বিএনপিকে দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আনুষ্ঠানিক দ্বিতীয় দফার সংলাপ হবে আজ। সরকারের পক্ষ থেকে সংলাপটি রাষ্ট্র সংস্কারে গঠিত ছয় কমিশনের কার্যক্রমকেন্দ্রিক বলা হলেও নির্বাচনি রোডম্যাপ ইস্যুটিই প্রধান্য পাবে। জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করার জন্য সরকারের ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর চাপ বেড়েই চলেছে। এমন পরিস্থিতিতে সেনা প্রধানের বক্তব্যে দেড় বছর বেরিয়ে এলেও রোডম্যাপ নিয়ে বির্ভিন্ন সময়ে প্রধান উপদেষ্টার ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। তাই আজকের দ্বিতীয় দফা সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলো সুর্নিদিষ্ট নির্বাচনি রোডম্যাপের জোরালো দাবি তুলবে বলে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে।
প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় আজ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপ শুরু করবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ সংলাপে সরকারের উপদেষ্টারাও থাকবেন। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিকে দিয়ে এ সংলাপ শুরু হবে। সংলাপে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলকে এককভাবে ডাকা হয়েছে। আবার জোটভুক্ত দলগুলোকে জোটগতভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘শনিবারের সংলাপে যোগ দিতে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। দুপুর আড়াইটা থেকে এ সংলাপ শুরু হবে।' প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলবেন জানান প্রেস সচিব।
সংলাপের সময়সূচি: দুপুর আড়াইটায় বিএনপি, বিকাল তিনটায় জামায়াতে ইসলামী, বিকাল সাড়ে তিনটায় গণতন্ত্র মঞ্চ এবং বিকাল চারটায় বাম গণতান্ত্রিক জোট, বিকালে সাড়ে চারটায় হেফাজতে ইসলাম, পাঁচটায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, সাড়ে ৫টায় এবি (আমার বাংলাদেশ) পার্টি।
এর আগে গত ১২ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে প্রথম দফায় মতবিনিময় হয়। সেদিন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপি, ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, শাহ আলমের নেতৃত্বে সিপিবি, মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বে গণতন্ত্র মঞ্চ, আন্দালিব রহমান পার্থের নেতৃত্বে বিজেপি, মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করীমের নেতৃত্বে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, এএফএম সোলায়মান চৌধুরীর নেতৃত্বে এবি পার্টি, নুরুল হক নূরের নেতৃত্বে গণঅধিকার পরিষদ, হারুন চৌধুরীর নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, ববি হাজ্জাজের নেতৃত্বে এনডিএম আলাদা আলাদাভাবে মতবিনিময় করেন।
সর্বশেষ গত ২৯ আগস্ট বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পরে খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন এবং নেজামে ইসলাম বাংলাদেশের সঙ্গে মতবিনিময় হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি), জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, বাংলাদেশ জাসদ, ১২ দলীয় জোট, গণফোরাম ও জাতীয় পার্টির প্রতিনিধি দলের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার মতবিনিময় হয়।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা বলছেন, বিভিন্ন ইস্যুর মধ্যে নির্বাচনি রোডম্যাপের বিষয়টিই সংলাপে প্রাধান্য পাবে। সরকার পতনের দ্বিতীয় মাস সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে তার ইঙ্গিত দেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ১৮ মাসের মধ্যে যাতে নির্বাচন হয়, সে জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে তার সমর্থনের অঙ্গীকার প্রকাশ পায়। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে, সে ব্যাপারে একটি রূপরেখা বা রোডম্যাপ দেওয়ার তাগিদ দিয়ে চলেছে রাজনৈতিক দলগুলো। দেশে কখন নির্বাচন হবে, সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বলে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে বলেছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। রোডম্যাপের বিষয়ে তিনি বিভিন্ন সময় ‘জনগণ ঠিক করবে’ ও ‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত’ এসব মন্তব্য করেন। সর্বশেষ ‘সরকার কতদিন থাকবে, তা সরকারই ঠিক করবে’ এমন তথ্য জানান। এতে অন্তর্বর্তী সরকারের স্থায়ীত্ব এবং নির্বাচনি রোডম্যাপ নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়। তাই সুনির্দিষ্ট নির্বাচনি রোডম্যাপের বিকল্প নেই বলে জানান রাজনৈতিক দলের নেতারা।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশ ও জনগণ এবং দল ও রাষ্ট্র পরিচালনর স্বার্থে বিএনপির নির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব আছে। এগুলোর বিষয়ে আগাম কিছুই বলা যাবে না। আমাদের কিছু বক্তব্য আছে সেগুলো বলব। তা ছাড়া সরকার যা জানতে চাইবে সে বিষয়েও কথা বলব। বিভিন্ন সংস্কারের বিষয়ে প্রস্তাব দেওয়া হবে। মূলত সরকারের বক্তব্যের বাইরে আমাদের সুনির্দিষ্ট কিছু বক্তব্য থাকবে। বিশেষ করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পর রাষ্ট্র পরিলচানা এবং নির্বাচনি রোডম্যাপ ইস্যুতে বক্তব্য থাকবে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এএইচএম হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, সংস্কারের উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। কেননা রাজনৈতিক দলগুলোই হচ্ছে প্রধান অংশীজন। তাদের মতামত নিয়ে এগোলে সংস্কারের প্রক্রিয়া আরও ভালো হবে।
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নায়েবে আমির মাওলানা মুহিউদ্দিন রাব্বানী বলেন, উপদেষ্টা পরিষদ কী বিষয়ে জানতে চাইবেন সে বিষয়ে মতামত দেবেন। পাশাপাশি তাদের নির্দিষ্ট কিছু দাবি-দাওয়া তুলে ধরবেন। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- হেফাজতের নামে থাকা সকল মামলা প্রত্যাহার করা, শিক্ষানীতি সংশোধন করা।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি ফয়জুল করিম বলেন, শনিবার বিকেল ৫টায় তাদের সঙ্গে সংলাপ হবে। তারা বিভিন্ন ইস্যুতে কথা বলবেন। বিশেষ করে ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী গণঅভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র পরিচালনার বর্তমান কী অবস্থা, আন্দোলনের যে লক্ষ্য ছিল তার প্রতিফলন কতটুকু হলো এ বিষয়ে কথা বলব।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, আমাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমরা জানতে চাইব যে, সরকার তো কমিশন করেছে অনেকদিন হয়ে গেল; কিন্তু প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। কমিশন ১ অক্টোবর থেকে কাজ শুরুর কথা থাকলেও সেটি পারেনি। কমিশনের কাজ কী হবে? সে বিষয়ে কোনো কথা বলেনি। তবে অন্তর্বর্তী সরকার তার রাজনৈতিক জার্নিটা কোথায় কীভাবে শেষ করবেন একটা গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে, সে বিষয়ে জানার আগ্রহ থাকবে। আমরা নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে কথা বলব। কেননা এখন তো নির্বাচন কমিশন নেই। সেটি কীভাবে গঠন করা যায়, সে বিষয়েও কথা বলব। প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার বিষয়েও কথা বলব। যদিও এসব সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে স্বাভাবিক করা, ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণসহ পুলিশ বাহিনীর সংস্কারের বিষয়েও আলোচনা হতে পারে।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য