প্যাকেট ও সিগারেট একই আছে। সরকারকে ভ্যাটও দেওয়া হয়েছে, তবে তা পুরনো প্যাকেটের দামের ওপর। সরকারের বাজেট ঘোষণার পর শুধু দাম বৃদ্ধি করে উচ্চস্তরের সিগারেট বিক্রি করে রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে প্রায় ২১০ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। যেখানে প্যাকেট প্রতি সরকার রাজস্ব হারিয়েছে ১৪-১৫ টাকা। ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড ওই রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ)-মূল্য সংযোজন করের যাচাইয়ে এই বিপুল পরিমাণ ফাঁকি উদ্ঘাটিত হয়েছে।
এ বিষয়ে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, শুধু বিএটি নয়, বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানি জেটিআই এর প্রায় ১৩ কোটি টাকা ফাঁকি উদ্ঘাটিত হয়েছে। ইতোমধ্যে বিএটিকে দাবিনামা সংবলিত কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়েছে। এলটিইউ বিভাগ দীর্ঘ যাচাই-বাছাই শেষে ফাঁকি উদ্ঘাটন করে। গত ২৫ সেপ্টেম্বর বিএটিকে দাবিনামা সংবলিত কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করে এলটিইউ। আইনগত অন্যান্য ব্যবস্থা চলমান রয়েছে।
এনবিআর সূত্র বলছে, প্রতিবছর বাজেটে সিগারেটের দাম বা রাজস্ব বৃদ্ধি পায়। সিগারেট কোম্পানিগুলো বিশেষ করে বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানি বিএটি দাম বা মূল্য বৃদ্ধির সুযোগ নেয়। বাজেটের কয়েক মাস আগ থেকে সিগারেটের চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। বাড়তি উৎপাদিত সিগারেট ডিলার বা ডিস্ট্রিবিউটরদের সঙ্গে যোজসাজশ করে মজুত করা হয়। বাজেট ঘোষণার পরপরই কম দামের সেই সিগারেট বেশি দামে বাজারে বিক্রি করা হয়। এই বিক্রি চলে অন্তত ৪-৫ মাস। পুরনো এসব সিগারেটের ওপর বাড়তি কোনো রাজস্ব পায় না এনবিআর।
এলটিইউর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণায় সিগারেটের মূল্য ও সম্পূরক শুল্কহার পরিবর্তনের সম্ভাবনা বিবেচনায় রেখে সতর্কতামূলক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ৫ জুন মূসক কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানের সিগারেটের উৎপাদনস্থল বা কারখানায় গিয়েছেন। সেখান থেকে ৪ জুন পর্যন্ত ওয়্যারহাউজ বা ডিপোর তথ্য নিয়ে আসেন। ৬ জুন বাজেট ঘোষণা হয়। ওই দিন থেকে সিগারেটের স্তর ভিত্তিক মূল্য ও সম্পূরক শুল্কহার বৃদ্ধি কার্যকর হয়েছে। এই বর্ধিত মূল্যের ভিত্তিতে প্রযোজ্য শুল্ককর আরোপযোগ্য হবে। ওয়্যারহাউস বা ডিপোতে ৫ জুন পর্যন্ত মজুত থাতা সিগারেট ক্রেতার কাছে (ডিলার বা ডিস্ট্রিবিউটর) কোন মূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে এবং কী হারে শুল্ককর পরিশোধ করা হচ্ছেÑ এই বিষয়ে তথ্য চেয়ে বিএটিকে লিখিত বক্তব্য, হিসাব বিবরণী ও দলিলাদি দিতে তিনদিনের সময় দিয়ে এলটিইউ থেকে ১৪ জুলাই চিঠি দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠান ৩০ দিনের সময় চাইলে ৭ দিন সময় দেওয়া হয়। তবে ৩০ জুলাই তারা একটি হিসাব বিবরণী জমা দেয়। কিন্তু ডিলার বা ডিস্ট্রিবিউটরদের কোন মূল্যে সিগারেট সরবরাহ এবং কি হারে শুল্ককর পরিশোধ করা হচ্ছেÑ তার কোনো তথ্য দেয়নি বিএটি।
সূত্র মতে, সিগারেট নিয়ে এনবিআর ২০১৯ সালের ১৩ জুন একটি এসআরও (এসআরও নং-১৮১) জারি করেছে। যাতে অনুচ্ছেদ ৪(৩) এর বিধি অনুযায়ী, সিগারেট উৎপাদনের কারখানা থেকে সিগারেটের প্রতিটি অপসারণই সরবরাহ হিসেবে বিবেচিত। তবে অনুচ্ছেদ ৪(১) অনুযায়ী, নির্ধারিত মূল্যের অতিরিক্ত মূল্যে সিগারেট বিক্রয় বা সরবরাহের সুযোগ নেই। আবার ২০২০ সালের অপর এক এসআরও (এসআরও নং-১৪৭) অনুযায়ী, সিগারেটের স্থানীয় সরবরাহ পর্যায়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের ওপর প্রযোজ্য হারে উৎপাদনস্থল হতে সরবরাহের সময় মূসক ও সম্পূরক শুল্ক পরিশোধ করতে হবে এবং সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের অধিক মূল্যে কোনো পর্যায়েই সিগারেট বিক্রয় করা যাবে না। অর্থাৎ উপাদনস্থল থেকে যে মূল্যের ওপর মূল্য সংযোজন ও সম্পূরক শুল্ক পরিশোধ করা হয়েছেÑ সেই মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্যে সিগারেট সরবরাহ করা হলে সেই অধিক মূল্যের ওপর মূসক ও সম্পূরক শুল্ক প্রযোজ্য হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৬ জুন থেকে সিগারেটের স্তরভিত্তিক বর্ধিত মূল্য ও বর্ধিত সম্পূরক শুল্কহার কার্যকর হয়েছে। ৫ জুন পর্যন্ত ওয়্যারহাউজে মজুত সিগারেট সেই বর্ধিত মূল্যে বিক্রয় হওয়ায় বর্ধিত মূল্য ও বর্ধিত সম্পূরক শুল্কহারে প্রদেয় শুল্ককর পরিশোধযোগ্য হবে। প্রতিষ্ঠানের দাখিল করা হিসাব বিবরণী অনুযায়ী ৫ জুন পর্যন্ত মজুত করা সিগারেট ৬ জুন থেকে সরবরাহ সংক্রান্ত মূল্য প্রদর্শন করা হয়েছে। যেমনÑ ৫ জুন পর্যন্ত বিএটির বেনসন হেজেজ ব্লু গোল্ড লিফ (২০ শলাকা), বেনসন অ্যান্ড হেজেজ সুইস, বেনসন হেজেজ ফিউশন, বেনসন হেজেজ ব্রিজ, বেনসন হেজেজ বিজি বক্স আউটার, বেনসন হেজেজ ব্লু গোল্ড (১২ শলাকা), বেনসন হেজেজ এসএফ, বেনসন হেজেজ নেকড ওয়ারফ প্রতি ১০০০ শলাকার মূল্য ঘোষণা করেছে ১৫ হাজার ৫০০ টাকা। আর ৬ জুন হতে এই প্রতি ১০০০ শলাকার সরবরাহ মূল্য হয় ১৫ হাজার ৯৯৬ টাকা ২৭ পয়সা। অর্থাৎ ১০০০ শলাকার বাড়তি মূল্য দিতে হয় ৪৯৬ টাকা ২৭ পয়সা। একইভাবে বেনসন হেজেজ আলকেমি প্রতি ১০০০ শলাকা ১৬ হাজার টাকা, যা ৬ জুন হতে ৯৯৬ টাকা ২৭ পয়সায় সরবরাহ হয়। একইভাবে জন প্লেয়ার স্পেশাল, জন প্লেয়ার গোল্ডলিফ, জন