ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। আশ্রয় নেন ভারতে। তিনি পালিয়ে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের প্রথম সারির কোনো নেতাকে আর মাঠে পাওয়া যায়নি, দু-একজন বাদে কেউ নেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও। দ্রুত আত্মগোপনে চলে যান বিভিন্ন সময় দায়িত্বে থাকা সরকারের এমপি-মন্ত্রীরাও। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর অনেক এমপি-মন্ত্রীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হলেও হদিস মিলছে না ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা শেখ পরিবারের সদস্যদের।
শেখ হাসিনার একমাত্র ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় যুক্তরাষ্ট্রে আছেন বলে ছাত্রলীগ সূত্রে জানা গেছে। শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার আগে থেকেই তিনি সেখানে অবস্থান করছিলেন। মা পালিয়ে গেলে জয় একাধিকবার ফেসবুকে লাইভে এসে বিভিন্ন কথা বলেছেন। শেখ হাসিনার একমাত্র মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক মহাপরিচালক। তিনি ৫ আগস্টের আগে থেকে ভারতেই অবস্থান করছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট মেয়ে ও শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা শেখ হাসিনার সঙ্গে ৫ আগস্টই ভারতে চলে যান। তিনি ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী। তবে তার সর্বশেষ অবস্থান নিশ্চিত হওয়া যায়নি। শেখ রেহানার এক ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি। তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের গবেষণা সেল সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) পরিচালিত হতো। শেখ রেহানার দুই মেয়ে। বড় মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য। আর ছোট মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তী। শেখ রেহানা ও ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি কোথায় অবস্থান করছেন, তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে, টিউলিপ সিদ্দিক ও আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তী যুক্তরাজ্যে বসবাস করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট ভাই শেখ আবু নাসেরের পাঁচ ছেলে। তারা খুলনা বিভাগের অঘোষিত গডফাদার ছিলেন। নির্বাচনে প্রার্থিতা নির্ধারণ থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি সব ব্যবসা-বাণিজ্যে তাদের ছিল একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। তাদের মধ্যে দুজন গত সংসদেও এমপি ছিলেন। তারা হলেনÑ শেখ হেলাল উদ্দিন ও শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল। শেখ হেলালের ছেলে শেখ তন্ময়ও গত দুই সংসদের এমপি। শেখ পরিবারের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, হেলাল ও তন্ময় ভারতে আছেন। হেলালের আরেক ভাই শেখ জুয়েল। ৫ আগস্টের পরে জুয়েল দেশে ছিলেন। তবে তাদের আর তিন ভাই শেখ সোহেল, শেখ রুবেল ও শেখ বেলাল এখন কোথায় আছেন, কেউ জানে না। শেখ হেলালকে কেন্দ্র করে খুলনাজুড়ে তাদের একটি ক্ষমতার বলয় গড়ে উঠেছিল। তারা সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়-অধিদপ্তরের বড় বড় ঠিকাদারি কাজের নিয়ন্ত্রণ করতেন।
শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই শেখ ফজলুল করিম সেলিম আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। তার দুই ছেলে শেখ ফজলে ফাহিম ও শেখ ফজলে নাইম। শেখ পরিবারের প্রভাব খাটিয়ে শেখ ফজলে ফাহিম বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের প্রধান সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি ছিলেন। ৫ আগস্টের পর থেকে শেখ সেলিমের পরিবার আত্মগোপনে আছেন। শেখ পরিবারের ঘনিষ্ঠ সূত্র দাবি করছে, শেখ সেলিম এখনও দেশেই আছেন। তবে, এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। শেখ সেলিমের ভাই শেখ ফজলুল হক মণির দুই সন্তান শেখ ফজলে শামস পরশ ও শেখ ফজলে নূর তাপস। শেখ পরিবারের প্রভাবে হঠাৎ করেই ২০১৯ সালে যুবলীগের চেয়ারম্যান হন পরশ। ৫ আগস্টের পর থেকে তার খোঁজ নেই। আর শেখ তাপস ঢাকার সাবেক এমপি ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র। সরকার পতনের দুই দিন আগে সিঙ্গাপুর যান তিনি। শেখ পরশও দেশ ছেড়েছেন বলে জানা যায়। শেখ সেলিমের ছোট ভাই শেখ ফজলুর রহমান মারুফ ক্যাসিনো বিতর্কের সময় আলোচনায় এসেছিলেন। তিনি বর্তমানে সিঙ্গাপুরে আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তার ভগ্নিপতি যুবলীগের সাবেক চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীও আত্মগোপনে আছেন।
শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ বরিশাল-১ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। তার ছেলে সাদিক আবদুল্লাহ ছিলেন বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র। আওয়ামী লীগের ক্ষমতার সময় এই পরিবার ছিল বরিশাল অঞ্চলের হর্তাকর্তা। ৫ আগস্টের পরে হাসানাত আবদুল্লাহ ও ছোট ছেলে সুকান্ত আবদুল্লাহ দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান বলে বিভিন্ন সূত্র দাবি করেছে। তবে সাদিক আবদুল্লাহ কোথায় আছেন তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তার ছোট ভাই আবুল খায়ের আবদুল্লাহ বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র। তিনি কোথায় আছেন জানা যাচ্ছে না।
শেখ হাসিনার ফুফাতো বোন শেখ ফাতেমা বেগমের এক ছেলে নূর-ই আলম চৌধুরী (লিটন চৌধুরী) একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ ছিলেন। আরেক ছেলে মুজিবুর রহমান চৌধুরী (নিক্সন চৌধুরী) ফরিদপুর-৪ আসন থেকে টানা তিনবারের স্বতন্ত্র এমপি ছিলেন। ৫ আগস্টের পর থেকে এই দুই ভাইও আত্মগোপনে আছেন বলে জানা গেছে।
স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকারের অন্যতম সুবিধাভোগীদের একজন ঢাকা ওয়াসার সাবেক বিতর্কিত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান। তিনি শেখ হাসিনার ফুপা ইলিয়াস চৌধুরীর বোনকে বিয়ে করেন। সেদিক থেকে তিনি শেখ হাসিনার ফুপা হন। তিনি ৫ আগস্টের পর যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন বলে আলোচনা আছে। তবে কারও কারও মতে, তিনি দেশেই আত্মগোপনে রয়েছেন। শেখ পরিবারের আরেক প্রভাবশালী সদস্য বঙ্গবন্ধুর চাচাতো ভাই শেখ কবির হোসেন বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি ও বাংলাদেশ বীমা সমিতির সভাপতি ছিলেন। তার ভাই শেখ নাদির হোসেন মিল্ক ভিটার চেয়ারম্যান ছিলেন। আরেক চাচাতো ভাই শেখ হাফিজুর রহমান বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের সদস্যসচিব। ৫ আগস্টের পর তাদের কোথাও দেখা যায়নি। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু বঙ্গবন্ধুর চাচাতো বোন ফিরোজা বেগমের স্বামী। ৫ আগস্টের পর তিনি ভারত গেছেন বলে গুঞ্জন আছে। তবে সত্যতা নিশ্চিত করা যায়নি। এ ছাড়া শেখ রেহানার দেবর মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক। গত চার মেয়াদে আওয়ামী লীগের অন্যতম ক্ষমতার বলয় গড়ে উঠেছিল তাকে কেন্দ্র করে। তিনি সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন ব্যবহার করে দলের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করার পাশাপাশি ব্যবসায়িক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেছেন বলে অভিযোগ আছে। ৫ আগস্টের পর থেকে তারিক আহমেদ আত্মগোপনে আছেন।
শেখ হাসিনার স্বজনেরা গত সাড়ে ১৫ বছরে সরকারের মন্ত্রী, এমপি, মেয়রসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ও সহযোগী সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। তাদের মধ্যে অন্তত আটজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদায় ছিলেন। এমপি হয়েছিলেন কমপক্ষে ১৫ জন। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের মেয়র তিনজন, সহযোগী সংগঠনের চেয়ারম্যান ও সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করেন তিনজন। আওয়ামী লীগের পুরো মেয়াদে সরকার থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন তারা। অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হলেও তাদের কোনো হদিস মিলছে না।
গত ১৮ আগস্ট আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে প্রাণনাশের আশঙ্কায় কতিপয় রাজনৈতিক ব্যক্তিসহ বিবিধ নাগরিকরা সেনানিবাসে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ড রোধ, জীবন রক্ষা ও আইনের শাসন সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে জীবন বিপন্ন ২৪ জন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, পাঁচজন বিচারক, ১৯ জন অসামরিক প্রশাসনের কর্মকর্তা, ২৮ জন পুলিশ অফিসার, ৪৮৭ জন পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্য, বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাসহ বিবিধ ১২ জন ও ৫১ জন পরিবার-পরিজনসহ (স্ত্রী ও শিশু) সর্বমোট ৬২৬ জনকে বিভিন্ন সেনানিবাসে আশ্রয় প্রদান করা হয়।
আইএসপিআর আরও জানায়, পরিস্থিতির উন্নতি সাপেক্ষে ৬১৫ জন স্ব-উদ্যোগে সেনানিবাস ত্যাগ করেন। আশ্রয় প্রদানকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে থেকে এ পর্যন্ত চারজনকে তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ বা মামলার ভিত্তিতে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে সব তথ্য দেয়া হয়েছে।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য