শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর জনসাধারণের প্রত্যাশা ছিল পণ্যের লাগামছাড়া দাম কমবে। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। অন্তর্বর্তী সরকারের দুই মাস পরও বাজারে সব পণ্যের দাম আকাশচুম্বী। বিশেষ করে ডিমের বাজারে যেন আগুন লেগেছে। কোনোভাবে ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণে আসছে না। যদিও এরই মধ্যে বিদেশ থেকে ডিম আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে। শুল্ক প্রত্যাহারেরও প্রক্রিয়াও চলমান। ডিমের বাজারে সংকটের কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীদের দাবি, ডিমের উৎপাদন চাহিদার চেয়ে কম। যদিও সরকার বলছে, উদ্বৃত্ত রয়েছে। এ অবস্থায় বাজার বিশ্লেষকরা মনে করেন, চাহিদা ও উৎপাদনের তথ্যে এমন অসামঞ্জস্যতা এ সংকটের একটি বড় কারণ।
দেশে প্রতিদিন পাঁচ কোটি পিস ডিমের চাহিদা রয়েছে। সেখানে এখন উৎপাদন কমে চার কোটির নীচে নেমেছে এমন দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর (ডিএলএস) বলছে, বন্যার আগে এই উৎপাদন ছিল ৬ কোটি ৩০ লাখ পিস। বন্যার পর কিছুটা কমলেও এখনো চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি আছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের বাৎসরিক তথ্যানুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে ডিমের চাহিদা ছিল ১ হাজার ৮০৯ কোটি ৬০ লাখ পিস। বিপরীতে উৎপাদন হয় ২ হাজার ৩৭৪ কোটি ৯৭ লাখ। উদ্বৃত্ত থাকে ৫৬৫ কোটি ৩৭ লাখ পিস ডিম। ২০২২-২৩ অর্থবছরে চাহিদা ছিল ১ হাজার ৮০৬ কোটি ৪৮ লাখ, উৎপাদন হয়েছে ২ হাজার ৩৩৭ কোটি ৬৩ লাখ পিস। সে হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল ৫৩১ কোটি ১৫ লাখ পিস।
বিক্রেতারা বলছেন, বাজারে ডিমের সরবরাহে ঘাটতি রয়েছে। অর্থাৎ বাজারে ডিমের যে চাহিদা রয়েছে, তার চেয়ে কম ডিম বাজারে আসছে। মূলত এ কারণেই দাম বেড়েছে। চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হলেও দাম নিয়ন্ত্রণহীন হওয়ার পেছনে বাজার ব্যবস্থাপনার বড় সমস্যা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তাই সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে মনিটরিং জোরদারের পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোলট্রি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. বাপন দে বলেন, আসলে চাহিদা উৎপাদনের পরিষ্কার তথ্য থাকা দরকার। সেটা না হলে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা সম্ভব না। ডিমসহ অনেক পণ্যের ক্ষেত্রে তা নেই। তিনি বলেন, আবার আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক না। ছয়-সাতবার ডিম হাতবদল হচ্ছে। আর প্রতিজনই লাভ নিচ্ছেন। ফলে উৎপাদনকারী কম লাভ পাচ্ছেন, কিন্তু ভোক্তা পর্যায়ে দাম বেড়ে যাচ্ছে। এজন্য সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে বাজার মনিটরিং জোরদার করা প্রয়োজন।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ রেয়াজুল হক বলেন, বাজারে মাছ, সবজির সরবরাহ কম, দামও চড়া। এ কারণে ডিমের ওপর একটা বাড়তি চাপ বেড়েছে, বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের ডিমের উৎপাদন এখনো চাহিদার চেয়ে বেশি, যে কারণে আমরা আমদানি না করার বিষয়ে মত দিয়েছিলাম। তবে আমাদের ডিমের উৎপাদন আরও এক কোটি পিস বাড়ানো দরকার। এদিকে, আমদানির খবরে বাজারে ডিমের দাম কমলেও এখনো প্রতি ডজন ডিম ১৬৫-১৭৫ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। যা এখনো সরকার বেঁধে দেয়া