-->

ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে ডেঙ্গু

বৃষ্টি ও উচ্চ আর্দ্রতায় বেড়েছে এডিসের প্রজনন

শিপংকর শীল
ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে ডেঙ্গু

বৃষ্টিতে বেড়েছে ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশার প্রজনন। ফলে অব্যাহত রয়েছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা। ডেঙ্গুরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, থেমে থেমে বৃষ্টি ও উচ্চ আর্দ্রতা ডেঙ্গু ভাইরাসের পরিচিত বাহক এডিস মশার প্রজননের জন্য খুবই উপযোগী। এ ধরনের আবহাওয়া তাদের কামড়ানোর প্রবণতাও বাড়িয়ে দেয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর চলতি সেপ্টেম্বর মাসে বছরের আগের আট মাসের চেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হয়েছে। ওই মাসে ২১ হাজার ৫৯৭ জন রোগী ভর্তির পাশাপাশি মৃত্যু হয়েছে ৯৪ জনের। অক্টোবরের প্রথমদিন ৬৫২১ জন রোগী ভর্তি হয়েছে, মৃত্যু ২৭ জনের। এর আগে জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ১ হাজার ৫৫ জন, যাদের মধ্যে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয় ৩৩৯ জন, যাদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে তিনজনের। মার্চ মাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৩১১ জন; যাদের মধ্যে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এপ্রিল মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫০৪ জন, যাদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে দুইজনের। মে মাসে ৬৪৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের। জুন মাসে ৭৯৮ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, মৃত্যু হয়েছে ৮ জনের। জুলাই মাসে ২৬৬৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়, তাদের মধ্যে ১২ জনের মৃত্যু হয়। আগস্টে ৬৫২১ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল, যাদের মধ্যে ২৭ জনের মৃত্যু হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি বছর দেশজুড়ে বেশি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। পাশাপাশি তাপমাত্রার তীব্রতাও বেড়েছে। বৃষ্টি হওয়ার কয়েকদিন পর দেখা দিচ্ছে রোদেলা দিন এবং তাপমাত্রার খরতাপ। অলিগলি ও রাস্তার খানাখন্দে জমে থাকা পানি শুকিয়ে যাওয়ার আগেই আবার নেমে আসে বৃষ্টি। ফলে অনেক জায়গায় বৃষ্টির পানি অনেকটা স্থায়ী জলাবদ্ধতায় রূপ নিচ্ছে। এডিস মশার প্রজননের জন্য এমন পরিবেশ বেশ অনুকূল। গত কয়েক মাস ধরে সারাদেশে বিশেষ করে রাজধানীতে পরাদ-বৃষ্টির পাল্টাপাল্টি লুকোচুরি খেলা এডিস মশার প্রজনন বাড়িয়ে দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের কীটতত্ত্ববিদ ও গবেষক অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার ভোরের আকাশকে বলেন, গত ২৫ বছরে ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ প্রায় ৩০ গুণ বেড়েছে। সংক্রমণ প্রধানত উষ্ণ এবং আর্দ্র জলবায়ুযুক্ত গ্রীষ্মমণলীয় অঞ্চলে প্রকট। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘন ঘন ভ্রমণ ক্রমবর্ধমান ডেঙ্গু জ্বর সংক্রমণকে ত্বরান্বিত করে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, বিশ্বব্যাপী ডেঙ্গুর ভৌগোলিক বিস্তার বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। কারণ বৈশ্বিক উষ্ণতা মশার প্রজনন ও রোগ বিস্তারের জন্য আরও অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে এবং করবে। তিনি বলেন, ডেঙ্গু ভাইরাসের সংক্রমণ বিভিন্ন কারণে জলবায়ু সংবেদনশীল। প্রথমত, তাপমাত্রার পরিবর্তন ভেক্টরের প্রজনন হার, কামড়ের হার, ভাইরাসের ইনকিউবেশনের সময় পরিবর্তন, ভেক্টরের ভৌগোলিক পরিসর বা বিস্তার পরিবর্তন করে এবং ভেক্টর-ভাইরাস-হোস্ট সম্পর্ক বৃদ্ধি বা হ্রাস করে ভেক্টরবাহিত রোগ সংক্রমণ এবং মহামারি সম্ভাব্যতাকে প্রভাবিত করে।

অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার আরও বলেন, বৃষ্টিপাত প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী মশার ঘনত্বকে প্রভাবিত করে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রজনন স্থানের বৃদ্ধি ঘটায় যার ফলে মশার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী মশার সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে এটি সহজেই ভাইরাস প্রাপ্ত হওয়া এবং সংক্রমণ ছড়িয়ে দেওয়ার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তোলে। ডেঙ্গু হেমোরেজিক প্রাদুর্ভাবের একটি স্বতন্ত্র মৌসুমি প্যাটার্ন পৃথিবীর বেশিরভাগ জায়গায় স্পষ্ট। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের দেশগুলো যেখানে দীর্ঘসময় বর্ষাকাল থাকে সেখানে বর্ষাকালে ডেঙ্গু রোগ বৃদ্ধি পায় এবং বৃষ্টি বন্ধ হওয়ার কয়েক মাস পরে কমে আসে। বৃষ্টি বা বর্ষার সঙ্গে ডেঙ্গুর বাহক মশার প্রজনন হার বা দীর্ঘায়ু হ্রাস অথবা তার কামড়ানোর ক্ষমতার পরিবর্তিত হতে পারে। তবে বাংলাদেশে ডেঙ্গু যে শুধুমাত্র বৃষ্টিপাতের ওপরই নির্ভর করে তা নয়। বৃষ্টিপাত প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী মশার ঘনত্বকে প্রভাবিত করে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রজনন স্থানের বৃদ্ধি ঘটায় যার ফলে মশার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন, ডেঙ্গুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, এ বছর বেশি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। যেখানে সেখানে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। এবার ডেঙ্গু বাড়ার মূল কারণ থেমে থেমে এবং বিক্ষিপ্তভাবে বৃষ্টি হওয়া। এভাবে বৃষ্টি হলে পানি যেখানে-সেখানে জমে থাকছে। আর এসব জমে থাকা পানিতেই মশার প্রজনন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃষ্টির সচ্ছ পানিতে ডিম দিচ্ছে এডিস মশা। ফলে আবারো বৃদ্ধি পাচ্ছে ডেঙ্গু রোগী। ডাবের খোসা, পরিত্যাক্ত পাত্র কিংবা রাস্তার পাশে জমে থাকা পানিতে এডিস মশা ডিম পারছে। এসব স্থান থেকে ডেঙ্গু মশাগুলো বাসাবাড়িতে যাচ্ছে। আর এতেই বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ।

ডা. আব্দুল্লাহ বলেন, বিশেষ করে বর্ষাকালে ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ বিগত কয়েক বছর ধরেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাংলাদেশের নগরে বিভিন্ন স্থানে পানি সংকট থাকার কারণে জনগণ তার বাথরুমে অথবা টয়লেটে পানি জমিয়ে রাখে। এছাড়া শীতকালে বাংলাদেশে নির্মাণ কাজ বেড়ে যাওয়ায় নির্মাণাধীন ভবনে পানির ব্যবহার ডেঙ্গুর বাহক মশার প্রজননকে বাড়িয়ে তোলে। যেহেতু মশার ডিম, লার্ভা এবং পিউপা বেড়ে ওঠার জন্য পানি প্রয়োজন তাই পানি, বৃষ্টি বা বর্ষা মশার প্রজননের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্ষাকালে বাংলাদেশ ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি হলেও শীতকালেও এখন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। মশার জীবনচক্র তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতার উপরে অনেকটা নির্ভরশীল। বর্ষাকালে যেহেতু তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা উপযোগী থাকে তাই এই সময়ে মশার প্রজনন এবং বেঁচে থাকা খুব সহজ হয়।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য

Beta version