- ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানোর আশ্বাস আনোয়ার ইব্রাহিমের
- গুরুত্ব পাবে সেবাখাত
- অপেক্ষায় লাখো কর্মী
- কপাল খুলল সেই ১৮ হাজার কর্মীর
৫৮ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে গতকাল শুক্রবার ঝটিকা সফরে ঢাকায় এসেছেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। তার এই সফরে দুদেশের মধ্যে বাণিজ্য ও শ্রমবাজারসহ নানা ইস্যুতে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির অন্যতম বৃহৎ বাজার মালয়েশিয়া, ফলে এ বিষয়টি মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়াও মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে যে সংকট চলছে - সে আলোচনা গুরুত্বের কেন্দ্রে থাকতে পারে বলে মনে করছেন অভিবাসন বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানির তালিকায় চতুর্থ দেশ হিসেবে রয়েছে মালয়েশিয়া। কিন্তু এরপরও দেশটির শ্রমবাজার নিয়ে বাংলাদেশের কর্মীদের এক ধরনের অনিশ্চয়তা বরাবরই থেকে যায়। এ নিয়ে দুদেশের মধ্যে বিভিন্ন সময় নানা টানাপড়েনও সামনে এসেছে। গত দেড় দশকে বিভিন্ন সময় দফায় দফায় বন্ধ ছিল সেখানকার বাংলাদেশের শ্রমবাজার।
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার প্রথম দফায় বন্ধ হয় ২০০৯ সালে। আর সবশেষ গত ১ জুন শেষ হয়ে যায় মালয়েশিয়ায় কর্মী ভিসায় যাওয়ার সময়। শ্রমবাজার বন্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবারই শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে চক্র বা সিন্ডিকেটের বিষয়গুলো আলোচনা এসেছে। এসব চক্রের বিরুদ্ধে উঠেছে অনিয়ম, দুর্নীতি ও ঘুষের অভিযোগ। প্রায় এক দশক পর মালয়েশিয়ার কোনো প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করছেন। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সরকারি সফরটি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের সরকারপ্রধানের প্রথম ঢাকা সফর। ফলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এ সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
জানা গেছে, গত চার মাস ধরে বাংলাদেশের মালয়েশিয়ায় গমনেচ্ছু কর্মীদের জন্য দেশটির শ্রমবাজার বন্ধ রয়েছে। সর্বশেষ ৩১ মে দেশটিতে বাংলাদেশিদের জন্য শ্রমবাজার বন্ধ করা হয়। এতে বিএমইটি কার্ড ও ভিসা থাকা সত্ত্বেও প্রায় ১৭ হাজার ৭৭৭ জন বাংলাদেশি কর্মী দেশটিতে যেতে পারেননি। ৩১ মের পর যেতে না পারা এসব কর্মী ফের যাওয়ার চেষ্টা ও টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য এজেন্সিগুলোতে ধর্না দেন। টাকা খুইয়ে এসব কর্মীর অনেকে এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তারা মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলার অপেক্ষায় রয়েছেন। এছাড়া জনশক্তি রপ্তানি ও রিক্রুটিং করার ক্ষেত্রে দুদেশের সিন্ডিকেট নিয়েও নানা অভিযোগ রয়েছে। ২০০৯ সালে প্রথম দফা বন্ধ হয়ে ২০১৬ সালের শেষার্ধে খোলার পর বাংলাদেশের ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সি সিন্ডিকেট গড়ে। দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে আবার শ্রমবাজারটি বন্ধ হয়।
এরপর ২০২২ সালে মালয়েশিয়া সরকার আবার শ্রমবাজার খুলে দিলে নতুন করে চক্র গড়ে ওঠে। চলতি বছরের মার্চে মালয়েশিয়া সরকার জানায়, দেশটি আপাতত আর শ্রমিক নেবে না। যারা অনুমোদন ও ভিসা পেয়েছেন, তাদের ৩১ মের মধ্যে মালয়েশিয়ায় যেতে হবে। এভাবে দফায় দফায় শ্রমবাজার বন্ধ হওয়ায় প্রবাসী আয়ের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। এ অবস্থায় শ্রমবাজারের দিকে চোখ রেখে আনোয়ার ইব্রাহিমের এই ঢাকা সফরটিকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন অভিবাসন বিশ্লেষকেরা। তারা মনে করছেন, এ সফরটি দুদেশের সম্পর্ক আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে শ্রমবাজারসহ নানা সংকট দূর করবে।
অভিবাসন বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ এবং মালয়েশিয়া দুই দেশের সরকারকেই শ্রমিক নিয়োগের প্রক্রিয়া সংশোধন করতে হবে। এর আগে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার তদন্ত করতে হবে। দক্ষ কর্মী পাঠানোর বিষয়ে উভয় দেশকে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনতে হবে।
