- ১৯১ মামলা হত্যার অভিযোগে ১৭০টি
- ট্রাইব্যুনালে ৩১ অভিযোগ
- ট্রাইব্যুনাল মেরামত করতে সময় লাগবে ৩-৪ মাস
- কাজ শুরু করেছে প্রসিকিউশন
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন পরবর্তী সময়ে রূপ নেয় এক দফায়। সেই আন্দোলন ঠেকাতে সর্বোচ্চ শক্তি ব্যয় করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। পুরো এই আন্দোলনে হাজারের বেশি মানুষ নিহত হন, যাদের বেশির ভাগ মারা গেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গুলিতে। আর এসব হত্যাকাণ্ডের প্রধান নির্দেশদাতা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার নির্দেশেই অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করা হয় এবং দীর্ঘ হয় লাশের মিছিল। ছাত্র-জনতার এই আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। টানা চার মেয়াদ ধরে ক্ষমতা ধরে রাখা শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। শেখ হাসিনা ও তার দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এসব হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে প্রায় দুশো মামলা ইতোমধ্যে করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩১টি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিচারে শেখ হাসিনার গঠন করা আদালতেই তার বিচারের প্রস্তুতি নিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের কাজ অনেকটা এগিয়ে গেছে। যে আদালতে বিচারকাজ পরিচালিত হবে সেই আদালতের অবকাঠামোর কিছু কাজ বাকি আছে। সেই কাজ এখন চলছে পুরোদমে। শিগগির আদালত প্রস্তুত হলে শুরু হবে গণহত্যার বিচারকাজ। শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেও বিচারকাজ শুরু হলে আদালতের নির্দেশ পেলে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে অন্তর্বর্তী সরকার। সেই প্রস্তুতিও নেয়া হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অবস্থিত সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্টে বিভাগের পুরাতন বিল্ডিংয়ে। এই ভবনটি অনেক পুরনো। বৃষ্টি হলে এজলাসে পানি পড়ে। কয়েকবার জোড়াতালি দিয়েও সে পানি পড়া বন্ধ করা যায়নি। পরবর্তী সময়ে বিচারকাজ পরিচালনার জন্য নির্মাণ করা হয় টিনশেট ঘর। সেই বিল্ডিং মেরামতে নজর দিয়েছে সরকার। গত ৩ অক্টোবর সেখানে পরিদর্শন করেছেন গণপূর্ত বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী। আগামী ৩-৪ মাসের মধ্যে এই বিল্ডিংয়ের কাজ শেষ করা যাবে বলে জানিয়েছেন গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার। ওইদিন গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী এবং স্থাপত্য অধিদপ্তরের প্রধান স্থপতিসহ একটি প্রতিনিধি দল ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে আসে। চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা তাদের ঘুরে দেখান। পরে প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার সাংবাদিকদের বলেন, এখন এটিকে (ভবন) ব্যবহার উপযোগী করতে হবে। ব্যবহার উপযোগী করতে গেলে যা যা করণীয়, তাই করা হবে। তিনি বলেন, আশা করছি খুব দ্রুতই, তিন থেকে চার মাসের মধ্যে করা সম্ভব হবে। পুরো ভবন এবং আনুষঙ্গিক টিনশেডে যে কাঠামো আছে, পুরোটাই ঠিক করে দেয়া হবে।
এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বিস্তারিত জানান চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, এখানে বিচারকার্য পরিচালনার জন্য এজলাসসহ আনুষঙ্গিক যেসব সুবিধা দরকার, সেটি এই ভবনে আগে থেকে করা ছিল। অতি প্রাচীন হওয়ার কারণে এর বিভিন্ন জায়গায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এসব কারণে একটা সময়ে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে।
বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাকে জানানো হয় উল্লেখ করে তাজুল ইসলাম বলেন, পূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা তাৎক্ষণিকভাবে প্রধান প্রকৌশলীসহ তাদের টিমকে বুধবার ডেকে এই কোর্ট রুম, এ ভবনটাকে ব্যবহার উপযোগী করতে যত দ্রুত সম্ভব কাজ করার জন্য প্রকৌশলীদের নির্দেশ দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ত মন্ত্রণালয়ের পুরো টিম এসে দেখেছে।
এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে দেশব্যাপী হত্যা ও গণহত্যার অভিযোগ এনে মামলা হয়েছে ১৯১টি। এর মধ্যে হত্যা মামলা ১৭০টি। শুধু তিনিই নন, এসব মামলার আসামি হয়েছেন তার দলের অনেক শীর্ষ নেতারা। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যা ও গণহত্যার মোট ৩১টি পৃথক অভিযোগ করা হয়েছে। এরমধ্যে ১৩টি চিফ প্রসিকিউটর বরাবর, বাকিগুলো দাখিল করা হয়েছে তদন্ত সংস্থায়। শেখ হাসিনাসহ গণহত্যায় যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে বিচারকাজ দ্রুত করার জন্য ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চিফ প্রসিকিউটর ও চারজন প্রসিকিউটর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। বাকি চারজন হলেন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মিজানুল ইসলাম, গাজী এমএইচ তামিম, বি এম সুলতান মাহমুদ ও আবদুল্লাহ আল নোমান।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস অ্যাক্ট ১৯৭৩-এর ৮ (১) ধারা মতে, ২০১০ সালের ২৫ মার্চ তদন্ত সংস্থা গঠিত হয়। ২০১১ সাল ও সর্বশেষ ২০২৩ সালে পুনর্গঠিত তদন্ত সংস্থা তদন্ত কাজ পরিচালনা করে ২০২৩ সালের ৫ মে পর্যন্ত। ওইদিন পর্যন্ত ৮৮টি মামলায় ৩২৫ জনের বিরুদ্ধে তদন্তসম্পন্ন করা হয়েছে। এরমধ্যে ৫২টি মামলায় ১৩৮ জনের বিরুদ্ধে বিচারকার্য সম্পন্ন হয়েছে। ৯৩ জনের বিরুদ্ধে প্রাণদণ্ডাদেশ, ৩৬ জনের বিরুদ্ধে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দেয়া হয় এবং ছয়জনের ২০ বছরের সাজা দেয়া হয়। দুজন খালাস এবং একজনের আদেশে নিষ্পত্তি হয়েছে। ছয়জনের প্রাণদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহারের একটি বিষয় ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচার। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ সরকার। ১৯৭৩ সালে প্রণীত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের অধীনেই অভিযুক্তদের তদন্ত এবং বিচারের উদ্যোগ নেয়া হয়। মূলত ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের বাংলাদেশে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্যই এই আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছিল। ২০০৯ সালে সংসদ অধিবেশনে ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার’ বিষয়ে একটি মৌখিক প্রস্তাব পাস হয়। তবে ২০১০ সালের আগে আইনে কারো বিচার বা সাজা হয়নি। পরবর্তী সময়ে ট্রাইব্যুনালে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকেও বিচারের আওতায় আনা এবং স্বাধীনভাবে ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ পরিচালনার বিধান যুক্ত করে আইনে কিছু সংশোধনী আনা হয়। এর মাধ্যমেই ২০১০ সালে ট্রাইব্যুনাল, আইনজীবী প্যানেল এবং তদন্ত সংস্থা গঠন করা হয়।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য