প্লেয়ার সুইস, ক্যাপাসটন, লাকি স্ট্রাইকের পাঁচটি ব্রান্ড, স্টার ফিল্ডারের তিনটি ব্রান্ড, পাইলট, ডারবি, হলিউড একইভাবে বাড়তি দামে সরবরাহ করে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৫ জুন পর্যন্ত এবং ৬ জুন থেকে কার্যকর মূল্য, শুল্ককরের পার্থক্যজনিত পরিহারকৃত মূসকের হিসাব করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, ৬ জুন থেকে বিএটির ব্রান্ড বেনসন অ্যান্ড হেজেজ বিজি ব্লাক আউটার ২০ শলাকার সিগারেট সরবরাহ করা হয়েছে ২১ লাখ ৪০ হাজার শলাকা। এই ২০ শলাকার সিগারেটের দাম ৩২৪ টাকা। যাতে ৬৫ দশমিক ৫ শতাংশ হারে সম্পূরক শুল্ক ২১২ টাকা ২২ পয়সা, মূসক ৪৮ টাকা ৬০ পয়সা, সারচার্জ ৩ টাকা ২৪ পয়সা। ফলে ২১ লাখ ৪০ হাজার শলাকার ওপর প্রযোজ্য সম্পূরক শুল্ক ২ কোটি ২৭ লাখ ৭ হাজার ৫৪০ টাকা, মূসক ৫২ লাখ টাকা ও সারচার্জ ৩ লাখ ৪৬ হাজার ৬৮০ টাকা। মোট শুল্ককর ২ কোটি ৮২ লাখ ৫৪ হাজার ৪২০ টাকা। একইভাবে প্রতিষ্ঠানটি ৩৭টি ব্রান্ডের সিগারেট সরবরাহ করেছে ৫৩৯ কোটি ৪৮ লাখ ৯২ হাজার ৪৬০ শলাকা। যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর ৩২৫৫ কোটি ৫২ লাখ ১ হাজার ৪২৭ টাকা। অন্যদিকে, ৫ জুন পর্যন্ত বেনসন অ্যান্ড হেজেজ বিজি বক্স আউটার ২০ শলাকা সরবরাহ হয়েছে ২১ লাখ ৪০ হাজার। ২০ শলাকার ওপর প্রযোজ্য শুল্ককর ৫৬ শতাংশ। ৩১০ টাকা মূল্যের এই সিগারেটের ওপর প্রযোজ্য সম্পূরক শুল্ক ২০১ টাকা ৫০ পয়সা, মূসক ৪৬ টাকা ৫০ পয়সা ও সারচার্জ ৩ টাকা ১০ পয়সা। সে অনুযায়ী সরবরাহ করা এই সিগারেটের উপর প্রযোজ্য শুল্ককর দাঁড়ায় ২ কোটি ৬৮ লাখ ৬৭ হাজার ৭০০ টাকা। আবার বাজেটের পরে বেনসন অ্যান্ড হেজেজ বিজি বক্স আউটার ওপর শুল্ককর বেড়েছে ১৩ লাখ ৮৬ হাজার ৭২০ টাকা। ৫ জুন পর্যন্ত কার্যকর মূল্যের ভিত্তিতে ৩৭টি ব্রান্ডের সিগারেটের ওপর প্রযোজ্য মোট শুল্ককর ৩০৪৪ কোটি ৬৫ লাখ ৩৮ হাজার ৮৬ টাকা। অর্থাৎ এই টাকা পরিশোধ করে প্রতিষ্ঠান ওয়্যারহাউস থেকে সিগারেট বের করেছে। আবার ৬ জুন থেকে ডিলার বা ডিস্ট্রিবিউরদের কাছে বর্ধিত মূল্যে সরবরাহ করা ৪১টি ব্রান্ডের সিগারেটের ওপর প্রযোজ্য শুল্ককর দাঁড়ায় ৩২৫৫ কোটি ৫২ লাখ ১ হাজার ৪২৭ টাকা। সে অনুযায়ী বর্ধিত মূল্যে সিগারেট বিক্রি করে প্রতিষ্ঠান ফাঁকি দিয়েছে ২১০ কোটি ৮৬ লাখ ৬৩ হাজার ৩৪২ টাকা। অর্থাৎ ৫ জুনের আগের সিগারেট মজুত করে রাখা হয়েছে, যা ৬ জুনের পর বিক্রি করা হয়েছে। যাতে এই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। মূসক আইনের ১২৭(১) অনুযায়ী দাবি করা রাজস্ব পরিশোধের পূর্ব দিন পর্যন্ত প্রযোজ্য হারে সুদ আদায়যোগ্য হবে। সুদ যোগ করা হলে ফাঁকির পরিমাণ আরও বাড়বে বলে জানিয়েছে এনবিআর।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য