-->

পোশাক খাতে অস্থিরতা

কার ক্ষতি, কার লাভ

সিরাজুল ইসলাম
পোশাক খাতে অস্থিরতা

যেকোনো আন্দোলন-সংগ্রামের প্রথম প্রভাব পড়ে তৈরি পোশাক খাতে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরুতেই এ খাতে অস্থিরতা তৈরি হয়। এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায় বেশ কিছু কারখানা। আন্দোলন দমাতে সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দিলে সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বাংলাদেশ। এ অবস্থাতে কিছু ওয়ার্ক অর্ডারও বাতিল হয়। যদিও পরে বিদেশি ক্রেতারা পোশাক নেয়ার আশ্বাস দেয়। কিন্তু ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বিভিন্ন দাবিতে টানা বেশ কয়েকদিন বিক্ষোভ করেন পোশাক শ্রমিকরা। এতে উৎপাদন ব্যাহত হয়। এর প্রভাব পড়েছে এ খাতে। বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ক্যাম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, ভারত, পাকিস্তান ও মিয়ানমারসহ বেশ কিছু দেশ লাভবান হচ্ছে। ওয়ার্ক অর্ডারের ২০-৩০ শতাংশ ওইসব দেশে চলে যাচ্ছে। এটাকে গভীর সংকট হিসেবে দেখছেন এ খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও অর্থনীতিবিদরা। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বকেয়া; ঝুট ব্যবসা নিয়ে দ্বন্দ্ব; বহিরাগতদের উসকানি এবং বিদেশি শক্তির ষড়যন্ত্রের কারণে এই খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করেন মালিক, শ্রমিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

পোশাক খাতের অন্যতম উদ্যোক্তা এবং বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি রুবানা হক বলেন, ক্রেতারা জানেন- ফ্যাক্টরিগুলো বন্ধ হচ্ছে। কাজেই সহজভাবে স্বচ্ছভাবে সমস্যাগুলো যদি আমরা তুলে ধরতে পারি এবং বোঝাতে পারি যে এর পেছনে আরো অনেক কিছু কাজ করছে। তাহলে সবাই মিলে কিন্তু সমবেতভাবে একটা সমাধানের দিকে যাওয়া যায়।

বিজিএমইএ’র ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আব্দুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, সরকারকে আরো একটু কঠোর ভূমিকা পালন করা উচিত। তারাও হয়তো চেষ্টা করছেন। অর্ডারগুলো যেগুলো বিলম্ব হচ্ছে সেগুলো এয়ার শিপমেন্ট করতে হবে, ডিসকাউন্ট দিতে হবে, কাস্টমারের ক্ষতি হবে। কাস্টমারের মাইন্ডসেট বা ডিসিশনে চেঞ্জ আনতে পারে।

অন্তর্বর্তী সরকারের শ্রমবিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, শ্রমিকদের দাবি মেনে নিয়ে সরকার কাজ শুরু করেছে। আঠারো দফা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। যেসব কারখানায় বকেয়া বেতন রয়েছে; সেখানে প্রয়োজনে সরকার ঋণ দিয়ে বেতন-ভাতা পরিশোধের ব্যবস্থা নিচ্ছে। সর্বোচ্চ কনসালটেশনের মাধ্যমে এই সমস্যাগুলো সমাধান করতে চাই।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন, আসলে ক্ষতি অনেক বড়ই বলতে হবে। এই মুহূর্তে আমাদের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে সব সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে- রপ্তানি ও রেমিট্যান্স।

জানা গেছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সরকার পতন এবং শ্রমিক অসন্তোষের জেরে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশের একটা অংশ প্রতিবেশী ভারতসহ বিভিন্ন দেশের বাজারে চলে গেছে। এতে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতিকে দেশের সবচে বড় রপ্তানি খাতের জন্য গভীর সংকট হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ক্রেতা এবং বাংলাদেশের পোশাক কারখানার মধ্যে মধ্যস্থতাকারী একটি প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, সময়মতো শিপমেন্ট করতে না পারায় তাদের একটি ক্রেতার ৯০ শতাংশ ক্রয়াদেশ ভারতে চলে গেছে। ‘নো এক্সিট’ নামের ওই প্রতিষ্ঠানের একজন পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ জাকির বলেন, পরিস্থিতি ভালো হলে ক্রেতারা আবার ফিরতে পারেন। আমার অনেকগুলো অর্ডার ইন্ডিয়াতে প্লেস হয়ে গেছে। যে কাস্টমার আমার এখানেই কাজ করতো; তার অর্ডারগুলো সে ইন্ডিয়াতে প্লেস করেছে শিপমেন্ট ও ডেলিভারি ইস্যুর কারণে। আমরা যদি পরিস্থিতি উন্নয়ন করতে পারি ক্রেতারা আবার ফিরে আসবে।

