-->

শপথ ‘ভঙ্গ’ করেছেন ৪১ বিচারপতি!

-সুপ্রিম কোর্ট

এম বদি-উজ-জামান
শপথ ‘ভঙ্গ’ করেছেন ৪১ বিচারপতি!

সুপ্রিম কোর্টের একাধিক বিচারপতিকে অপসারণের দাবি ক্রমশই জোরালো হচ্ছে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকার আমলে নিয়োগ পাওয়া ৪১ বিচারপতি অপসারণের দাবিতে করা দুটি তালিকা এখন খুরপাক খাচ্ছে বিভিন্ন দপ্তরে। ওই তালিকায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন ও হাইকোর্ট বিভাগের ৪০ জন বিচারপতির নাম রয়েছে। গত ৫ অক্টোবর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের অনুষ্ঠিত সংলাপেও বিচারপতি অপসারণের বিষয়টি স্থান পাওয়ায় তা নিয়ে সোচ্চার সুপ্রিম কোর্টের একদল আইনজীবী।

জানা গেছে, একটি তালিকায় আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি এবং হাইকোর্ট বিভাগের ২৮ জন বিচারপতিসহ মোট ২৯ জনের নাম রয়েছে। এই ২৯ বিচারপতির মধ্যে বিএনপি আমলে (২০০১ থেকে ২০০৬ সাল) নিয়োগ পাওয়া ৫ বিচারপতি এবং আওয়ামী লীগ (২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল) আমলে নিয়োগ পাওয়া ২৪ জন বিচারপতির নাম রয়েছে। অন্য তালিকায় হাইকোর্ট বিভাগের ২৬ জন বিচারপতির নাম রয়েছে। দ্বিতীয় তালিকার সবাই বিগত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে নিয়োগ পাওয়া। উভয় তালিকায় ১৪ বিচারপতির নাম পাওয়া গেছে। ফলে দুটি তালিকায় ৫৫ জন বিচারপতির নাম থাকলেও ১৪ জনের নাম উভয় তালিকায় থাকায় অভিযোগ ৪১ বিচারপতির বিরুদ্ধে। রায় বা আদেশ দেয়ার ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতি, অযোগ্যতা, রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলার বিচার করাসহ শপথ ভঙ্গের অভিযোগ তুলে তাদের অপসারণের দাবি করা হচ্ছে। এই তালিকা দুটি রাষ্ট্রপতি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, প্রধান বিচারপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তরে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।

সংবিধানের তৃতীয় তফসিলে (১৪৮ অনুচ্ছেদ) উল্লিখিত শপথের বিধান অনুযায়ী একজন বিচারক ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে আইন অনুযায়ী বিচার কাজ পরিচালনা করবেন। কিন্তু কোনো কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে এই শপথ ভঙ্গের অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে বিরোধী মতের ব্যক্তিদের মামলার বিচার বা শুনানিকালে কোনো কোনো বিচারক বিরূপ মন্তব্য করেছেন বলে অভিযোগ। এ ছাড়া কোনো কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িয়ে পড়ারও অভিযোগ রয়েছে।

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদসহ সুপ্রিম কোর্টে এখন বিচারপতির সংখ্যা ১০৭ জন। এদের মধ্যে ২৩ জন নিয়োগ পেয়েছেন গত ৯ অক্টোবর। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমলে নতুন নিয়োগ পাওয়া ওই ২৩ জন এখনও বিচার কাজে বসেননি। ফলে তাদের বাদে আগে থেকে দায়িত্বরত রয়েছেন ৮৪ জন বিচারপতি। পুরনোদের মধ্যে আপিল বিভাগে আছেন ৬ জন (প্রধান বিচারপতিসহ)। আর হাইকোর্ট বিভাগে দায়িত্বরত ৭৮ জন বিচারপতি। প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগে যে ৬ জন রয়েছেন তারা সবাই বিএনপি আমলে নিয়োগ পাওয়া। আর হাইকোর্ট বিভাগে দায়িত্বরত পুরনোদের মধ্যে ৬ জন বিএনপি আমলে নিয়োগ পাওয়া। বাকি ৭২ জন আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ পেয়েছেন।

সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি নিয়োগের কোনো আইন নেই। সংবিধানের ৯৫(২)(গ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের যোগ্যতা নির্ধারিত হবে আইন দ্বারা। সেখানে বলা হয়েছে, ‘(গ) সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে নিয়োগ লাভের জন্য আইনের দ্বারা নির্ধারিত যোগ্যতা না থাকিয়া থাকিলে; তিনি বিচারক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হইবেন না।’ ১৯৭২ সালে করা দেশের এই সংবিধানে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে আইন করার কথা বলা থাকলেও সেই আইন কোনো সরকারই প্রণয়ন করেনি। সরকার দলীয় বিবেচনা এবং সরকারের মর্জিমাফিক বিচারক নিয়োগ হয়ে আসছে। সংবিধানের ৯৫(১) নম্বর অনুচ্ছেদে বিচারক নিয়োগ করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে। তিনি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে বিচারক নিয়োগ করবেন। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি ক্ষমতাসীন সরকারের মর্জিমাফিক বিচারক নিয়োগ করে থাকেন। কারণ সংবিধানের ৫৬(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ এবং ৯৫(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া রাষ্ট্রের সব কাজ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করেই করবেন। সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ফলে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ ছাড়া প্রধান বিচারপতি কোনো বিচারক নিয়োগ দিতে পারবেন না। আর প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেয়ার অর্থ রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ যা দেশবাসী প্রত্যক্ষ করছে। কিন্তু যখনই উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের বিষয়টি সামনে আসে তখনই সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ও সিনিয়র আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে আইন করার দাবি ওঠে। কিন্তু বাস্তবতা হলো- সব দাবিকে পাশ কাটিয়ে আইন প্রণয়ন ছাড়াই বিচারক নিয়োগ অব্যাহত রয়েছে। যার সর্বশেষ নজীর গত ৯ অক্টোবর ২৩ জন বিচারক নিয়োগ। যদিও ২০০৭-০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের নিয়ম করে অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল। কিন্তু ওই সরকার বিদায়ের পর তা আর আলোর মুখ দেখেনি। এ ছাড়া বিচারপতি নিয়োগে আইন তৈরির জন্য ২০১২ সালে সুপারিশ করেছিল আইন কমিশন। কিন্তু ওই সুপারিশও বাস্তবায়ন করেনি তৎকালীন সরকার।

উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে যেমন আইন নেই, তেমনি দায়িত্বরত উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণেও আইনি জটিলতা রয়েছে। একসময় সংবিধান অনুযায়ী উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের বিধান ছিল। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সিনিয়র তিন বিচারপতি নিয়ে এই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠিত হতো। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বহু বিচারপতি অপসারণের নজির রয়েছে দেশে। কিন্তু বিগত আওয়ামী লীগ সরকার সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে। উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা নেয়া হয় জাতীয় সংসদের হাতে। এমন প্রেক্ষাপটে এক রিট মামলায় সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম কোর্ট। এই রায় পুনর্বিবেচনার জন্য তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার রিভিউ আবেদন করে আপিল বিভাগে; যা বিচারাধীন। এমন অবস্থায় একদল আইনজীবীর অভিমত, ষোড়শ সংশোধনীর রায় তাবিল হওয়ায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা বহাল রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদের অভিমত এমনটাই। তবে কারও কারও অভিমত, রিভিউ আবেদন বিচারাধীন থাকায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা কার্যকর নেই। আপিল বিভাগে রিভিউ আবেদন যতক্ষন পর্যন্ত নিষ্পত্তি না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কার্যকর নেই। ফলে সুপ্রিম কোর্টের যে ৪১ বিচারক অপসারণের দাবি তোলা হয়েছে, তাদের অপসারণ নিয়ে আইনি জটিলতা রয়েছে।

এই জটিলতা এড়ানোরও পথ বাতলে দিয়েছেন অ্যাডভোকেট সৈয়দ মামুন মাহবুব। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, যেসব বিচারপতির বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ। তাদের ডেকে অর্থাৎ, চা পানের দাওয়াত দিয়ে আপোষে বিদায় দেয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে তাদের পেনশন পাওয়া নিশ্চিত করা গেলে বিষয়টি সহজ হবে বলেই তার অভিমত। তিনি বলেন, দুর্নীতিবাজ ও আওয়ামী লীগের দলীয় মুখপাত্রের মতো ভূমিকা পালনকারী বিচারকদের অবিলম্বে সরানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় আইনজীবীরা আন্দোলনে নামবে।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন গত ৬ আগস্ট সংবাদ সম্মেলন ডেকে সেখানে সুপ্রিম কোর্টের কয়েকজন বিচারপতির পদত্যাগ দাবি করেন। তিনি দুর্নীতিবাজ ও আওয়ামী লীগের দলীয় মুখপাত্রের মতো ভূমিকা পালনকারী বিচারকদের অপসারণ চান। তিনি গতকাল সোমবার পৃথক এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, বিএনপি উচ্চ আদালতে দলবাজ ৩০ জন বিচারপতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানিয়েছে। আমরা সেই দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করি।

বিএনপি সমর্থক আইনজীবীদের সংগঠন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ব্যারিস্টার কায়সার কামাল উচ্চ আদালতের দুর্নীতিবাজ বিচারক অপসারণের দাবি জানিয়ে বলেছেন, গত দেড় দশকে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের আমলে অনেক বিচারপতি শপথ ও আচরণবিধিমালা ভঙ্গ করে বিচারকাজ পরিচালনা করেছেন। আমরা মনে করি শপথ ভঙ্গকারী এসব বিচারপতিদের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্ট যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

এদিকে দুর্নীতিবাজ ও দলীয় কর্মীর মতো আচরণকারী বিচারকদের অপসারণের দাবিতে আজ মঙ্গলবার দুপুরে একদল আইনজীবী প্রধান বিচারপতির দপ্তর অভিমুখে পদযাত্রা করবেন। সুপ্রিম কোর্ট চত্বর থেকেই এই পদযাত্রা হবে বলে জানা গেছে। একই সঙ্গে সেখানে মানববন্ধন কর্মসূচিও পালন করা হবে।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য

Beta version