-->

শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন সম্ভব?

টাইম ম্যাগাজিনের বিশ্লেষণ

ভোরের আকাশ ডেস্ক
শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন সম্ভব?

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার পতনের পর দেশ ছেড়েছেন তার দল আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মীও। দেশে গ্রেপ্তার হয়েছেন অনেকে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার দায়িত্ব গ্রহণের পর বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা আবারও রাজনীতিতে ফিরবেন কিনা বা ফিরলেও কীভাবে ফিরবেন?

শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি নিয়ে ‘কীভাবে অসম্ভব প্রত্যাবর্তন ঘটাতে পারেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’ শিরোনামে বিস্তারিত প্রতিবেদন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ মাধ্যম টাইম ম্যাগাজিন। গত ৩ অক্টোবর বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে জানিয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার অচল হয়ে পড়লে যে হাসিনার প্রত্যাবর্তনের সুযোগ বাড়বে, সে বিষয়ে সবাই একমত। রাজনীতি বিশ্লেষক জিল্লুুর রহমানের মতে, আগামী দশকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে হাসিনা ও তার দলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কোনো সুযোগ নেই। তবে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাপকভাবে ব্যর্থ হলে এই প্রেক্ষাপট বদলে যেতে পারে।

শেখ হাসিনা পরবর্তী রাজনীতি: শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর কয়েক সপ্তাহ রাজনীতি ও নিরাপত্তাশূন্যতা তৈরি হয়েছিল। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আওয়ামী লীগের লোকজনদের সরানো হয়েছে, অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হাজারো পুলিশ সদস্য আত্মগোপনে চলে গেছেন, যাতে জনরোষের শিকার না হন (অন্তত ৪৪ জন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন)। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেত্রী খালেদা জিয়া মুক্তি পেয়েছেন। দেশের প্রধান ইসলামপন্থি দল জামায়াতে ইসলামীর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে। তাই দেশ কোন দিকে যাবে, তা নিয়ে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। ৩১ সেপ্টেম্বর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) সরকারের পক্ষ থেকে পাঠ্যবই পর্যালোচনা করার জন্য গঠিত একটি কমিটি বিলুপ্তির সিদ্ধান্তকে ইসলামী মৌলবাদীদের সঙ্গে ‘গুরুতর এবং বিপজ্জনক’ আপস হিসেবে বর্ণনা করেছে। এর জবাবে, ইসলামী সংগঠন হেফাজতে ইসলামের নেতারা এসব উদ্বেগকে ‘ফ্যাসিবাদী’ বলে নিন্দা জানিয়েছেন।

শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা: সংস্কারপন্থিদের আশঙ্কা দেশকে দ্রুত সংস্কারের দিকে নিয়ে যেতে না পারলে আওয়ামী লীগ আমলের এসব দুর্নীতির স্মৃতি সাধারণ মানুষের স্মৃতি থেকে ফিকে হতে শুরু করতে পারে। তাই শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিতে পারছেন না উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান। তিনি বলেন, হাসিনার প্রত্যাবর্তন বেশ সম্ভব। দক্ষিণ এশিয়ার পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিহাস ঘাঁটুন। দেখবেন, পরিবারতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোকে দেউলিয়া মনে হলেও এ দলগুলোকে একেবারে বাতিলের খাতায় ফেলতে পারবেন না।

তবে অন্য পর্যবেক্ষকরা হাসিনার প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে কুগেলম্যানের মতো এত আত্মবিশ্বাসী নন। নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি গবেষক মুবাশ্বার হাসান বলেন, সারা বাংলাদেশে হাসিনার পোস্টার ছেঁড়া হয়েছে, বিকৃত করা হয়েছে। তাকে স্বৈরাচারী দেখিয়ে গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে। তরুণ প্রজন্ম শেখ হাসিনার লিগ্যাসিকে এভাবেই দেখছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম যদি স্থবির হয়ে পড়ে, তাহলে যে হাসিনার প্রত্যাবর্তনের সুযোগ বাড়বে, সে বিষয়ে সবাই একমত।

ঢাকাভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুুর রহমানের মতে, আগামী দশকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে হাসিনা ও তার দলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কোনো সুযোগ নেই। তবে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাপকভাবে ব্যর্থ হলে এই প্রেক্ষাপট বদলে যেতে পারে।

আর ব্যাপক রাজনৈতিকীকরণ হওয়া আমলাতন্ত্র আদতেই সংস্কার বাধাগ্রস্ত করতে চেষ্টা করছে বলে উল্লেুখ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল শহিদুল হক বলেন, সংস্কারে বাধা দিতে হেন প্রচেষ্টা নেই, যা এই প্রশাসন করছে না। তারা এই সরকারকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। আর দৃশ্যমান কোনো উন্নতি না হলে মানুষ ধৈর্য্য হারাবে।

পুরোপুরি ভেঙে পড়েনি বাংলাদেশ: শেখ হাসিনার পতনের পর পুলিশ ও সংখ্যালঘুদের ওপর ব্যাপক হামলার অভিযোগ উঠলেও বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের উপ-পরিচালক মিনাক্ষী গাঙ্গুলো বলেন, কোনো দাঙ্গা হয়নি। আমরা সাম্প্রতিক সময়ে বড় আকারের আক্রমণ দেখিনি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি ভেঙে পড়েনি। এই পরিস্থিতিতে অন্যতম খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্তর্বর্তী সরকারের আইনগত অবস্থা অস্পষ্ট হওয়ায় মার্কিন সমর্থন আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন সমর্থনের গুরুত্ব বোঝা গেছে গত মাসে প্রেসিডেন্ট জো-বাইডেনের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে ইউনূসের সাক্ষাতের মাধ্যমে। মার্কিন সমর্থন অন্তর্বর্তী সরকারের স্থিতিশীলতার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর।

সমর্থন ধরে রাখা আওয়ামী লীগের বড় চ্যালেঞ্জ: যদিও জয় শেখ হাসিনার দমন-পীড়নের কিছু ভুল স্বীকার করেছেন এবং মৃতের সংখ্যা নিয়েও তর্ক করছেন না। তবে তিনি জোর দিয়ে দাবি করছেন, অন্তত অর্ধেক হত্যাকাণ্ড ‘জঙ্গিরা’ ঘটিয়েছে; যারা সম্ভবত ‘বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা’ থেকে অস্ত্র পেয়েছিল। এছাড়া রাষ্ট্রীয় অর্থ লুটপাটের জন্য আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বাড়ছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির তথ্য বলছে, হাসিনার শাসনের ১৫ বছরে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও ব্যবসায়ীরা প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলার দেশের বাইরে পাচার করেছেন।

আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে ‘গণহত্যা’ এবং ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ এর অভিযোগ প্রমাণিত হলে দলটিকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন অনেকেই। এ দাবি জয়ের কাছে হাস্যকর মনে হয়েছে। টাইমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন এবং বৃহত্তম রাজনৈতিক দলকে কীভাবে নিষিদ্ধ করবেন? এটি আইনিভাবে সম্ভব নয়।

আওয়ামী লীগ নিয়ে অনিশ্চয়তা: জিল্লুুর রহমান বলেন, আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হল শেখ হাসিনাকে কাল্ট চরিত্র হিসেবে দাঁড় করানো। তারা (আন্দোলনকারীরা) শেখ মুজিবের কন্যার বিকল্প ভাবতেও পারে না। শেখ হাসিনার বিকল্প জয় হতে পারবেন কিনাÑ এমন প্রশ্নের জবাবে জিল্লুুর রহমান বলেন, তিনি যদি বাংলাদেশের জনগণের নেতা হিসেবে নিজেকে নতুন করে গড়ে তুলতে না পারেন, তাহলে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নেই। তার এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত গবেষক মুবাশ্বার হাসান। তিনি বলেন, তরুণদের মধ্যে তার (জয়) প্রতি শ্রদ্ধা ও আকর্ষণ নেই। আর মানুষের মতামত গুরুত্বপূর্ণ। তবে জয় জানান, তিনি এখনও সিদ্ধান্ত নেননি রাজনীতিতে আসবেন কি না। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আমার কখনও রাজনৈতিক উচ্চাকাক্সক্ষা ছিল না। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায়, কে জানে? আমি এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য

Beta version