আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের উপ-সচিব থেকে ধাপে ধাপে অতিরিক্ত সচিব হন হারুন-অর রশিদ বিশ্বাস। তবে সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের একান্ত সচিব (পিএস)। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। নিয়োগ-বাণিজ্য, জমি দখল, লুটপাট ও প্রকল্পের নামে অর্থ আত্মসাৎ করে গড়েছেন শত কোটি টাকার সম্পদ। অবৈধ সেই সম্পদের পাহাড়ের সন্ধানে হারুন-অর রশিদ বিশ্বাস, তার স্ত্রী ওয়াহিবা আক্তার ও মেয়ে দোয়া বিনতে রশীদের নাম ও জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য দিয়ে সরকারি-বেসরকারি অন্তত ৯৯টি প্রতিষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট নথিপত্র তলব করে চিঠি দিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান কর্মকর্তা।
চলতি সপ্তাহের বিভিন্ন সময়ে দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও উপ-পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলমের সই করা তলবি চিঠিতে তাদের নামে থাকা ব্যাংক হিসাব, সঞ্চয়পত্র, জমি, ফ্ল্যাট ও শেয়ারসহ বিভিন্ন নথিপত্র তলব করা হয়েছে বলে জানা গেছে। যেসব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নথিপত্র তলব করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছেÑ বাংলাদেশ ব্যাংক, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ সরকারি-বেসরকারি ৭৭টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান; সমবায় অধিদপ্তর; রাকিন ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড; মুক্তিযোদ্ধা পরিবার কল্যাণ সমিতি; রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এবং ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও বরিশালের জেলা রেজিস্ট্রার কার্যালয়; ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন; চট্টগ্রাম, গাজীপুর ও বরিশাল সিটি করপোরেশন; বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ); বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ; বাংলাদেশ ডাক বিভাগ; জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর; বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন; পটুয়াখালী, নারায়ণগঞ্জ ও কলাপাড়া সাব-রেজিস্ট্রার অফিস, সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড ও জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ ইত্যাদি।
এ বিষয়ে দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন বলেন, কমিশনের অনুসন্ধানের সিদ্ধান্তের পর দুদক আইন ও বিধি অনুসরণ করে অনুসন্ধান কর্মকর্তা তার অনুসন্ধানকাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। অনুসন্ধান শেষ হওয়ার পরই প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত বেরিয়ে আসবে বলে মনে করি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত সচিব হারুন-অর রশিদ বিশ্বাস। পরবর্তীতে তাকে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের একান্ত সচিব (পিএস) করা হয়। বরিশালের মুলাদী উপজেলার কাজীরচর ইউনিয়নের চরকমিশনার গ্রামের কৃষক আব্দুল আওয়াল বিশ্বাস ও শামসুন্নাহার দম্পতির ছেলে হারুন বিশ্বাস। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও পদে থেকে তিনি নিজ উপজেলা ও রাজধানীতে গড়েছেন অঢেল সম্পদ। হারুন নিজের প্রভাব খাটিয়ে টানা দুবার আওয়ামী লীগের টিকিটে ভোটারবিহীন নির্বাচনে বড় ভাই মন্টু বিশ্বাসকে ইউপি চেয়ারম্যান বানিয়েছেন। শুধুমাত্র ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে অন্তত ২৫ আত্মীয়কে চাকরি দিয়েছেন। নিজ উপজেলা ও রাজধানীতে কিনেছেন জমি ও ফ্ল্যাট। হারুন বিশ্বাস তার মায়ের নামে শামসুন্নাহার ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট তৈরি করেছেন। সেই ট্রাস্টের প্রধান পৃষ্ঠপোষক তিনি নিজে। বাড়ির সামনে সরকারি টাকায় বেগম শামসুন্নাহার ওয়েলফেয়ার সোসাইটি ভবন নির্মাণ করেছেন। সরকারি টাকায় নির্মিত ভবনটি এখন নিজেদের বসতবাড়ি হিসেবে ব্যবহার করছেন বড় ভাই মন্টু বিশ্বাস। ‘বঙ্গবন্ধু মডেল গ্রাম’ প্রকল্পের নামেও লুটপাট করেছেন হারুন ও মন্টু বিশ্বাস। জমি ক্রয় করে মডেল গ্রামের নামে ‘মডেল ভবন’ নির্মাণের কথা থাকলেও তা করা হয়নি। বরং সরকারি খাল দখল করে মডেল ভবন নির্মাণ করে আত্মসাৎ করেছেন জমি ক্রয়ের জন্য বরাদ্দের টাকা। নিজ এলাকা কাজীরচর ইউনিয়নের চরকমিশনার কলম খাঁর মোড় এলাকায় গণকবরস্থানের নামে দখল করেছেন বহু মানুষের ফসলি জমি। সেই সঙ্গে সরকারি খাসজমিতে বালু ভরাট করে আত্মসাৎ করেছেন কোটি টাকা। ঢাকার কল্যাণপুরে হারুন বিশ্বাসের নিজের নামে চারটি ফ্ল্যাট ও ঢাকার সাগুফতায় রয়েছে ২০ কাঠা জমি। হারুন বিশ্বাস ও মন্টু বিশ্বাস প্যাদারহাট ওয়াহেদিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জমি এবং নিয়োগ-বাণিজ্য করে প্রায় তিন কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। মন্টু বিশ্বাস দক্ষিণ কাজীরচর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ-বাণিজ্য করে এক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পরে মুলাদী থানার ৭ নম্বর কাজীরচর ইউনিয়নে প্রায় ২০০ বিঘা জমি ক্রয় করেন। মন্টু বিশ্বাসের মাছের ঘের ও গরুর খামার আছে। এমনকি সরকারি খাল দখল করে ১৫ একর জমির ওপর গড়েছেন মাছের ঘের। বরিশালের মুলাদীতে প্যাদারহাট বাজারে অন্যের জমি দখল করে তার পরিবার তিনটি বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন। পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নে হায়েতসার মৌজায় রতন ডাকাতের ছেলেদের জিম্মি করে প্রশাসনের ভয় দেখিয়ে ঘরবাড়িসহ প্রায় ২২ বিঘা সম্পত্তি হারুন বিশ্বাস নিজের নামে দলিল করে নেন। সেখানে আরও প্রায় ৩০ বিঘা জমি জোরপূর্বক দখল করে রাখেন মন্টু বিশ্বাস। ভাইয়ের নামে আরও কিনেছেন চার বিঘা জমি। পার্শ্ববর্তী উপজেলা বাবুগঞ্জের কৃষ্টরুদ্র মৌজায় বাড়িসহ প্রায় তিন একর জমি প্রশাসনের ভয় দেখিয়ে দখল করেন মন্টু বিশ্বাস। বরিশাল বিএম কলেজ এলাকায় কোটি টাকার জমি ক্রয় করেছেন হারুন ও মন্টু বিশ্বাস। এ বিষয়ে বক্তব্য নেওয়ার জন্য সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পিএস হারুন বিশ্বাসের মোবাইল ফোনে কল করেও পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত, সাবেক অতিরিক্ত সচিব হারুন-অর রশিদ বিশ্বাসের দুর্নীতির অনুসন্ধানের পাশাপাশি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও তার পরিবার এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্ম-সচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোল্লা ইব্রাহিম হোসেন, সহকারী একান্ত সচিব মনির হোসেন ও জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপুসহ আটজনের দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানকাজ চলমান রয়েছে বলে জানায় দুদক।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য