হল ছেড়ে যেতে খারাপ লাগছে। দীর্ঘদিন হলে থেকেছি হল আমার বাড়ির মত হয়ে গিয়েছে। এই ঠিকানা ছাড়তে কষ্ট তো হচ্ছেই পাশাপাশি ভালোও লাগছে কারণ আমি একা না সিনিয়র সবাই চলে যাচ্ছে ফলে একটা নতুন সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে।
বুকে চাপা কষ্ট নিয়ে মুচকি হেঁসে কথা গুলো বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কবি জসীম উদ্দিন হলের ২০১৬-১৭ সেশনের শিক্ষার্থী জাবেদ কায়সার। তিনি আগামীকাল সকালে হল ছেড়ে আজিমপুরে সদ্য নেওয়া বাসায় উঠবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল গুলো আগে ছাত্রলীগ কর্তৃক পরিচালিত হতো। সিট দেওয়া থেকে শুরু করে মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের হলে রাখা, বহিরাগতদের টাকার বিনিময়ে হলে রাখা সহ নানা অভিযোগ ছিলো হল ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যূত্থানের পর হল প্রশাসনের মাধ্যমে মেধার ভিত্তিতে বৈধ সিট দেওয়ার সিস্টেম চালু করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। যার কারণে সকল মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদেরকেই হল ছাড়তে হচ্ছে। সদ্য পড়ালেখা শেষ করা শিক্ষার্থীদেরকেও কয়েকদিনের মধ্যেই হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের শ্রেণি কার্যক্রম শুরু হওয়ায় ইতিমধ্যেই হলে উঠছে তারা। ফলে সিনিয়র সদ্য মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদেরকে দ্রুতই হল ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে।
হলের শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন যাবৎ ছাত্রলীগের নির্যাতন ও একচ্ছত্র আধিপত্য এবং হল প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার সংস্কৃতির সাথে অভ্যস্থ। সাবেক শিক্ষার্থীদের অনেকেই আবার একটা সিটের জন্য দিনের পর দিন ছাত্রলীগের প্রোগ্রাম করেছে। অনেকেই ৩য় বর্ষে গিয়ে একটা বেডের অর্ধেকটা পেয়েছে। এভাবে দীর্ঘদিন কষ্ট সহ্যের পর সুখ আসতেই হল ছেড়ে দিতে হচ্ছে অনেক শিক্ষার্থীর। যাওয়ার সময় আবেগ আপ্লুত হয়ে বার বার হলের দিকে তাকাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। হলই তো তাদের দীর্ঘদিনের ঠিকানা।
তবে হলের এই সুন্দর সংস্কৃতিকে সাধুবাদ জানিয়েছেন সদ্য সাবেক শিক্ষার্থীরা যার ফলে হল ছেড়ে চলে যেতে কষ্ট হলেও হাঁসি মুখে নবীনদের স্বাগত জানিয়ে বিদায় নিচ্ছেন তারা। ❝এসেছে নতুন শিশু ছেড়ে দিতে হবে স্থান❞ কথাটিকে মনে গেঁথে বিদায় নিচ্ছেন সদ্য সাবেক শিক্ষার্থীরা। কিছু কিছু হলে করা হচ্ছে বিদায় অনুষ্ঠান দেওয়া হচ্ছে পুরস্কারও।
জসীম উদদীন হলের সদ্য সাবেক শিক্ষার্থী জাবেদ কায়সার বলেন, শুধু আমি না সিনিয়র সবাই চলে যাচ্ছি এজন্য কষ্ট হলেও সেটাকে কষ্ট মনে হচ্ছে না। যে নতুন সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছি সেই সংস্কৃতি আমাদের দিয়ে শুরু হলো এর জন্য ভালো লাগছে। আশা করি শিক্ষার্থীরা এই সংস্কৃতিকে ধারণ করবে। এই সুন্দর সংস্কৃতিকে সাধুবাদ জানিয়েই আমরা বিদায় নিতে চাই।
বিজয় একাত্তর হলের সদ্য সাবেক শিক্ষার্থী আবির বলেন, ফ্যাসিবাদের আমলে হলগুলোর প্রশাসনিক সিস্টেমের যে ভঙ্গুর দশা হয়েছিলো সেটি পুনরায় প্রতিষ্ঠা করার প্রথম ধাপ আমরা। আমরা সাহায্য না করলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা তার স্বকীয়তা ফিরে পাবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সুন্দর করতে, হলগুলোতে প্রথম বর্ষ থেকে সিফ নিশ্চিত করতে, গণরুম, গেস্টরুম সংস্কৃতির পরিবর্তে একটি সুষ্ঠু, সুন্দর ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে আমরা চলে যাচ্ছি। আমাদেরকে যেতেই হবে তবে এই সংস্কৃতি যেন মরে না যায় সেই প্রত্যাশা করি। এই সংস্কৃতি আমাদের অনুজদেরকে আমাদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে।
এদিকে হলের সদ্য সাবেক শিক্ষার্থীদেরকে বিদায় দিতে বিদায় অনুষ্ঠানের আয়োজনও করেছে ঢাবির কবি জসীম উদ্দিন হল। গত মাসের (সেপ্টেম্বর) ২৮ তারিখে হলে এ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, প্রক্টর, কোষাধ্যক্ষসহ অনেকেই উপস্থিত থেকে এধরণের সংস্কৃতিকে সাধুবাদ জানিয়েছেন এমন অন্যান্য হলেও এমন সংস্কৃতি দেখার ইচ্ছা পোষণ করেছেন।
হলগুলোতে এমন সংস্কৃতি ফিরিয়ে আসায় খুশি হল প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও। হলগুলো রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হওয়ায় হল প্রশাসন তাদের স্বাধীনতা, স্বকীয়তা ফিরে পাওয়ায় শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীরাও খুশি হয়েছেন।
ভোরের আকাশ/ সু
মন্তব্য