সম্প্রতি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের মতো আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর একটি অংশ তাদের চাকরি স্থায়ী করার দাবি নিয়ে রাজপথে আন্দোলন শুরু করেছিল। সাধারণ ও অঙ্গীভূত আনসারের এই সদস্যরা গত ২১ আগস্ট থেকে আন্দোলন-বিক্ষোভ শুরু করে, যা চলে টানা কয়েক দিন। ওই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সচিবালয় ঘেরাও এবং সংঘর্ষের মতো ঘটনা ঘটে। তখন অনেক আনসার সদস্য গ্রেপ্তার হন। একপর্যায়ে তাদের দাবি পর্যালোচনা করে সুপারিশ দিতে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু সেই কমিটির কাজের অগ্রগতি কোন পর্যায়ে আছে, এমন প্রশ্নও উঠেছে খোদ আনসার বাহিনীর সদস্যদের মাঝে। প্রসঙ্গত, যেসব আনসার সদস্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকেন তাদের অঙ্গীভূত এবং যারা ছুটিতে চলে যান তাদের সাধারণ আনসার বলা হয়ে থাকে।
জানা গেছে, দেশের অন্য সব খাতের মতো আনসার বাহিনীতেও সংস্কারের প্রক্রিয়া চলছে। এই বাহিনীর নিয়োগ প্রক্রিয়া এমনভাবে করা হবে যেন সব জেলার প্রতিনিধিত্ব থাকে। সম্ভাব্য নতুন বিধিমালা অনুযায়ী, অন্য সব চাকরির মতো আনসার সদস্যদের দেশের যেকোনো এলাকায় গিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে। আনসার বাহিনীতে এখন আর অনিয়ম কিংবা অনিয়মতান্ত্রিক কোনো কার্যক্রম থাকবে না। ইতোমধ্যে আনসারদের (রেস্ট টাইম প্রথা) একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর যে ছয় মাসের ছুটিতে পাঠানো হতো, সেটা তুলে নেয়া হয়েছে। তবে সংস্থাটির সদস্যরা বলছেন, এ বিষয়ে মৌখিকভাবে ঘোষণা দেয়া হলেও কাগজ-কলমে এখনও তারা কোনো প্রজ্ঞাপন দেখতে পাননি।
সংস্থাটির সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে আনসার বাহিনীর সদস্য আছে প্রায় ৭০ হাজার। এর মধ্যে ৫৪ হাজার ৬৫১ জন অঙ্গীভূত সদস্য হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চুক্তি অনুযায়ী নিয়মিত নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত থাকেন। বাকি ১৪ হাজারে বেশি সদস্য ছয় মাসের জন্য ‘বিশ্রামে’ থাকছেন। বিশ্রামে থাকা অবস্থায় এসব সদস্য কোনো বেতন-ভাতা পান না। বলা যায়, তারা তখন বেকার থাকেন। কোনো প্রতিষ্ঠানের নতুন চাহিদা পেলে কিংবা আগের কর্মরতদের চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে ‘রেস্টে’ থাকা আনসার সদস্যরা কাজের সুযোগ পেয়ে থাকেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আনসার বাহিনীর একাধিক সদস্য জানান, তিন বছর চাকরি করার পর প্রত্যেক সদস্যকে ছয় মাসের জন্য ছুটি দেয়া হয়। কিন্তু এই ছয় মাসে তাদের কোনো বেতন দেয়া হয় না। এ সময়টা বেকার অবস্থায় কাটে। তখন পেশা নিয়ে তাদের মাঝে হতাশা চলে আসে। নানা বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে হয়।
তারা আরও জানান, আনসারদের কোনো সাপ্তাহিক ছুটি নেই। দুই-তিন মাস পর ছুটি পান তারা। অন্যান্য বাহিনীর মতো কর্মস্থলে তাদের পরিবার নিয়ে থাকার কোনো আবাসিক ব্যবস্থাও নেই। যে রেশন দেয়া হয় সেটাও পর্যাপ্ত নয়। যে বেতন পান তা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। এ ছাড়া চাকরি অস্থায়ী হওয়ার কারণে খালি হাতে অবসরে যেতে হয় বলে জানান তারা।
সূত্র বলছে, আনসারের বিভিন্ন পদমর্যাদার উন্নয়ন (আপগ্রেডেশন) হলেও উপজেলা আনসার ও ভিডিপি কর্মকর্তা পদের আপগ্রেডেশনের সিদ্ধান্তটি ঝুলে আছে দীর্ঘদিন। যে কারণে চরম অসন্তোষ বিরাজ করতে আনসার কর্মকর্তাদের মধ্যে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবদুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদ বলেন, আনসার ও ভিডিপি কর্মকর্তা পদের আপগ্রেডেশনের বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন আছে। চলমান সংস্কার কার্যক্রমের আওতায় বিষয়টি পুলিশ সংস্কার প্রশাসন কমিশনের মাধ্যমে উপস্থাপনের প্রচেষ্টাও রয়েছে। তবে, শুধু গ্রেডের উন্নতি নয়, পেশাগত দক্ষতা ও কার্যকর ভূমিকা রাখার প্রয়োজনীয় মানদণ্ডও চাকরি বিধিমালায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। তিনি বলেন, আনসার সদস্যদের বেতন নিয়ে আমরা কাজ করছি। রেশন বাড়ানো নিয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনাও মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আমি নিশ্চিত এ বিষয়ে একটি পজিটিভ নির্দেশনা আসবে। যেহেতু এরা চুক্তিভিত্তিক কাজ করে, তাই এদের কোনো পেনশন নেই। যদিও তাদের পেনশন সুবিধার দাবি ছিল। আমরা চেষ্টা করছি আনসার ব্যাংকের কোনো পেনশন স্কিমে তাদের যুক্ত করা যায় কিনা। এ ছাড়া দেশের অন্য সব খাতের মতো আনসার বাহিনীতেও সংস্কার চলছে। আগে দেখা যেতো যে আনসার সদস্যদের কার্যক্রম শুধু সুনির্দিষ্ট একটি পরিধির মধ্যে ছিল। আমরা এখন নিয়োগ প্রক্রিয়া এমনভাবে করবো- যাতে এই বাহিনীতে সব জেলার প্রতিনিধিত্ব থাকে। আগে আনসার সদস্যরা তাদের নিজস্ব চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন জায়গায় দায়িত্ব পেতেন। কিন্তু এখন আর এমনটি হবে না। আমাদের নতুন বিধিমালা অনুযায়ী-সবাইকে অন্যান্য চাকরির মতো দেশের যেকোনো জায়গায় গিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে। আনসার বাহিনীতে এখন আর অনিয়ম, কিংবা অনিয়মতান্ত্রিক কোনো কার্যক্রম থাকবে না।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলেছেন দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তা বিধানসহ কূটনৈতিক এলাকার সুরক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী। তিনি বলেন, এই বাহিনীকে সংস্কারের মাধ্যমে একটি দক্ষ, সুসংগঠিত, পেশাদার ও সময়োপযোগী বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা হবে। এ লক্ষ্যে যা যা করণীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তা করা হবে।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য