আজ ৫ অক্টোবর। গত আগস্টের আজকের দিনে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। এর মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার টানা ১৬ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। শেখ হাসিনার পদত্যাগের তিন দিনের মাথায় নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করে। দায়িত্ব নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্র সংস্কারের ঘোষণা দেন। সে অনুযায়ী কার্যক্রম চলছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দুই মাসে কোথায় দাঁড়িয়ে দেশ, কী পরিবর্তন এলো-এমন প্রশ্নের উত্তর জানার আগে মোটা দাগে যে বিষয়গুলো সামনে আসবে তা হলোÑ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হতাহতের পূর্ণাঙ্গ তালিকা এখনও হয়নি। মুছে যায়নি ভাঙচুর ও অগ্নিকাণ্ডের শিকার স্থাপনাসমূহের ক্ষত। আওয়ামী লীগের ও তার সহযোগী সংগঠনসমূহের নেতাদের পলায়ন অব্যাহত রয়েছে। স্বাভাবিক হয়নি দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। শেখ হাসিনার পতনের দ্বিতীয় মাসে জাতি প্রত্যক্ষ করেছে বেশ কিছু নতুন ঘটনা। সেপ্টেম্বরে রেকর্ড সংখ্যক আওয়ামী লীগ নেতা গ্রেফতার হয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম দফা বৈঠক করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। সরকার, প্রশাসন ও বৈষম্য আন্দোলনের সমন্বয়কদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতবিরোধ সৃষ্টির বিষয়টি দেশবাসীর নজরে এসেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত, শেখ হাসিনার সরকার পতনের মাস আগস্টে এক নতুন অরাজক পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছে দেশবাসী। ১৯৭৫, ১৯৯০, ১৯৯৬ ও ২০০৭ সালে দেশে সরকারের পতন ও পরিবর্তনের পর অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হলেও তা এতোটা দীর্ঘ ছিল না। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিন দিন সরকারবিহীন দেশে জীবন ও সম্পদের নিশ্চয়তার খোঁজে ছিল মানুষ। ভাঙচুর, লুটপাট, ডাকাতি ও হানাহানি ঘটনা ঘটেছে রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। স্বাধীনতার পর ৫৩ বছরে এমন অরাজক পরিস্থিতি মানুষ আর প্রত্যক্ষ করেনি। দেশ এখনও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারেনি। কবে নাগাদ স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরবে তাও অজানা। তবে গণতান্ত্রিক পরিবেশ না ফেরা পর্যন্ত পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হবে না বলে মনে করেন তারা।
আগস্টে রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে পরিবর্তন আনা হয়েছে সর্বোচ্চ বিচারালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, প্রশাসন, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী, প্রশাসনের শীর্ষ পদ, বাংলাদেশ ব্যাংক, রাষ্ট্রায়াত্ত বিভিন্ন ব্যাংক, বিভিন্ন দপ্তর-পরিদপ্তরের শীর্ষ পদে আগের দায়িত্বপ্রাপ্তদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। জনপ্রশাসনের শীর্ষ পদগুলোতেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ ১৫ বছর আওয়ামী লীগের শাসনামলে যারা সুবিধাভোগী ছিলেন তাদের বাদ দিয়ে বঞ্চিতদের মধ্য থেকে প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
আওয়ামী সরকার পতনের দ্বিতীয় মাস:
দৈনিক ভোরের আকাশের পর্যবেক্ষণ, বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ এবং সরকারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সরকার পতনের দ্বিতীয় মাসেও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির পুরোপুরি উন্নতি ঘটেনি। নিরাপত্তাহীনতায় থাকে দেশবাসী। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দলবদ্ধভাবে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। রাত জেগে পাহারা বসায় এলাকাবাসী।
রাজধানী হয়ে ওঠে দাবি আদায়ে বিক্ষোভ সমাবেশ, মানবন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালনকারীদের মহাসমাবেশস্থল। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আন্দোলনকারীদের অবস্থানে মুখরিত থাকে শাহবাগ, প্রেস ক্লাব, প্রধান উপদেষ্টার বাস ভবন ও সচিবালয় এলাকা। প্রতিদিন চার থেকে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের আন্দোলনে রাজধানীতে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। সচিবালয়ের ভেতরে আন্দোলনের প্রবেশর ঘটনাও ঘটে। আন্দোলনকারী আনসার সদস্যদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের হামলা ও পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটে।
