আরও অনেক শ্রমিক আহত হয়েছেন। তারা বিভিন্ন হাসপাতাল চিকিৎসা নিচ্ছেন।

পিএমকে হাসপাতালের ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) নাজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের হাসপাতালে চারজন শ্রমিককে আহত অবস্থায় আনা হয়েছে। তাদের মধ্যে দুইজনের পায়ে গুলি লেগেছে। চিকিৎসা চলছে।

ন্যাচারাল ডেনিমস কারখানার মানবসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা (এইচআর অ্যাডমিন) সবুজ হাওলাদার বলেন, আমাদের কারখানায় কোনো সমস্যা ছিলো না। সকাল থেকেই শ্রমিকরা শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করছিলেন। হঠাৎ শ্রমিকদের কাছে গুজব আসে, পাশের মণ্ডল গার্মেন্টসের শ্রমিক মারা গেছে। এটা শুনেই সব শ্রমিক একসঙ্গে কারখানা থেকে বেরিয়ে মণ্ডল গার্মেন্টসের সামনে চলে যায়। পরে ওখানে কী ঘটেছে আমার জানা নেই।

পুলিশের গুলিতে কেউ মারা গেছেন কি-না জানতে চাইলে সাভার থানার ওসি জুয়েল বলেন, তাদের মৃত্যু গুলিতে না কিভাবে হয়েছে, সে বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই।

অন্যদিকে, গতকাল সকাল নয়টার দিকে আর অ্যান্ড জি বিডি লিমিটেড নামে ওই কারখানার শ্রমিকরা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করেন। ঘণ্টাখানেক তারা মহাসড়কে অবস্থান কালে উভয় পাশে আট থেকে দশ কিলোমিটার সড়কে যানজট সৃষ্টি হয়। এতে সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়েন যানবাহনের যাত্রী ও চালকেরা।

জানা গেছে, কয়েক দিন ধরে শ্রমিক আন্দোলনের কারণে গাজীপুরের চারটি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। সেগুলো গতকালও খোলার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। এই চারটিসহ জেলায় মোট নয়টি কারখানা বন্ধ আছে। এ ছাড়া জেলার অধিকাংশ কারখানাতেই আজ উৎপাদন স্বাভাবিক আছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

গাজীপুর শিল্প পুলিশের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারোয়ার জানান, সোমবার সকালে দিকে আর এন্ড জি বিডি কারখানার শ্রমিকরা বকেয়া বেতনসহ বিভিন্ন দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকেন। শ্রমিক মালিক পক্ষের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর তারা আন্দোলন স্থগিত করে। তিনি আরও বলেন, গাজীপুর জেলায় আজ (গতকাল) নয়টি কারখানা বন্ধ আছে। এর মধ্যে চারটি কারখানা শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া একটি কারখানা লে-অফ, একটি অস্থায়ী বন্ধ এবং তিনটি কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।

কারখানার শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সদর উপজেলার ভবানীপুর এলাকার আর অ্যান্ড জি বিডি লিমিটেড কারখানার শ্রমিকরা গতকাল দুপুরের পর হাজিরা বোনাস, নাইট বিল ও টিফিন বিল বৃদ্ধি, প্রশাসন বিভাগের ব্যবস্থাপকের অপসারণসহ ১২ দফা দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন। পরে শ্রমিকেরা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করেন। ওই ঘটনার পর শিল্প পুলিশ, থানা-পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা শ্রমিক ও কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেন। পরে বিকেল পাঁচটার পর শ্রমিকরা বাড়ি ফিরে যান। ওই ঘটনার পর কারখানা কর্তৃপক্ষ দুই দিনের (সোম ও মঙ্গলবার) জন্য কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে। অনেক শ্রমিক ওই ঘোষণা না জানায় গতকাল সকালে কারখানায় এসে ছুটির নোটিশ দেখে উত্তেজিত হয়ে যান এবং বিক্ষোভ শুরু করেন। পরে শ্রমিকরা কারখানার পাশে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে অবরোধ করেন। খবর পেয়ে শিল্প পুলিশ ও থানা-পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদের বুঝিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে দিলে সকাল ১০টার দিকে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়। তবে এর আগেই কয়েক কিলোমিটার যানজট সৃষ্টি হয়।

শিল্প পুলিশ জানায়, বন্ধ থাকা কারখানাগুলো ছাড়া অন্যান্য কারখানায় স্বাভাবিক উৎপাদন প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। শ্রমিকরা সকাল থেকেই কাজে যোগ দিয়েছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শিল্প পুলিশের পাশাপাশি সেনাসদস্যরাও প্রস্তুত আছেন।

জয়দেবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল হালিম বলেন, সকালে শ্রমিকরা বেশ কিছু সময় অবরোধ সৃষ্টি করেন। পরে শ্রমিকদের বুঝিয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ভোরের আকাশ/ সু

মন্তব্য

Beta version