সূত্র জানায়, বড় বড় পোশাক কারখানা গড়ে উঠেছে- এমন এলাকাগুলোর মধ্যে আশুলিয়া, সাভার ও গাজীপুর এলাকায় সমস্যা সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে। শ্রমিক অসন্তোষ এবং উত্তেজনার এক পর্যায়ে যৌথ বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে একজন শ্রমিক নিহত হয়েছে। ক্রমাগত পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে বলা হলেও তা পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি রুবানা হক বর্তমান পরিস্থিতিকে পোশাক খাতের জন্য একটা বড় ধাক্কা হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, ১২ থেকে ১৫ দিন প্রচুর ফ্যাক্টরি বন্ধ থেকেছে। একেবারে বন্ধ। কেউ কেউ আবার দুপুর পর্যন্ত চালাতে পেরেছেন; এরপর পারেননি। এগুলোতো পুরাটাই লস। আর এর চাইতে বড় লস যেটা হচ্ছে সেটা হলো- আমাদের যারা ক্রেতা তারা তো সরে যাচ্ছেন। তারা বলছেন- আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি, বাংলাদেশকে লাগবে, সবই বলছেন; কিন্তু আমরাতো এটার বাস্তবতাটা জানি। বাস্তবতাটা হলো অন্তত শতকরা ২৫-৩০ ভাগ অর্ডার ডিসেম্বরের মধ্যে সরে যাবে। বিভিন্ন দেশে চলে যাচ্ছে। ক্যাম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, ভারত, পাকিস্তান- এমনকি মিয়ানমারে চলে যাচ্ছে। তিনি বলেন, যখন আপনি সাহস করে কোনো একটা সত্যি কথা বলতে যাবেন; নানা দিক থেকে নানাভাবে আপনার ওপরে সবাই চড়াও হবে। বলবে এটা না বললেই পারতেন। কিন্তু এটা না বললেও কিন্তু ক্রেতারা জানেন যে ফ্যাক্টরিগুলো বন্ধ হচ্ছে। কাজেই সহজভাবে স্বচ্ছভাবে আমাদের সমস্যাগুলো যদি আমরা তুলে ধরতে পারি এবং বোঝাতে পারি যে এর পেছনে আরো অনেক কিছু কাজ করছে। তাহলে সবাই মিলে সমবেতভাবে একটা সমাধানের দিকে যাওয়া যায়।

শ্রমিক অসন্তোষের নেপথ্যে: সরকার পতনের পর পোশাক খাতে এক ধরনের অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই আশুলিয়া, সাভার এলাকায় গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলনের খবর পাওয়া যাচ্ছে। কারখানা বন্ধ থাকায় একটা বড় সময় ব্যাহত হয়েছে উৎপাদন। সময়মতো পাঠানো যায়নি পণ্য; যার বিরূপ প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন সবাই। বাংলাদেশে পোশাক খাতে অস্থিরতার একাধিক কারণ সামনে আসছে। এর মধ্যে ঝুট ব্যবসা নিয়ে দ্বন্দ্ব; মালিকানার সমস্যা; বকেয়া পাওনা; কিছু ক্ষেত্রে বহিরাগতদের উসকানি এবং শ্রমিকদের নতুন কিছু দাবি দাওয়া।

আশুলিয়া এলাকায় শ্রমিক সংগঠনের একজন নেতা মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, আগের সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যবসায়ী এবং রাজনৈতিক নেতাদের ফ্যাক্টরিতে যেমন সমস্যা হয়েছে, তেমনি পাঁচই আগস্টের পর সুযোগ পেয়ে শ্রমিকরাও নানা দাবি নিয়ে মাঠে নামে। এ আন্দোলনটা শুরু হয় নারী-পুরুষ সমহারে চাকরির দাবিতে। আপনারা জানেন যে ত্রিশটার ওপরে দাবি আসছে। একেক কারখানার একেক দাবি। বাংলাদেশ ন্যাশনাল লেবার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মরিয়ম আক্তার মনে করেন শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টির নেপথ্যে বহিরাগত একটা প্রভাব কাজ করেছে। তিনি বলেন, ঝুট ব্যবসা নিয়ে একটা সমস্যা আছে। আগে যারা ছিল তাদের জায়গায় নতুন লোকজন এই ব্যবসা নিতে চায়। এছাড়া কিছু বহিরাগত সমস্যা ছিল। আর আন্তর্জাতিক কিছুটা চাপ থাকেই। যারা চায় আমাদের দেশ থেকে এই শিল্পটা আরেক দেশে যেন চলে যায়।

শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনে মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে ১৮ দফা চুক্তি হয়েছে। সব কারখানায় এই চুক্তি বাস্তবায়ন শুরু হয়নি। এটাও একটা কারণ। গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সহ-সভাপতি জলি তালুকদার বলেন, অবিলম্বে এই চুক্তি বাস্তবায়ন করতে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। মালিক, ঝুট ব্যবসায়ী যারা এলাকায় ষড়যন্ত্র করছে তারা যেন সেটা বন্ধ করে। সেই কথাটাই আমরা জোর দিয়ে বলছি। আঠারো দফার চুক্তি হয়েছে সেটার বাস্তবায়ন যেন দ্রুত করে। সব ফ্যাক্টরিতেই যেন দ্রুত বাস্তবায়ন হয়।

মালিক পক্ষের দিক থেকেও এই অস্থিরতার পেছনে বাইরের ইন্ধন বা একটা ষড়যন্ত্রের অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে রুবানা হক বলেন, কোনো পোশাক খাতে অস্থিরতার মূল কারণ খতিয়ে দেখতে হবে সরকারকে। একেবারে নিঃসন্দেহে বাইরের ইন্ধন আছে এবং এর পেছনে কেউ না কেউ কাজ করছে। এখন এই সর্ষের ভূতটা কে, এটাতো বার করতে পারা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। কারণ আমরা শুধু শ্রমিক-মালিক সম্পর্কটা দেখতে পারি। এর পেছনে কাজ করতে পারি, নিজের ফ্যাক্টরিতে যেতে পারি কথা বলতে পারি। কিন্তু বাইরে কে আছে এটাতো দেখতে পারবো না। এটি সরকারকে দেখতে হবে। সংকট দীর্ঘায়িত এবং জটিল হওয়ার পেছনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঘাটতি ও সমন্বয়হীনতা একটা কারণ বলে অনেকে মনে করছেন। সরকার পতনের পর পুলিশ একটা বড় সংকটের মধ্যে দিয়ে গেছে। শিল্পপুলিশ, গোয়েন্দা মিলিয়ে যেভাবে সমন্বিতভাবে তৎপরতা চালাতো সেখানে এক ধরনের ঘাটতি দেখা দেয়। এখনও শিল্পপুলিশ বিভিন্ন জেলা থেকে এসে আশুলিয়া সাভার এলাকায় দায়িত্ব পালন করছে।

বিজিএমইএ যা বলছে: সরকার পতনের পর বাস্তবতা হলো বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি বিজিএমইএ’র নেতৃস্থানীয় অনেকেই নিরুদ্দেশ। সেখানে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আব্দুল্লাহ হিল রাকিব। তিনি বলেন, এতদিন অনেকেই প্রকাশ করতে পারেনি। যার যত পুঞ্জিভূত ক্ষোভ এখন প্রকাশ করছে। আমি বলবো- আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ের স্কোপ রয়ে গেছে। স্বদিচ্ছা সবারই আছে। চেষ্টা করছে। আর্মি ইজ গিভিং দেয়ার বেস্ট। এখানে আসলে উচিত সরকারকে আরো একটু কঠোর ভূমিকা পালন করা। আমরা কথা বলছি, তারাও হয়তো চেষ্টা করছেন। পোশাক খাতে অস্থিরতার প্রভাব সম্পর্কে তিনি বলেন, এটারতো একটা ইকনোমিক লস আছেই। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে। ডিরেক্ট ইমপ্যাক্ট হচ্ছে এই অর্ডারগুলো যেগুলো বিলম্ব হচ্ছে সেগুলো এয়ার শিপমেন্ট করতে হবে, ডিসকাউন্ট দিতে হবে, কাস্টমারের ক্ষতি হবে। আর ইনডিরেক্ট ইমপ্যাক্ট হচ্ছে এই যে নিউজটা এটা কাস্টমারের মাইন্ডসেট বা ডিসিশনে চেঞ্জ আনতে পারে। ব্র্যান্ডেড কাস্টমারদের সঙ্গে আমরা কথা বলছি। তারা সবাই আমাদের কনফিডেন্স দিচ্ছেন, এখন পর্যন্ত কিন্তু এটা কতদিন থাকবে জানি না।