অন্তর্বর্তী সরকার, প্রশাসন ও বৈষম্য ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধির বেশ কিছু ঘটনা ঘটে। অন্তর্বর্তী সরাকরের দায়িত্ব গ্রহণের এক মাসে বিভিন্ন সভা সেমিনারে তাদের বক্তব্যে ক্রমেই তা দৃশ্যমান ওঠে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার ও শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি সমন্বয়করা একই সূত্রে গাঁথা। কিন্তু সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার বিশেষ করে বেশ কয়েকজন উপদেষ্টার কার্যকলাপের কড়া ভাষায় সমালোচনা করেছেন সমন্বয়করা। সরকারের একের পর এক রদ-বদল ও নিয়োগ কার্যক্রমে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে প্রশাসনে। আর সমন্বয়কদের অহেতুক হস্তক্ষেপে বিরক্ত অন্তর্বর্তী সরকার ও প্রশাসন। এই ত্রিমুখী দূরত্ব সৃষ্টিতে পেছন থেকে কেউ কেউ ইন্ধন যোগাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। তিন দিন পর ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। প্রধান উপদেষ্টাসহ এ সরকারের সদস্যসংখ্যা ২১। উপদেষ্টামণ্ডলীতে রয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ। মানবাধিকার, অর্থনীতি, প্রশাসন, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলাসহ নানা ক্ষেত্রে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত, পদক্ষেপসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে প্রাথমিকভাবে ছয়টি কমিশন গঠন করে সরকার।
জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করার জন্য সরকারের ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর চাপ বেড়েই চলেছে। রোডম্যাপ নিয়ে বির্ভিন্ন সময়ে প্রধান উপদেষ্টার ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। সেনা প্রধানের বক্তব্যে দেড় বছর বেরিয়ে হলেও সরকার কতদিন থাকবে, তা সরকারই নির্ধারণ করবে বলে জানান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অবশেষে আজ ৫ অক্টোবর থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফার সংলাপ করবেন প্রধান উপদেষ্টা।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই সব সেক্টরেই রদ বদল ও নিয়োগ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। সরকার পতনের দ্বিতীয় মাসেও তা অব্যাহত থাকবে। স্বাভাবিক কর্মপরিবেশ ফিরে আসেনি সরকারের অস্থির প্রশাসনে। এই অস্থিরতার পরিধি সচিবালয় থেকে উপজেলা প্রশাসন পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে। বদলি ও পদোন্নতি নিতে দৌড়ঝাপ চলছে পদবঞ্চিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের। এতে আতঙ্কে বিদায়ী সরকারের সুবিধাভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কর্মস্থলে যাচ্ছেন না তাদের অনেকে। সব মিলিয়ে প্রশাসনে ফিরে আসেনি শৃঙ্খলা।
আওয়ামী সরকার পতনের দ্বিতীয় মাসে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বহু হামলার ঘটনা ঘটেছে। কোথাও বাড়িঘরে, কোথাও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে, কোথাও উপাসনালয়ে হামলা-ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনাও ঘটে। গত সেপ্টেম্বর মাসে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে চলমান উত্তেজনা তিন পার্বত্য জেলায় ভয়াবহ দাঙ্গায় রূপ নেয়।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের শরিকরা ছাড়া অন্য সব দল রাজনৈতিক মাঠে সক্রিয় রয়েছে। বিএনপি ও জামায়াতের অবস্থান ও কর্মসূচি বেশ দৃশ্যমান। তবে সরকার গঠনের এক মাসের মধ্যেই প্রধান কয়েকটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে নানা বিষয় নিয়ে মতবিরোধ দেখা দিচ্ছে। সংস্কার কাজের জন্য সরকারকে বেশি সময় দেয়ার ব্যাপারে নমনীয় অবস্থানে জামায়াতে ইসলামী। আর নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়েছে বিএনপি।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য