-->

দণ্ডিত তারেক রহমানকে ফেরানো যায়নি

এমদাদ হোসেন খান
দণ্ডিত তারেক রহমানকে ফেরানো যায়নি

১৬ বছর ধরে স্ত্রী-সন্তানসহ লন্ডনে বসবাস করছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। পাঁচটি মামলায় তার সাজা হয়েছে। আওয়ামী লীগের টানা প্রায় ১৬ বছরের শাসনামলে বিভিন্ন সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে ফিরিয়ে এনে শাস্তি কার্যকর করার কথা বলেছেন। দলটির নেতা ও মন্ত্রীরাও একই কথা বলেছেন। সরকার কয়েক দফা তাকে ফেরানোর উদ্যোগ নিলেও তা সম্ভব হয়নি। কিন্তু কেন তাকে ফেরানো সম্ভব হয়নি, তা জানা যায়নি।

২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা মামলায় তারেক রহমানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। ওয়ান ইলেভেনের সময় তার বিরুদ্ধে হওয়া ১৭টি মামলার মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলা এবং সম্পদের তথ্য গোপনের মামলায় সাজা হয়েছে। এছাড়া কর ফাঁকি, চাঁদাবাজির বাকি ১৫টি মামলা স্থগিত রয়েছে। পাঁচটি মামলায় তারেক রহমানের সাজা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ৭০টির বেশি মানহানির মামলা রয়েছে।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে চলে যান। এরপর বিভিন্ন দেশে নির্বাসিত কয়েকজন নেতা দেশে ফেরেন। তারেক রহমান শিগগিরই ফিরবেনÑ এমন কথাও শোনা যাচ্ছিল। তবে তিনি কবে ফিরবেন, তা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর বিএনপি নেতাদের মধ্যে গ্রেপ্তার আতঙ্ক নেই। কিন্তু তাদের মামলাও প্রত্যাহার করা হয়নি। মামলা প্রত্যাহার কিংবা সাজা স্থগিত হলে তারেক রহমান দেশে ফিরবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

তারেকের দেশে ফেরার আইনি বাধা কাটাতে বিএনপি কী করছে জানতে চাইলে দলটির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, তারেক রহমান আইন ও আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই তার সব মামলা আইনিভাবেই মোকাবিলা করে যথাসময়ে দেশে ফিরবেন তিনি। তিনি বলেন, ওয়ান ইলেভেনের সময় তারেক রহমানের বিরুদ্ধে হওয়া ১৭টি মামলার মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলা এবং সম্পদের তথ্য গোপনের মামলায় সাজা হয়েছে। এছাড়া কর ফাঁকি, চাঁদাবাজির বাকি ১৫টি মামলা স্থগিত রয়েছে। পাঁচটি মামলায় তারেক রহমানের সাজা হয়েছে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ৭০টির বেশি মানহানির মামলা রয়েছে। তিনি দাবি করেন, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত প্রতিটি মামলাই ভিত্তিহীন। গায়েবি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। ৫ আগস্টের পর সারাদেশের মানুষের এবং রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে প্রত্যাশা ছিল এসব মামলা দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রত্যাহার করা হবে।

তারেক রহমানের দেশে ফেরার ক্ষেত্রে তিনটি বাধা বিষয় আলোচনায় আসে। এক. দেশের চারটি মামলায় তার দণ্ড; দুই. তার পাসপোর্ট সংক্রান্ত জটিলতা; এবং ৩. রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।

এখন দেশে ফিরলে কি তারেক রহমানকে কারাগারে যেতে হবে এই প্রশ্নে বিএনপির সহআইনবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সৈয়দ জয়নুল আবেদীন মেজবাহ বলেন, মামলাগুলো থেকে খালাস বা অব্যাহতি না দিলে দেশে এলে কিছুদিনের জন্য হয়তো তাকে কারাগারে যেতে হতে পারে। তবে সরকার চাইলে সাজাপ্রাপ্ত মামলাগুলো আপিলের শর্তে জামিন পাবেনÑ এমন কোনো নির্বাহী আদেশ পেলে দেশে আসতে তার কোনো বাধা নেই। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত মিথ্যা মামলাগুলোর দণ্ড স্থগিত করে তাকে দেশে আসার সুযোগ করে দেয়া।

তারেকের আইনজীবী মেজবাহ বলেন, যদি তারেক রহমানের সাজা হওয়া চার মামলার দণ্ড স্থগিত করা হয়, তবে তাকে কারাগারে যেতে হবে না। তারেক রহমান ডিসেম্বরে কিংবা জানুয়ারিতে দেশে ফিরতে পারেন এমন একটি গুঞ্জন চলছে। বলা হচ্ছে, সেই পথ করতেই জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের অধিকাংশ শীর্ষনেতা এখন লন্ডনে।

জয়নাল আবেদীনসহ ফোরামের নেতাদের পাশাপাশি রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল আসাদুজ্জামান আসাদও এখন লন্ডনে। তিনি বিএনপির সাবেক মানবাধিকারবিষয়ক সম্পাদক।