অভিবাসন নিয়ে কাজ করা বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, এ মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো - হাজার হাজার কর্মী মালয়েশিয়ায় গিয়ে চাকরি না পেয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাদের অনেকে জেলে যাচ্ছেন। অনেকে কাজ না পেয়ে হতাশা নিয়ে দেশে ফেরত আসছেন। আশা করি ড. ইউনূস এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখবেন। এটিই এখন আমাদের সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা। তিনি বলেন, গত মে মাসে শ্রমবাজার বন্ধ হওয়ার পর যারা যেতে পারেনি তাদের নেওয়ার ব্যবস্থা করা জরুরি। একই সঙ্গে সিন্ডিকেট করে যারা কর্মীদের কাছ থেকে তিন থেকে পাঁচগুণ বেশি টাকা হাতিয়ে নিল, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের কাছে শত শত অভিযোগ রয়েছে, কর্মীরা ৫-৬ লাখ টাকা খরচ করে মালয়েশিয়া গিয়েও মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। একটি চক্র তাদের সেদেশে নিয়ে কাজ দিতে না পেরে থাকা-খাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে টাকা নিতে জোর করছে। এছাড়া অনেক কর্মীর ভাগ্যে জুটছে কারাবাসও।
তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের শ্রমবাজার নিয়ে যে সমঝোতা চুক্তি আছে সেখানে সংস্কার করতে হবে। এ চুক্তিতে একটা বিষয় রয়েছে মালয়েশিয়ার ইমপ্লয়াররা নির্ধারণ করবে তারা বাংলাদেশ থেকে কোনো রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে লোক নেবে। এটি অতিদ্রুত পরিবর্তন করতে হবে। তারপর এর মেকানিজমের জায়গায় দুদেশের যে সিন্ডিকেট সেটা দূর করতে হবে। তাই আগে এজেন্সি নির্ধারণে তাদের যে প্রভাব সেটি এই চুক্তিতে পরিবর্তনের মাধ্যমে দূর করতে হবে। এটি করতে পারলে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে যাবে। শ্রমিকদের প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকিও অনেকাটাই কমে যাবে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনির বলেন, মালয়েশিয়ায় অভিবাসনের ক্ষেত্রে যেসব দুর্নীতি হচ্ছে সেগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত দরকার। এটি শুধু রিক্রুটিং এজেন্সি নয় - ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এমনকি সরকারি পর্যায়েও তদন্ত দরকার। প্রয়োজনে দুদেশের মধ্যে জয়েন্ট টিম গঠন করা উচিত। দুই দেশ থেকে নির্ধারিত প্রতিনিধি থাকবে, একই সঙ্গে দুই দেশের গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিও এই টিমে কাজ করতে পারে। তিনি বলেন, গত মে মাসে যারা যেতে পারেননি তাতে আমাদের বেশি গাফিলতি ছিল। কোনো জায়গায় গ্যাপ ছিল, কেন তারা যেতে পারলো না, এ বিষয়গুলো অবশ্যই খোঁজা দরকার। সামনে কলিং ভিসা ও মৌসুমি ভিসা চালু হতে পারে। সেক্ষেত্রে অতীতের ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে, ভবিষ্যতে নতুন করে যেন সংকট তৈরি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
এই অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, মালয়েশিয়ায় আমাদের দেশের কর্মীদের বিশেষ চাহিদা আছে। সেক্ষেত্রে দক্ষ জনবল নেওয়ার ব্যাপারে দুদেশের মধ্যে আলোচনা হতে পারে। যেভাবে জাপান বা দক্ষিণ কোরিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি হয়। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া যেভাবে ট্রেইনার এনে পরীক্ষার মাধমে লোক নিয়োগ করে, মালয়েশিয়ায় জনবল রিক্রুটের ক্ষেত্রেও এটি করা যেতে পারে। আমাদের যে ট্রেনিং সেন্টার রয়েছে, সেখান থেকে দক্ষ লোক বাছাই করতে পারে। মালয়েশিয়া তাদের দিক থেকে ট্রেইনার এনে পরীক্ষা করে নিতে পারে। আমাদের লোকজন যেহেতু তাদের কাজে লাগে, তাহলে তারা সেভাবে তাদের মতো করে দক্ষ শ্রমিক তৈরি করে নিতে পারে। অদক্ষ জনশক্তি নিয়ে হয়রানি করার তো কোনো দরকার নেই - বলেছেন আসিফ মুনির। তার ভাষ্য, অনেক বছর ধরেই এই শ্রমবাজারে আমরা সমস্যা দেখছি। সমাধানের জন্য সবাই বলে, আমরাও বলি। কিন্তু সমাধান তো হচ্ছে না। এখন এটার জন্য কার্যত পদক্ষেপ দেখতে চাই। মালয়েশিয়ায় যে সিন্ডিকেট রয়েছে তাদের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে একটা সম্পর্ক আছে। এটা মালয়েশিয়ার দিক থেকে তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ায় জোর দিতে হবে। যদিও অতীতে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ কাজটি মালয়েশিয়ার সরকারকে নীতিগতভাবে করতে হবে।
এর আগে ২০১৩ সালের নভেম্বরে সরকারি সফরে ঢাকায় এসেছিলেন মালয়েশিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক। সে হিসাবে প্রায় ১১ বছর পর দেশটির কোনো প্রধানমন্ত্রী ঢাকা সফর করছেন।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য