বর্তমানে যেসব কারখানা আক্রান্ত আছে সেটা সংখ্যা বিবেচনায় নগণ্য বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, এটাও সত্য যে এটা আসলে এক পার্সেন্টেরও কম, আমাদের টোট্যাল নম্বরের তুলনায়। তবে পোশাক খাতের অনেক ব্যবসায়ী মনে করেন প্রকৃত সংকট আরো গভীর। এ ছাড়া সংগঠনের ভূমিকা নিয়েও কারো কারো প্রশ্ন রয়েছে। এ ব্যাপারে আব্দুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, আমাদের সাধারণ সদস্যরাই মনে করেন যে বিজিএমইএ সমস্যা সমাধানে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। আপনি যদি দু’সপ্তাহ আগের অবস্থা দেখেন আর এখনকার সিচুয়েশন, অনেক উন্নতি হয়েছে। যত দ্রুত আমরা এই সিচ্যুয়েশনটা ডিল করতে পারবো, তত দ্রুত কাস্টমারদের কনফিডেন্স লেভেল ব্যাক করবে।

শ্রম মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য: প্রতিদিনই কোনো না কোনো কারখানায় মজুরি বকেয়া, ছাঁটাইসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে ঝামেলা লেগেই আছে। সরকার এখন কারখানাভিত্তিক সমস্যা ধরে সমাধানের উদ্যোগ নিচ্ছে। যৌথবাহিনীর আশুলিয়া সাভার এলাকায় বেশ তৎপর হয়েছে। কোথাও কোনো কারখানায় সমস্যা হলে গিয়ে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করছে। পোশাক কারখানায় শ্রমিকদের শান্ত রাখতে শিল্পপুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি এবং মালিক-শ্রমিক এবং ট্রেড ইউনিয়নের তৎপরতার মূল বার্তা হলো কোনোভাবেই শ্রমিক অসন্তোষ যেন বড় না হয়। ছড়িয়ে না পড়ে।

শ্রম উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, শ্রমিকদের দাবি মেনে নিয়ে সরকার কাজ শুরু করেছে। আঠারো দফা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। যেসব কারখানায় বকেয়া বেতন রয়েছে সেখানে প্রয়োজনে সরকার ঋণ দিয়ে বেতন-ভাতা পরিশোধের ব্যবস্থা নিচ্ছে। সর্বোচ্চ কনসালটেশনের মাধ্যমে এই সমস্যাগুলো সমাধান করতে চাই এবং সমাধান করে আসছি। ঝুট ব্যবসা নিয়েও আমরা কাজ করছি, কীভাবে কেন্দ্রীয়ভাবে এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এটাকে কেন্দ্র করে যে রাজনৈতিক সহিংসতা সেখানে হয়, প্রতিবারই ট্রানজিশনের সময়, সেটাকেও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তো সার্বিক বিষয়টাকে আমরা এড্রেস করছি। আর নিরাপত্তার বিষয়টা সময়ের সাথে সাথে আরো উন্নতি করবে। এখন বিজনেসম্যানরা মোটামুটি একটা কনফিডেন্সে এসেছে যে নিরাপত্তাটা আমরা দেয়ার চেষ্টা করছি।

সিপিডি যা বলছে: পোশাক খাতে অস্থিরতা নিরসন না হলে এর প্রভাব পড়বে দীর্ঘমেয়াদে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে বড় ক্ষতির মুখে পড়বে দেশ। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন, মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক উন্নয়ন ঘটিয়ে দ্রুত এই অস্থিরতা নিরসন জরুরি। আমাদের আসলে ক্ষতি অনেক বড়ই বলতে হবে। ক্ষতি এই অর্থে যে আমাদেরতো শুধু কারখানার অর্ডার এবং শ্রমিকের মজুরি না। এই মুহূর্তে আমাদের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে; যেখানে সবসময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে- রপ্তানি ও রেমিট্যান্স। সেদিক থেকে আমাদের জন্য কারখানা পর্যায়ে স্থিতিশীলতা ফিরে আসা; এটা কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে দ্বিতীয়। এ অবস্থান ধরে রাখা এবং প্রবৃদ্ধি ও উন্নতির জন্য শ্রমিক অসন্তোষের স্থায়ী সমাধান এবং দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ব্যবস্থা নেয়ার কোনো বিকল্প নেই।