লন্ডনে থাকা এক আইনজীবী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তারেক রহমানকে ফিরিয়ে আনার প্রস্তুতি চলছে। সব ঠিকঠাক থাকলে ডিসেম্বরেই দেশে ফিরবেন আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। সরকার চাইলে যেকোনো সময়ই ফিরবেন তিনি। ডিসেম্বরেই কি তারেক রহমান দেশে ফিরছেন জানতে চাইলে সরাসরি উত্তর এড়িয়ে যান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, ফিরবেন, ফিরতে তো হবেই। যে মামলাগুলো দেয়া হয়েছে, সবই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। প্রতিহিংসায় সব মামলায় ফরমায়েশি সাজা দেয়া হয়েছে। এখন তো আমি মনে করি, সেই সাজাগুলোর রায় আইনিভাবেই কার্যকর থাকা উচিত না। অন্তর্বর্তী সরকার এটি দ্রুত নিরসন করবেÑ এমনটাই প্রত্যাশা।দলীয় পর্যায়ে থেকে তারেক রহমানের দেশে ফেরার বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে কি-না জানতে চাইলে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, আমরা তো এখন ক্ষমতায় নেই, আমরা আমাদের দাবি জানাতে পারি। সেটিই জানাচ্ছি, আমাদের নেতারা, মহাসচিব বারবার তাগাদা দিচ্ছেন এ বিষয়ে। তারেক রহমানের সাজাগুলোর নির্বাহী আদেশে বাতিল করার ওপর জোর দেন তিনি।

অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, এখানে দুটো বিষয় আছে যদি তিনি (তারেক) আইনের সব বিষয় মান্য করেন, তবে আমাদের সিআরপিসির মধ্যে রয়েছে তিনি কীভাবে আপিল করতে পারবেন এবং কীভাবে আপিল করে তিনি মুক্ত হতে পারবেন। আর মামলাগুলো যেহেতু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, সে কারণে সরকার যদি ইচ্ছা করে তাহলে তাকে এই মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে পারে। অব্যাহতি দিলে তারেক রহমানের দেশে ফিরতে বাধা নেই।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারার ১ উপ-ধারার বিধান মতে সরকার যেকোনো ব্যক্তির দণ্ড স্থগিত বা মওকুফ করার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। তারেকের ক্ষেত্রেও তা প্রয়োগের সুযোগ রয়েছে।

ঢাকার জজ আদালতে ফৌজদারি মামলা পরিচালনায় অভিজ্ঞ আইনজীবী মীর আলমগীর হোসেন বলেন, যেকোনো ব্যক্তির মামলা থেকে খালাস, প্রত্যাহার বা দণ্ড স্থগিত করার ক্ষমতা সরকারের রয়েছে। এতে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটে না। আমাদের সংবিধানে সরকার ও রাষ্ট্রপতিকে বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। আরেক আইনজীবী আজাদ রহমানও একই মত প্রকাশ করেন।

তারেক রহমান বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে ২০০৮ সালে যুক্তরাজ্যে যান। পরে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে তার পাসপোর্ট আর নবায়ন হয়নি। তিনি কোনো প্রক্রিয়ায় যুক্তরাজ্যে রয়েছেন, সে বিষয়টি কখনও খোলসা করেনি বিএনপি।

২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের তৎকালীন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছিলেন, তারেক রহমান ও তার স্ত্রী-মেয়ে বাংলাদেশি পাসপোর্ট ‘সারেন্ডার’ করেছেন।

ব্রিটিশ হোম অফিস বাংলাদেশ হাইকমিশনে সেই পাসপোর্ট পাঠিয়ে দিয়েছে। তখন বিএনপি তার প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিল, তারেক রহমান যদি পাসপোর্ট ফেরতই দিয়ে থাকে তাহলে তা যেন সরকার দেখায়। তখন সরকারের পক্ষ থেকে তারেক রহমানের পাসপোর্ট দেখানো হয়নি। ফলে তিনি পাসপোর্ট ফেরত দিয়েছেন কি না, তাও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে নবায়ন না হওয়ায় তারেক রহমানের হাতে বাংলাদেশের বৈধ পাসপোর্ট এখন নেই। ফলে তাকে নতুন করে পাসপোর্ট নিতে হবে। আর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তার নতুন পাসপোর্ট পাওয়ায় কঠিন হবে না বলেই সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

তারেক রহমান যুক্তরাজ্যে কোনো স্ট্যাটাসে রয়েছেন, তা নিয়ে নানা সময়েই কথা উঠেছিল। ২০১৫ সালে মালয়েশিয়ায় ছোট ভাই কোকোর মৃত্যুর পর কথা ওঠে, শর্ত সাপেক্ষে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকায় তখন কুয়ালালামপুর যেতে পারেননি তারেক। তারেক যদি যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে থাকেন, তবে তাকে একটি অস্থায়ী ভিসা দেয়া হতে পারে। তা দিয়ে আবার বিদেশ সফর করা যায় না। আবার রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়া হলে তার একটি ‘ট্রাভেল ডকুমেন্ট’ পাওয়ার কথা। সেটা দিয়ে তিনি বিদেশে কিংবা নিজ দায়িত্বে নিজ দেশেও ফিরতে পারেন। তারেকের ক্ষেত্রে কোনটি ঘটেছে, তা কখনোই স্পষ্ট জানা যায়নি। পাসপোর্টহীন তারেক তখন ব্রিটিশ সরকারের দেয়া ট্রাভেল ডকুমেন্ট নিয়ে বিদেশ গিয়েছিলেন বলে কথা উঠেছিল।

২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারি করে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পর দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে তারেক রহমান গ্রেপ্তার হন। ওই বছরের ৭ মার্চ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তিনি। পরে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাসহ আরও অনেক রাজনীতিককে গ্রেপ্তার করা হয়। পরের বছর নির্বাচনের আগে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের মুক্তি দেয়া শুরু করে। ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর জামিনে মুক্ত হন তারেক। এক সপ্তাহ পর ১১ সেপ্টেম্বর স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে দেশ ছাড়েন তিনি। সেই থেকে তিনি লন্ডনে রয়েছেন। তার ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোও মুক্তি পাওয়ার পর মালয়েশিয়া যান। তিনি সেখানে থাকা অবস্থায় ২০১৫ সালে মারা যান। ফলে বিএনপিতে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উত্তরাধিকার হিসাবে এখন তারেকই আছেন সামনে।

 

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version