দামের চেয়ে বেশি। গত সপ্তাহে ডিমের দাম ডজন প্রতি ১৮০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, অপ্রত্যাশিত বন্যায় এখনো সেভাবে শীতকালীন সবজি আসেনি। মাছের দাম বেশি। এ কারণে ডিমের চাহিদা বেশি, দামও বেড়েছে। বৃষ্টি পরিস্থিতি কেটে গেলে যখন শীতের সবজিগুলো বাজারে আসতে থাকবে তখনই ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। বিগত সরকার কয়েক বছর ধরেই ডিমের উৎপাদন বেশি বলে প্রচার করে আসছে। তবুও মাঝে-মধ্যেই ডিমের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। সরকারি হিসাবে প্রায় ৮০ লাখ পিস চাহিদার বেশি উৎপাদন এবং বেসরকারি হিসাবে প্রতিদিনের চাহিদার তুলনায় অন্তত এক কোটি পিস কম ডিম উৎপাদন হচ্ছে। তবে যত দ্রুত সম্ভব স্থানীয়ভাবে উৎপাদন বাড়িয়ে সরবরাহ স্বাভাবিক করার বিকল্প নেই বলেই জানান উৎপাদন সংশ্লিষ্টরা।
প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার বলেন, বন্যায় হাজার হাজার খামার একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে ডিমের সরবরাহ কমেছে। কিন্তু এ সময় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো ডিমের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে বলে বাজারে অস্থিরতা। তাদের সুবিধা দিতে সরকার এখনো এ খাতে উৎপাদন কমার বিষয়টি গোপন করছে। তিনি বলেন, তারপরও আমদানি করে করে সবার ক্ষতি না করে সরকারের উচিত করপোরেট কোম্পানিগুলোকে ধরা এবং ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের পুনরায় উৎপাদনে ফিরিয়ে আনা। এই খামারির দাবি, প্রান্তিক খামারি ডিম এবং মুরগি উৎপাদন করে, কিন্তু দাম নির্ধারণ করতে পারে না। দাম নির্ধারণ করে করপোরেট গ্রুপ ও তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতি। তাদের সুবিধামতো যে দাম নির্ধারণ করে সে দামে প্রান্তিক খামারিদের ডিম, মুরগি বিক্রয় করতে হয়। উৎপাদন কম বা বেশি যাই হোক। তিনি আরও বলেন, কোম্পানিগুলো বারবার বাজারে সিন্ডিকেট করে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে নিলেও তাদের শাস্তি না হওয়ায় বাজারে অস্থিরতা বেড়েই চলছে।
এদিকে, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর দক্ষিন-পূর্বাঞ্চলের বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির সর্বশেষ হিসাব তৈরি করেছে গত ৭ অক্টোবর। সে হিসাবে উঠে এসেছে, দক্ষিন-পূর্বাঞ্চল ও ময়মনসিংহ বিভাগসহ মোট ক্ষতিগ্রস্ত জেলার সংখ্যা ১৯টি। এসব জেলায় ৫ হাজার ৯১৯টি খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেখান থেকে প্রায় ৫০ লাখ পিস ডিমের উৎপাদন কমেছে।
বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে ডিমের উৎপাদনের ১৩.৯৬ শতাংশ বা ৬০ লাখ পিস সরবরাহ করে বড় প্রতিষ্ঠান এবং বাকি ৮৬.০৪ শতাংশ সরবরাহ আসে ক্ষুদ্র খামারি থেকে। এ হিসাব করা হয়েছে বন্যার আগের প্রতিদিনের সাড়ে ৪ কোটি পিস উৎপাদনের তথ্য থেকে। পরিস্থিতি বিবেচনায় অন্তর্বর্তী সরকার সাতটি প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে চার কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছে। এছাড়া বাজারে ডিমের দাম কমাতে ডিম আমদানির ওপর থাকা শুল্ক-কর সাময়িকভাবে প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের কাছে লেখা এক চিঠিতে ডিম আমদানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান শুল্ক-কর প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়েছে ট্যারিফ কমিশন।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য