‘বিদেশি শক্তির’ ইন্ধন: দেশের তৈরি পোশাক খাতে অস্থিরতার পেছনে ‘বিদেশি শক্তির’ ইন্ধনও দেখছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার মো. সারোয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, পোশাক শিল্পে অসন্তোষের পেছনে এই শিল্পের ভিতরের কেউ খেলছে কিনা, তাদের চিহ্নিত করতে হবে। তৃতীয় পক্ষ (বিদেশি) কাজ করছে কিনা, তা বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা জানতে কাজ করছে। যৌথ বাহিনীর অভিযানে থাকা বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রফিকুল ইসলাম বলেন, শ্রমিকদের সঙ্গেও আমরা বসেছি। তারাও জানে কাজ না করলে বেতন পাবেন না। শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া আছে, সবই ঠিক আছে, তার মধ্যেও তারা কাজ করতে চায়। এর ভেতরে একটি থার্ড পার্টি এসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে, বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিচ্ছে। আমাদের যৌথ অভিযানও হয়েছে। তাদের কয়েকজন গ্রেপ্তারও হয়েছে। ‘হাফপ্যান্ট’ পার্টি বলে একটি গ্রুপ আছে। যৌথ অভিযানে তারা কিছুটা নিউট্রালাইজ হয়েছে। থার্ড পার্টি তারাতো সিনে আসছে না। তারা উসকানি দিয়ে কেটে পড়ে।

শ্রমিক অসন্তাষের পেছনে বিদেশি ষড়যন্ত্র রয়েছে কিনা জানতে চাইলে শ্রম উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়া বলেন, আমরা ইতোমধ্যে এমন কিছু তথ্য পেয়েছি যেটা ওই বিষয়টিই ইঙ্গিত করে। এটা একটি সিজনাল বিজনেস। মার্কেটে যে প্রোডাক্টটা যাবে সেটা তিন মাস আগেই প্রস্তুত করতে হয়। সেই অর্ডারগুলো অনেক জায়গায় বাতিল হয়ে যাচ্ছে। প্রায় ১৫-২০ শতাংশ অর্ডার বাতিল হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি কিছু নির্দিষ্ট দেশের বায়াররা অর্ডারটা নেয়ার জন্য লবিং করছেন, উঠে-পড়ে লেগেছে।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইনবিষয়ক সম্পাদক খায়রুল মামুন মিন্টু বলেন, শ্রমিক অসন্তোষের পেছনে শ্রমিক নামধারী কিছু দুর্বৃত্তরা কাজ করছে।

পোশাক খাতের বাজার কত বড়: ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা প্রায় ৪১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছিলেন। এর মধ্যে ব্যাংকিং চ্যানেলে সাড়ে ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে এসেছে। বাকি সাড়ে বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেশে পৌঁছেনি।

কত শ্রমিক কর্মরত: বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের শ্রম প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম চৌধুরী গত জুনে জাতীয় সংসদে জানান, রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্য (বায়োমেট্রিকস ডেটাবেজ) অনুযায়ী, তৈরি পোশাক কারখানায় ৩৩ লাখ ১৭ হাজার ৩৯৭ জন শ্রমিক রয়েছেন। এর মধ্যে ৫২ দশমিক ২৮ শতাংশই নারী শ্রমিক। সংখ্যার হিসাবে নারী শ্রমিক রয়েছেন ১৭ লাখ ৩৪ হাজার ৪৫৯ জন। অন্যদিকে নিট পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর তথ্য অনুযায়ী নিট খাতে ১৭ লাখ ২৫৫ জন শ্রমিক রয়েছেন। যার ৬২ শতাংশ অর্থাৎ ১০ লাখ ৫৪ হাজার ১৫৭ জনই নারী। সব মিলিয়ে দেশে তৈরি পোশাক খাতে ৫০ লাখ ১৭ হাজার ৬৫২ জন শ্রমিক রয়েছেন। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই শিল্পে ৫ কোটি মানুষ জড়িত বলে জানা গেছে।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য

Beta version